বুধবার, ২৮ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা
বিশেষ কলাম

কয়েকটি স্যালুটারি নির্দেশনা

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

হাই কোর্ট বিভাগের মাননীয় বিচারপতি এনায়েতুর রহিম এ বিভাগের প্রশংসিত বিচারপতিদের অন্যতম। ন্যায়পরায়ণতা, বলিষ্ঠতা এবং দৃঢ়তার দিক থেকে তিনি এরই মধ্যে এক বিশিষ্ট স্তরে পৌঁছেছেন।

তাঁর দৃঢ়তার নতুন পরিচয় মিলেছে বিগত ১৯ ও ২০ আগস্ট যখন তিনি বরগুনার মিন্নির জামিনের আবেদনের শুনানিকালে কয়েকটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দিলেন। সেগুলো আইনের শাসনের ধারা অব্যাহত রাখার জন্য এবং ফৌজদারি মামলায় ন্যায়নিষ্ঠতা বজায় রাখার জন্য অপরিহার্য। মিন্নির জামিন শুনানিকালে যেসব বিষয় অত্যন্ত যৌক্তিক কারণে মাননীয় বিচারপতি এনায়েতুর রহিম এবং মাননীয় বিচারপতি মোস্তাফিজুর রহমান বিবেচনায় নিয়েছিলেন সেগুলো ছিল মিন্নিকে রিমান্ডে নেওয়ার পর বরগুনার এসপি মারুফ হোসেনের রহস্যজনক অতিউৎসাহী আইনবহির্ভূত কার্যকলাপসমূহ-  মাননীয় বিচারপতিদ্বয় অনেকটা স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়েই এগুলো নজরে নিয়েছেন যা সত্যি সত্যি ন্যায়বিচারকসুলভ। অতীতের দিকে তাকালে আমরা আইনবহির্ভূত যে কাজ দেখতে পাই তা একাধিক। তবে সবই অভঙ্গ শিকলের মতো। প্রথমত ঘটনার পরপরই এসপির সঙ্গে স্থানীয় সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর বহু অঘটনের নেতা বলে স্থানীয়ভাবে পরিচিত পুত্র সুনাম দেবনাথের রুদ্ধদ্বার কক্ষে দীর্ঘ বৈঠক, যার পরই এসপি মাঠে নেমে পড়েন একের পর এক বেআইনি কর্মকাে । যে মিন্নি প্রথমত ছিলেন এজাহারে উল্লিখিত প্রথম সাক্ষী, তাকে হঠাৎ করেই পুলিশ লাইনসে তলব করে প্রায় ১২ ঘণ্টা আটকে রেখে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করা হয় এবং দিনের শেষে তাকে আসামি হিসেবে ঘোষণা করে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশ লাইনসে নেওয়ার আগে একটি তথাকথিত মানববন্ধন করে মিন্নির গ্রেফতার দাবি করা হয় এবং সে মানববন্ধনে মূল ভূমিকা পালন করেন শম্ভুপুত্র সুনাম দেবনাথ। এর পরই এসপি সাহেব মিন্নিকে গ্রেফতারের জন্য অতিউৎসাহী হয়ে পড়েন, যা দেখে মনে হচ্ছিল মিন্নিকে আটকানোই তার একমাত্র কাজ। তিনি অন্য আসামিদের ধরার কথা বেমালুম ভুলে গেলেন। সুনাম আয়োজিত মানববন্ধন এবং এসপির অতিউৎসাহী তৎপরতা দেখে সুনাম ও এসপির ষড়যন্ত্রের গন্ধ বেশ পরিষ্কারই হয়ে যায়। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এ ষড়যন্ত্র? উত্তর খুবই সহজ। সুনাম দেবনাথের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে তিনি মূল হত্যাকারী নয়ন বন্ডের মাদক ব্যবসায়ে তার গডফাদার হিসেবে বহু বছর ধরে কাজ করছেন এবং জেলার এসপির সহায়তায় নয়নকে প্রতিয়িনত আইনের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন। এ অবস্থায় অন্য হত্যাকারীদের সঠিক বিচার হলে এবং মিন্নি তাতে সাক্ষ্য দিলে সুনাম দেবনাথ ও এসপির অপকর্মসমূহ আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার সময় বেরিয়ে যাবে বিধায় মিন্নিকে সাক্ষীর তালিকা থেকে সরানো সুনাম এবং এসপি উভয়ের স্বার্থের জন্যই অপরিহার্য ছিল। গ্রেফতারের পরপর সুনাম নির্দেশ দিলেন মিন্নির পক্ষে যেন কোনো আইনজীবী না দাঁড়ান এবং তার কারণেই মিন্নির রিমান্ড শুনানির সময় ভয়ে কোনো আইনজীবী দাঁড়াননি। কিন্তু তার চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক ছিল ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের আচরণ; যিনি ন্যাচারাল জাস্টিসের ন্যূনতম বিধান উপেক্ষা করে আইনজীবী ছাড়াই শুনানি করলেন এবং উচ্চ আদালতের নির্দেশনা লঙ্ঘন করে এক তরুণীকে রিমান্ডের নামে হাওলা করে দিলেন পুরুষ পুলিশের হাতে। তিনি ন্যূনতম বিচারকসুলভ কাজটিও করেননি, তার উচিত ছিল সেদিন শুনানি মুলতবি করে একজন আইনজীবীর ব্যবস্থা করা।

