শনিবার, ১৭ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

ফাঁসির মঞ্চ থেকে ফিরে আসা প্রতিরোধ যোদ্ধার গল্প

নিজস্ব প্রতিবেদক

বিশ্বজিৎ নন্দী। একাত্তরে ১৬ বছর বয়সে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। ’৭৫ এ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পরও ঘরে বসে থাকতে পারেননি তিনি। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর গঠিত জাতীয় মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন প্রতিরোধ যুদ্ধে। সেই বাহিনী ’৭৬ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে হরতাল ডেকেছিল। হরতাল সফল করতে ১৩ আগস্ট রাতে বিশ্বজিৎ নন্দীর নেতৃত্বে ছয়জনের একটি বাহিনী টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ সড়কের একটি ব্রিজ উড়িয়ে দেয়। পরদিন তাদের আশ্রয়স্থল ঘিরে ফেলে সেনাবাহিনী।

কিন্তু আত্মসমর্পণ না করে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তারা। যুদ্ধে তার পাঁচ সহযোগী শহীদ হন। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় গ্রেফতার হয়ে সামরিক আদালতের রায়ে তার ফাঁসির দন্ড হয়। মৃত্যুর অপেক্ষায় আট বছর নির্জন কনডেম সেলে থাকার পর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার চাপে ফাঁসির সাজা মওকুফ করে তাকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেওয়া হয়। ১৪ বছর কারাভোগ শেষে ’৮৯ সালে মুক্তি পান এই যোদ্ধা। বাংলাদেশ প্রতিদিনের কাছে তুলে ধরেছেন নিজের সেই সব দিনের স্মৃতি। প্রতিরোধ যোদ্ধা হয়ে ওঠার ঘটনা জানিয়ে বিশ্বজিৎ নন্দী বলেন, খুনিরা যখন জাতির পিতাকে হত্যা করল তখন আমার শুধু বারবার মনে হচ্ছিল, এর বিরুদ্ধে একটা কিছু করা দরকার। কিন্তু কোনো কিছু শুরু করার মতো যোগ্যতা ওই সময় আমার ছিল না। আমি আশায় ছিলাম, বঙ্গবন্ধুর ছায়ায় যারা বড় হয়েছে, তারা নিশ্চই কিছু করবে। অপেক্ষায় থাকলাম। প্রায় দেড় মাস চলে গেল, কেউ রাস্তায় বের হয় না। ওই সময়টা আমার খুব অস্থিরতার মধ্যে কেটেছে। তিনি বলেন, পরবর্তীতে শুনতে পেলাম বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নিতে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী সশস্ত্র প্রতিবাদ করেছেন, তখন আর ঘরে বসে থাকতে পারিনি। আমিও সশস্ত্র প্রতিবাদ করেছিলাম। যুদ্ধ করেছিলাম। যুদ্ধে নিজের পাঁচ সঙ্গীকে হারানোর স্মৃতি বর্ণনা করতে গিয়ে বিশ্বজিৎ বলেন, ১৯৭৬ সালের ১৪ আগস্ট সকাল আনুমানিক ১০টার দিকে হঠাৎ করে কানে এলো, আমাদের উদ্দেশ করে কেউ বলছে আপনারা যারা ঘরের ভিতরে আছেন, স্যারেন্ডার করুন। আপনাদের কোনো ক্ষতি করা হবে না। আমি তখন জানালা খুলে দেখলাম, দুই হাত তিন হাত পর পর সেনাবাহিনী সদস্যরা পজিশন নিয়ে আছে। তখন আমার টিমের বাকি পাঁচজনকে জিজ্ঞেস করলাম আমরা আত্মসমর্পণ করব কি-না? তখন সবাই বলল, আমরা বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করেছি। আমাদের আত্মসমর্পণে বঙ্গবন্ধুকে অপমান করা হবে, আমরা আত্মসমর্পণ করব না। তখন মাত্র দুই মিনিটের