বুধবার, ২৮ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

সিন্ডিকেট সন্ত্রাসে অচল হতে চলেছে চট্টগ্রাম বন্দর

শিপ হ্যান্ডলিংয়ে অ্যাসোসিয়েশনের নৈরাজ্য, বন্দরের গতিশীলতা ও রাজস্ব আদায়ে বাধা, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বড় শিল্প গ্রুপগুলো

রিয়াজ হায়দার চৌধুরী, চট্টগ্রাম

সিন্ডিকেট সন্ত্রাসে অচল হতে চলেছে চট্টগ্রাম বন্দর

সিন্ডিকেট সন্ত্রাসে অচল হতে চলেছে চট্টগ্রাম বন্দর। বাংলাদেশ শিপ হ্যান্ডলিং অ্যান্ড বার্থ অপারেটর অ্যাসোসিয়েশনের বিরুদ্ধেই উঠেছে অভিযোগের আঙ্গুল। অভিযোগ উঠেছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক)-এর বিরুদ্ধেও। তবে তারা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। বন্দর ব্যবহারকারী ব্যবসায়ীরা বলছেন, বহির্নোঙ্গরে জাহাজ থেকে মালামাল খালাসে শিপ হ্যান্ডলিংয়ের ক্ষেত্রে অ্যাসোসিয়েশনের প্রভাব বিস্তারের কারণে দেশের বড় শিল্প গ্রুপগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দরের গতিশীলতার ক্ষেত্রে যা প্রতিবন্ধকতার মতোই কাজ করছে। হারিয়ে যাচ্ছে আরও বিপুল রাজস্ব আদায়ের সম্ভাবনা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ওয়ান-ইলেভেনের পর ২০০৭ এর সময়কাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত কার্গোর চাপ অন্তত দ্বিগুণ বেড়েছে। কিন্তু এই সময়কালে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটরদের নিয়ন্ত্রণ বাড়ানো হয়েছে। অথচ একই সময়কালের মধ্যে শুধু       চট্টগ্রামবন্দর নয় দেশের সবকটি খাতের সবকটি বিভাগেই লোকবল বৃদ্ধিসহ সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হয়েছে। কেবল শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর ক্ষেত্রেই ‘সংকোচন নীতি’ অবলম্বন করা হয়। মুক্তবাজার অর্থনীতির চলতি সময়ে এই ধরনের কার্যক্রমকে সন্ত্রাসের শামিল বলে অভিহিত করেছেন ব্যবসায়ীরা। বিশেষ করে বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীগুলো যাতে নিজের ব্যবস্থাপনায় জাহাজ থেকে পণ্য খালাস করতে না পারে সে জন্য নানা ধরনের কৌশলে করা হচ্ছে হয়রানি, যার ফল ভোগ করতে হয় সাধারণ ক্রেতাদের। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে এ ধরনের কার্যক্রমকে ‘সন্ত্রাসের শামিল’- বলছেন স্টেক হোল্ডাররা। অবশ্য চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ও অভিযুক্তদের এক্ষেত্রে রয়েছে ভিন্ন মত।

বন্দর ব্যবহারকারী ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিগত ওয়ান-ইলেভেনের পূর্বেকার অরাজক পরিস্থিতিতে যেন ফিরে যেতে চলেছে চট্টগ্রাম বন্দর। ওয়ান-ইলেভেনের সংস্কারে বন্দরের পণ্য লোডিং আনলোডিংয়ের ক্ষেত্রে যে ধরনের নীতিমালা গ্রহণ, স্বচ্ছতা ও গতিশীলতা এসেছিল সাম্প্রতিক সময়ে তার যেন ব্যত্যয় ঘটে চলেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

