শনিবার, ১৭ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা
সিরিজ বোমা হামলার ১৪ বছর

মামলা নিষ্পত্তিতে গতি নেই

এখনো বিচারাধীন ১৪২ মামলা, এ পর্যন্ত সাজা ৩২২ জনের

আরাফাত মুন্না ও মাহবুব মমতাজী

মামলা নিষ্পত্তিতে গতি নেই

ঢাকার রাস্তায় ছিল যানজট। সকাল থেকেই কর্মস্থলে ছুটছিল মানুষ। অফিস-আদালতেও ছিল কর্মচাঞ্চল্য। ১৪ বছর আগে আজকের এই দিনটা শুরু হয়েছিল অন্যান্য দিনের মতোই স্বাভাবিকভাবে। হঠাৎ পাল্টে যায় সবকিছু। কর্মচাঞ্চল্যের মধ্যে তখন শুধুই আতঙ্ক। বোমার বিকট শব্দে দিশাহারা মানুষ শুধু ছুটছে। এদিন সারা দেশে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) সিরিজ বোমা হামলা চালায়। দেশব্যাপী একযোগে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে চরম ঔদ্ধত্যে নিজেদের শক্তিমত্তার জানান দিয়েছিল জেএমবি। ওই ঘটনার পর রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে দায়ের হওয়া মামলাগুলোর বিচারকাজ আজও শেষ হয়নি। বারবার সমন দিয়েও সাক্ষীদের হাজির করা যাচ্ছে না। আইনজ্ঞরা বলছেন, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা আরও সুরক্ষিত করতে হলে চাঞ্চল্যকর এসব মামলার বিচার দ্রুত শেষ করা উচিত। বিচারে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে আর কেউ এমন অপরাধে জড়াতে সাহস পাবে না। অন্যদিকে এখনো এই নিষিদ্ধ সংগঠনটির কার্যক্রম নির্মূল করা যায়নি। মাঝে-মধ্যেই সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ঘটিয়ে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দেয় তারা। অভিযোগ রয়েছে, জেএমবিকে দিয়ে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করে যাচ্ছে দেশি-বিদেশি চক্রগুলো। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট আজকের দিনে দেশের ৬৩ জেলায় (মুন্সীগঞ্জ বাদে) বেলা ১১টার দিকে সিরিজ বোমা হামলা চালায় জেএমবি। মাত্র আধা ঘণ্টার ব্যবধানে দেশের ৪৫০টি স্থানে চালানো সেই হামলায় পাঁচ শতাধিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। হামলায় দুজন নিহত হন। আহত হন দুই শতাধিক মানুষ। হামলা চালানো হয় সুপ্রিম কোর্ট, জেলা আদালত, বিমানবন্দর, বাংলাদেশে থাকা মার্কিন দূতাবাস, জেলা প্রশাসক কার্যালয়, জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়, প্রেস ক্লাব, সরকারি ও আধা সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার কাছে।

পুলিশ সদর দফতরের তথ্যানুযায়ী, সিরিজ বোমা হামলার ঘটনায় সারা দেশের বিভিন্ন থানায় ১৫৯টি মামলা করে পুলিশ। এসব মামলার এজাহারে আসামি করা হয় ১৩০ জনকে। দায়ের করা মামলাগুলোর মধ্যে ১৭টির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। বাকি ১৪২টি মামলায় চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। এসব মামলার চার্জশিটে আসামি করা হয়েছে এক হাজার ৭২ জনকে। এর মধ্যে ৩২২ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে। খালাস পেয়েছেন ৩৫৮ জন। জামিনে রয়েছেন ১৩৩ জন আসামি। বিচারিক আদালতের রায়ে এখন পর্যন্ত মৃত্যুদন্ড হয়েছে ২৭ জনের। মৃত্যুদ- কার্যকর হয়েছে ছয় আসামির। মামলাগুলোতে মোট সাক্ষী করা হয় ৩ হাজার ২৮৫ জনকে। এর মধ্যে সাক্ষ্য দিয়েছেন এক হাজার ১২৪ জন। বাকিরা সাক্ষ্য দেননি। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রাপ্ত সর্বশেষ এসব তথ্য মামলা মনিটরিংয়ের জন্য তাদের কাছে রয়েছে বলে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানিয়েছেন পুলিশ সদর দফতরের অতিরিক্ত ডিআইজি (স্পেশাল ক্রাইম) রেজাউল করিম। তবে এসব মামলা মনিটরিংয়ের দায়িত্বে থাকা আইন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, অনেক মামলায় সাক্ষীদের না পাওয়ার কারণে মামলা শেষ করতে সময় বেশি লেগে যাচ্ছে। বেশির ভাগ সাক্ষীর ঠিকানাও পরিবর্তন হয়েছে বলে পুলিশ দাবি করে আসছে। এর পরও জঙ্গিদের যাতে কঠোর সাজা হয় সে ব্যাপারে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা সেভাবেই মামলা পরিচালনা করছেন। জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি আর নেই। এখন যে কোনো অপরাধেরই বিচার হয়। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্টে সারা দেশে যে সিরিজ বোমা হামলার ঘটনা ঘটেছিল, ওই ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলাগুলোর বিচার চলমান। দ্রুতই এসব মামলার বিচার শেষ হবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি। সূত্র জানায়, ২০০৫ সালের সিরিজ বোমা হামলার পর জেএমবির শীর্ষ নেতা শায়খ আবদুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলাভাই, আতাউর রহমান সানি, খালেদ সাইফুল্লাহ, আবদুল আউয়াল, হাফেজ মাহমুদসহ ৯৬১ জঙ্গি সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। ঝালকাঠিতে দুই বিচারক হত্যা মামলায় জেএমবির প্রধান শায়খ আবদুর রহমান ও সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলাভাইসহ সাতজনের ফাঁসির আদেশ দেয় আদালত। ২০০৭ সালের ২৯ মার্চ শায়খ আবদুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলাভাই, খালেদ সাইফুল্লাহ, আতাউর রহমান সানি, আবদুল আউয়াল ও ইফতেখার হাসান আল মামুনের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। চাঞ্চল্যকর মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন আইনজ্ঞরা। জানতে চাইলে আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশের মানুষ একটা ভীতির মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। দেশে ঠিক কী হতে যাচ্ছে কেউ বুঝে উঠতে পারছিল না। এরপর জঙ্গিরা দেশে আরও বেশ কিছু অরাজকতা সৃষ্টির চেষ্টা করেছে। তবে বর্তমান সরকার জঙ্গিদের কঠোরভাবে দমনে কাজ করছে। তিনি বলেন, জঙ্গিবাদ যাতে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে, সে জন্য সিরিজ বোমা হামলার মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন।

সর্বশেষ খবর