ভিতরেই যুদ্ধের একটা পরিকল্পনা করলাম, কে কোন জায়গায় পজিশন নেবে। আমরা মাত্র ছয়জন ছিলাম। আমাদের প্রত্যেকের কাছে তিনটা করে গ্রেনেড ছিল। আমাদের একজন একটা গ্রেনেড ছুড়ে মারল। গ্রেনেড ছোড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘরের চারদিক থেকে বৃষ্টির মতো গুলি শুরু হলো। তিনজন ঘরের বাইরে গিয়ে পড়লেন, আমরা তিনজন ঘরের ভিতর পজিশন নিলাম, এই পজিশন নেওয়ার মধ্যেই মফিজ ভাইয়ের উরুতে গুলি লাগে। তখন মফিজ ভাই ধীরে ধীরে বসে পড়লেন। আমি তখন আমার কাঁধের দিকে তাকিয়ে দেখি চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়ছে। তখন বুঝতে পারলাম আমার কাঁধে গুলি লেগেছে। কিছুক্ষণ পর আহত অবস্থায় আমাকে গাড়িতে তোলা হলো। দেখলাম বাকি পাঁচজনের লাশও ওখানেই। তখন কি রকম কষ্ট হলো, সেটা বলে বোঝানো যাবে না। এই যুদ্ধে আমার সহযোদ্ধা জুবেদ আলী, সুবোধ ধর, দীপাল দাস, মফিজ উদ্দিন ও নিখিল নিহত হয়। সেনা হেফাজতে নির্যাতন ও কনডেম সেলে থাকার ঘটনা জানিয়ে বিশ্বজিৎ নন্দী বলেন, সব মিলিয়ে ১১৫ দিন ছিলাম সেনা হেফাজতে। নানা ধরনের নির্যাতন চালানো হয়েছে। এই ১১৫ দিন পর আমাকে যখন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হস্তান্তর করা হয়, তার কয়েকদিন পরেই আমাকে সামরিক আদালতে বিচারের সম্মুখীন হতে হয়েছে। ওই বিচারে আমাকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছিল। রায়ের পর স্বাভাবিক ভাবেই আমাকে রাখা হয় কনডেম সেলে। বিশ্বজিৎ বলেন, কনডেম সেলে সাত বছরের দুর্বিষহ জীবন আমার। সামরিক আদালতের রায়ের ব্যাপারে তখন আপিল বা রিভিউর সুযোগ ছিল না। চার দফা তার ফাঁসি কার্যকরের চূড়ান্ত উদ্যোগ নিয়েও তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর হস্তক্ষেপ এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর জোরালো প্রতিবাদের কারণে বেঁচে যাই। ১৯৮৪ সালে ফাঁসির দন্ড মওকুফ করে রাষ্ট্রপতির নির্দেশে আদালত যাবজ্জীবন কারাদ-ের আদেশ দেয়। কনডেম সেল থেকে তখন তাকে স্থানান্তর করা হয় অন্য সেলে। এরপর সব আইনি প্রক্রিয়া সমাপ্ত করে ১৯৮৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর কারাগার থেকে মুক্ত হই। প্রতিরোধ যোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি না পাওয়ার আক্ষেপ তুলে ধরে বিশ্বজিৎ নন্দী বলেন, আমরা যদি বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ না করতাম, তাহলে ইতিহাসে লেখা হতো বাঙালি জাতি কাপুরুষ, বেইমান, অকৃতজ্ঞ। তারা তাদের পিতার হত্যার প্রতিবাদ করেনি। আমাদের প্রতিবাদটা যেহেতু দেশ ও জাতির পক্ষে, তাই এটা অস্বীকার করার ক্ষমতা কারও নেই। আজ হোক, কাল হোক এই রাষ্ট্রকেই এটা স্বীকার করতে হবে। যদি বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা মানেন, তাহলে তার হত্যার পরে যে প্রতিরোধ যুদ্ধ হয়েছিল, তা স্বীকার করতেই হবে। আর আমাদের প্রতিরোধ যুদ্ধকে যদি স্বীকার করা না হয়, তাহলে স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস অসমাপ্তই থেকে যাবে।

সর্বশেষ খবর