বাংলাদেশ শিপ হ্যান্ডলিং অ্যান্ড বার্থ অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন হ্যান্ডলিংয়ের ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বন্দরে মোংলা বন্দরের চেয়ে অনেক বেশি মূল্য নিচ্ছে পণ্য খালাসে। অ্যাসোসিয়েশনভুক্ত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পণ্য খালাস করতে গেলে সেখানেও বিড়ম্বনায় পড়তে হয় আমদানিকারকদের। জাহাজ থেকে পণ্য খালাস করতে গিয়ে মালামাল নষ্ট করা এবং বিলম্বে পণ্য খালাস করায় বিদেশি মুদ্রায় ডেমারেজ দিতে হচ্ছে, যার ফলে আমদানিকারকদের লোকসানের সম্মুখীন হতে হচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বলছেন, জাহাজে করে বিদেশ থেকে আনা পণ্য খালাসে যারা আউটারে কাজ করে তাদেরকে ‘শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর’ বলে। দেশের বড় বড় শিল্প গ্রুপগুলোর রয়েছে নিজস্ব অপারেটিং ব্যবস্থা। তারা নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় মালামাল খালাস করে। এতে তাদের নিরাপত্তা ও সাশ্রয় হয়।

বন্দর ব্যবহারকারীরা বলছেন, শিপিং এজেন্ট কর্তৃক চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজের আগমনীবার্তা ঘোষণার পরই হ্যান্ডলিং অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন তাদের তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজ বরাদ্দ দেয়। এক্ষেত্রেই রয়েছে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ। সংশ্লিষ্টরা দাবি করছেন, অপেক্ষমাণ বা বাদ পড়া ১৩টি কোম্পানি বছরে ন্যূনতম পাঁচ কোটি টাকা আয় বঞ্চিত হয়েছে। এক্ষেত্রে গেল তিন বছরে তাদের অন্তত ৩২৫ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে রাউটারে ৩২টি শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর কাজ করছে। এরই মধ্যে ইতিপূর্বে নন রেসপন্স তালিকাভুক্ত হওয়া ১৩টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পাঁচটি আদালতে রিট করেছে। তিনটি প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে আদালতের নির্দেশনায় কাজ শুরু করে। অন্য তিনটিকে কাজ শুরুর জন্য আদালত অনুমতি দিলেও আপিল অনিষ্পন্ন থাকায় তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে রয়েছে। অথচ বন্দরের স্টেকহোল্ডাররা বলছেন, সবকটি অপারেটরকে কাজ করতে দিলে চট্টগ্রাম বন্দরের গতিশীলতা আরও বাড়ত। শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর এ হক চৌধুরী অ্যান্ড সন্সের ম্যানেজার ইকবাল করিম চৌধুরী জানান, ইতিমধ্যে একাধিক প্রতিষ্ঠানে আইনি নির্দেশনা পেলেও বারবার আপিলের কারণে সুযোগবঞ্চিত হচ্ছে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটরগুলো। তিনি জানান, তার প্রতিষ্ঠান মোংলায় অপারেট করতে পারলেও চট্টগ্রাম বন্দরে অপারেট করতে পারছে না। ২০১৫ সাল থেকে চলতি সময় পর্যন্ত নানা কৌশল করে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন বড় শিল্প গ্রুপগুলোকে হয়রানি ও বিড়ম্বনায় ফেলেছে। এরই মধ্যে অন্তত তিনশ কোটি টাকার লোকসান গুনেছে কাজের সুযোগ না পাওয়ায় শিপ হান্ডলিং অপারেটররা।

এদিকে ৮ বছর আগেই উচ্চ আদালতের আদেশ নিয়ে কাজ শুরু করা আমিরা অ্যান্ড সন্সের চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম বলেন, অ্যাসোসিয়েশনটি প্রভাবিত করে চট্টগ্রাম বন্দরকেও। অহেতুক শর্ত দিয়ে অপারেটরকে টেন্ডারে বাদ দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করেছে। এতে বড় আমদানিকারক ও শিল্প গ্রুপ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ক্ষতিগ্রস্ত হন অপারেটররা। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে অ্যাসোসিয়েশনের কাছে ব্যবসায়ীরা এভাবে জিম্মি থাকতে পারেন না।

এদিকে শিপ হান্ডলিং অপারেটর মমতাজ শিপিং এজেন্সির সিইও মোহাম্মদ সালাহউদ্দীন বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরে ন্যূনতম ২০ শতাংশ গ্রোথের বিবেচনায়ও অপারেটরদের উন্মুক্ত করে দেওয়া প্রয়োজন। এতে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজের হ্যান্ডলিংয়ে সামগ্রিকভাবে বন্দরের গতিশীলতা বাড়বে। লাভবান হবে দেশ। অ্যাসোসিয়েশনের প্রভাব বিস্তারের বিষয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি।