এরপর শুরু হয় এসপি-সুনামের চরম অবৈধ কার্যকলাপ। রিমান্ড অর্ডার পাওয়ার পরপরই পুলিশ সুপ্রিম কোর্টের ১৫ দফা নির্দেশনার প্রতি চরম অবমাননা প্রদর্শন করে মিন্নিকে নিয়ে যায় পুলিশ লাইনসে। এরপর অতিউৎসাহী এসপি সাহেব সংবাদ সম্মেলন ডেকে এবং বিবিসিকে বললেন, মিন্নি দোষ স্বীকার করেছেন অথচ মিন্নি তখনো তথাকথিত ১৬৪ ধারায় কোনো বক্তব্য দেননি। এসপির উক্তি থেকে যা যৌক্তিকভাবেই আঁচ করা যায় তা হলো এই যে, তিনি তার অধীন পুলিশ কর্মকর্তাদের দিয়ে মিন্নির তথাকথিত বক্তব্য আগেই তৈরি করে রেখেছিলেন। নইলে মিন্নির তথাকথিত স্বীকারোক্তির আগেই এসপি কী করে বলতে পারলেন মিন্নি দোষ স্বীকার করেছেন? রিমান্ড সম্পর্কে প্রয়াত বিচারপতি হামিদুল হক সাহেব ১৫ দফা বাধ্যতামূলক নির্দেশনা দিয়েছেন। সেগুলো আপিল বিভাগও অনুমোদন করেছে। এক কথায় এই ১৫ দফা নির্দেশনা খেলাপ করে কোনো স্বীকারোক্তি আদায় করা হলে তা আইনত স্বীকারোক্তি হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। অথচ নিম্ন আদালতদ্বয় একটিবারও প্রশ্ন করেনি সুপ্রিম কোর্টের ১৫ দফা নির্দেশনা পালিত হয়েছে কিনা। দৃশ্যত তার কোনোটিই পালিত হয়নি। প্রশ্ন হচ্ছে, নিম্ন আদালতের কি কিছুই করার নেই? সবই কি উচ্চ আদালতকেই করতে হবে? বিষয়টি হাই কোর্টে এলে মাননীয় বিচারপতিদ্বয়ের দৃষ্টি এসব বিষয়ের প্রতি যৌক্তিক কারণেই পড়ে। তারা প্রশ্ন করেন, এসপি কীভাবে আগের দিনই বলে ফেললেন মিন্নি স্বীকারোক্তি দিয়েছেন এবং এর ফলাফল কী? তারা আরও প্রশ্ন করেছেন, রিমান্ড আদেশ পাওয়ার পর কীভাবে এবং কোন আইনবলে মিন্নিকে পুলিশ লাইনসে নেওয়া হলো? তারা প্রশ্ন করেছেন পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা পালন করা হয়েছে কিনা? এসপি কী জবাব দেবেন তা আমরা আঁচ করতে পারব না, তবে এসপির ব্যাখ্যা আইনত গ্রহণযোগ্য না হলে হাই কোর্ট দৃঢ়তার সঙ্গে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, এটাই সবার প্রত্যাশা হওয়া স্বাভাবিক। এদিকে অতিউৎসাহী পুলিশ এখন চেষ্টা করছে মিন্নির সঙ্গে নয়নের সম্পর্ক প্রমাণের। এ ব্যাপারে সাবেক পুলিশপ্রধান শহিদুল হক সাহেবের সঙ্গে সুর মিলিয়ে আমিও বলব, মিন্নির সঙ্গে নয়নের সম্পর্ক প্রমাণিত হলে তার দ্বারা হত্যাকাে  মিন্নির সম্পৃক্ততা বা এমনকি ষড়যন্ত্রও প্রমাণ হয় না। মিন্নি যদি নয়নকে বিয়ে করেও থাকেন, সেটি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। তা ছাড়া নয়নের ঘরে মিন্নির ছবি পাওয়া, লিপস্টিক, চিরুনি পাওয়া বা নয়নের সিমে মিন্নির কথোপকথন পাওয়া কিছুই খুনে মিন্নির সম্পৃক্ততা প্রমাণ করে না, যদি না হত্যাকাে র ব্যাপারে কথোপকথন থাকে। তা ছাড়া ভুয়া ছবি খুব সহজেই তৈরি করা যায়। আর একটি বিষয় বলা প্রয়োজন। সাক্ষ্য আইনে তৃতীয় কোনো ব্যক্তির স্বীকারোক্তি বস্তুত মূল্যহীন এ অর্থে যে, তার দ্বারা সাজা হতে পারে না। আসামির বিরুদ্ধে অন্য সাক্ষ্য থাকলে তবেই তৃতীয় ব্যক্তির স্বীকারোক্তিকে শুধু বিবেচনায় নেওয়া যায় মাত্র- এর বেশি নয়। শুনানিকালে সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি অ্যাডভোকেট আমিন উদ্দিনের মন্তব্যটি তুলে ধরে বলতে চাই, ফৌজদারি বিচারে পারদর্শী অ্যাডভোকেট আমিন উদ্দিন তথাকথিত স্বীকারোক্তিটি পড়ে বলতে পেরেছেন যে, উক্তটি পড়লেই বোঝা যায় এটি বানোয়াট। তবে তার চেয়েও বড় প্রশ্ন, এটি আদায়ের আগে সুপ্রিম কোর্টের ১৫ দফা নির্দেশনা পালিত হয়েছিল কিনা, না হয়ে থাকলে এই তথাকথিত স্বীকারোক্তি তো সর্বৈব অর্থহীন।

সর্বশেষ খবর