জানা গেছে, ২০১৪ সাল থেকে সৃষ্ট এই সংকটে বাদপড়া ১৩টি প্রতিষ্ঠানের সবকটি বিপুল ক্ষতির শিকার হয়েছে, কারণ অর্থমূল্য অন্তত তিনশ কোটি টাকা হবে বলে মনে করেন তারা। আইনি প্রক্রিয়ায় আমির অ্যান্ড সন্স, এএসএল স্টিভিডোর অ্যান্ড লজিস্টিকস লিমিটেড এবং সিওয়ার্ল্ড করপোরেশন কাজ শুরু করেছে। অপেক্ষমাণ মমতাজ শিপিং এজেন্সির বিষয়ে হাই কোর্টের দেওয়া আদেশ চট্টগ্রাম বন্দরের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। এদিকে, সারাসিন ইন্টারন্যাশনাল এবং এ হক চৌধুরীর রিটে হাই কোর্টের আদেশ দিলেও আপিল বিভাগের শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।

জানতে চাইলে অভিযোগ অস্বীকার করে বাংলাদেশ শিপ হ্যান্ডলিং অ্যান্ড বার্থ অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন সভাপতি এ কে এম সামসুজ্জামান রাসেল বলেছেন, শিপ হান্ডলিং বরাদ্দ প্রক্রিয়াটি করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। এক্ষেত্রে অ্যাসোসিয়েশনের হস্তক্ষেপ বা যোগসাজশের কোনো অভিযোগ সত্য নয়। তাছাড়া চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের দর বিভক্তির বিষয়টিও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ও মোংলা মোংলায় অ্যাসোসিয়েশনের নিজস্ব। সেখানে অ্যাসোসিয়েশনের নির্দিষ্ট দর থাকলেও কেউ কেউ আন্ডার রেটে কাজ করেন বলেও জানালেন তিনি। বড় শিল্প গ্রুপগুলোর ইনহাউজ কাজ করার কোনো নীতিমালা বন্দরের শিপ হান্ডলিং নিয়মে নেই বলেই দাবি তার।

শিল্প গ্রুপগুলোর ইনহাউজ কাজ করার ক্ষেত্রে কোনো নিয়ম নেই বলে অ্যাসোসিয়েশন সভাপতির এই দাবিকে নাকচ করে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শীর্ষ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান নিজেদের কাজ নিজেরা করার জন্য বহু আগেই হাই কোর্ট থেকে অনুমতি নিয়ে এসেছেন। অভিযোগ উঠেছে, তিনটি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে আপিল করা না হলেও শুধু এ হক চৌধুরী অ্যান্ড সন্স এবং সারাসিন ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড-এর বিষয়ে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে আপিল করা হয়েছে। বাংলাদেশ শিপ হ্যান্ডলিং অ্যান্ড বার্থ অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে আপিল করেছেন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষও। এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে চট্টগ্রাম বন্দরের আইন কর্মকর্তা মুনতাসির আহমেদ বিচারাধীন ও নির্বাহী বিষয়ে মন্তব্য করতে অপারগতা জানান। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বন্দর সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আপিলের বিষয়টি নির্ভর করে ঊর্ধ্বতন সিদ্ধান্তের ওপর। যে মামলায় বেনিফিট পাওয়া যায় বলে ধারণা করা হয়, সেটিতেই কৌঁসুলি নিয়োগসহ আপিলের সিদ্ধান্ত আসে।

অভিন্ন সূত্র জানায়, অ্যাসোসিয়েশনের প্রভাবের বিষয়টি অমূলক নয়। যারা প্রাথমিক পর্যায়ে তালিকাভুক্ত হননি, পরবর্তীতে সংযুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে তাদের বিষয়ে পূর্বতনরা অভিযোগ করতেই পারেন। সে ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের আপত্তির কোনো কারণ নেই। কেননা শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর ৩০ এর স্থলে যদি ৫০ জন হয়, সে ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বন্দরে লাভবান হওয়ারই বিষয় থাকে। কারণ এতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও কাজে গতিশীলতা আসে। এদিকে এসব বিষয়ে জানতে চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুক ও পরিচালক (ট্রাফিক) এনামুল করিমের মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তারা ফোন ধরেননি।

সর্বশেষ খবর