রবিবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

আসামে নাগরিকত্ব নেই ১৯ লাখের

আনুমানিক ১১ লাখ হিন্দু ৬ লাখ মুসলমান সংখ্যালঘু বিহারি, নেপালি লেপচা ২ লাখ ট্রাইব্যুনালে আবেদন ১২০ দিনের মধ্যে, ব্যর্থ হলে যাওয়া যাবে উচ্চ আদালতে

নয়াদিল্লি প্রতিনিধি ও কূটনৈতিক প্রতিবেদক

আসামে নাগরিকত্ব নেই ১৯ লাখের

নাগরিক তালিকায় নাম উঠেছে কিনা দেখতে গতকাল আসামের গুয়াহাটির একটি তথ্য কেন্দ্রে মানুষের দীর্ঘ লাইন -এএফপি

ভারতের আসাম রাজ্যে জাতীয় নাগরিকপঞ্জির (এনআরসি) চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। গতকাল সকাল ১০টায় প্রকাশিত তালিকায় ভারতের নাগরিকত্ব থেকে বাদ পড়েছেন ১৯ লাখের বেশি মানুষ। বাদ পড়া বিশালসংখ্যকের চোখেমুখে দেখা দিয়েছে আতঙ্ক। বাদ পড়ার মধ্যে রয়েছেন আসাম রাজ্যসভার বেশ কয়েকবারের নির্বাচিত সদস্য ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাও। এখন তাদের ভাগ্যে কী আছে তা পুরোই অজানা। তবে সরকারের পক্ষ থেকে আতঙ্কিত না হয়ে আগামী ১২০ দিনের মধ্যে নির্ধারিত ট্রাইব্যুনালে গিয়ে নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে বলা হয়েছে। প্রয়োজনে সুপ্রিম কোর্টে যেতে বলা হয়েছে। আসাম রাজ্যে কত মানুষ অবৈধভাবে বাস করছে মূলত তা নির্ধারণ করতেই এনআরসি তৈরি শুরু হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর আসামে গিয়ে বসবাস করাদের নাগরিক এ তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে বলে সাধারণভাবে বলা হচ্ছে। আসামের গণমাধ্যমগুলো জানায়, এনআরসির কাছে জমা পড়ে ৩ কোটি ২৯ লাখ আবেদন। চূড়ান্ত তালিকায় অন্তর্ভুক্তির জন্য মোট ৩ কোটি ১১ লাখ ২১ হাজার ৪ জন নাগরিককে উপযুক্ত বলে মনে করা হয়েছে। বাদ পড়েছে ১৯ লাখ ৬ হাজার ৬৫৭ জন নাগরিকের নাম। তবে বাদ পড়ার মধ্যে আবেদন না করা ও মৃত ব্যক্তিরাও রয়েছেন। সরকারিভাবে প্রকাশ করা না হলেও স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রের খবর, বাদ পড়ার মধ্যে বাংলাভাষী হিন্দু রয়েছেন প্রায় ১১ লাখ। বাংলাভাষী মুসলমান প্রায় ৬ লাখ এবং ২ লাখ হলেন সংখ্যালঘু বিহারি, নেপালি ও লেপচা। সংখ্যালঘুর একটি বড় অংশ এই নাগরিকত্বের জন্য আবেদনই করেনি। আসামের এনআরসি কো-অর্ডিনেটর প্রতীক হাজেলা জানান, ‘বাদ পড়াদের এখনই আতঙ্কের কোনো কারণ নেই। চূড়ান্ত তালিকায় নাম না থাকলেও তারা পুনরায় ফরেনারস ট্রাইব্যুনালে আবেদনের সুযোগ পাবেন। এজন্য রাজ্যটির গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোয় পর্যাপ্তসংখ্যক ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করা হয়েছে। আবেদনের সময়সীমাও ৬০ থেকে বাড়িয়ে ১২০ দিন করা হয়েছে।’ জানা যায়, আসামের এনআরসির দাবি বহুদিনের। ১৯৭৯ থেকে ’৮৫ সাল পর্যন্ত আসামে ‘বিদেশি খেদাও’ নামে ব্যাপক আন্দোলন হয়। শেষ পর্যন্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী আন্দোলনকারী আসাম গণপরিষদের সঙ্গে নাগরিকদের পরিচয় চিহ্নিত করার চুক্তি করেন। চুক্তি অনুযায়ী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর যারাই আসাম গিয়েছেন তারা সবাই অনুপ্রবেশকারী বা বেআইনি নাগরিক। কিন্তু এতে হিতে বিপরীত হতে পারে বুঝে কংগ্রেস সরকার ধীরে চল নীতি নিয়েছিল। কিন্তু বিজেপি আদালতের দ্বারস্থ হয়ে সেই এনআরসি প্রক্রিয়া চালু করে। ফলে দীর্ঘ বিরতির পর ২০১৮ সালে সে প্রক্রিয়া আবার শুরু হয়। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে গত বছরের ৩০ জুলাই আসামে প্রকাশিত হয় জাতীয় নাগরিকপঞ্জির একটি খসড়া তালিকা। সে তালিকায় নাগরিকের খাতা থেকে বাদ পড়ে ৪০ লাখ ৭ হাজার ৭০৭ জনের নাম। পরে অতিরিক্ত খসড়ায় বাতিল হয় আরও ১ লাখ ২ হাজার ৪৬৫ জনের নাম। সব মিলিয়ে ৪১ লাখের বেশি মানুষের নাম বাদ পড়ায় তখন দেশজুড়ে বিতর্ক তৈরি হয়। এবার চূড়ান্ত তালিকায় সে সংখ্যা কমে ১৯ লাখে এসে দাঁড়িয়েছে। তালিকা প্রকাশ নিয়ে আতঙ্কিত শুধু স্থানীয় বাসিন্দারাই ছিলেন না, আতঙ্ক ছিল সরকারের মধ্যেও। এজন্য চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ নিয়ে যাতে কোনো সহিংসতা বা গ গোল না হয় সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আসামজুড়ে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা হয়। গুজব ঠেকাতে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতেও নজরদারি চালানো হয়। গুয়াহাটিসহ বেশকিছু স্পর্শকাতর এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলোতেও বাড়তি নজরদারি চলে। এমন পরিস্থিতিতেই চূড়ান্ত তালিকায় নাম আছে কিনা, তা জানার জন্য সকাল থেকেই নজর ছিল এনআরসির ওয়েবসাইটে। কিন্তু সকাল ১০টায় তালিকা প্রকাশের পরপরই ওই ওয়েবসাইটটি বিকল হয়ে যায়। অবশ্য ওয়েবসাইটের বাইরে রাজ্যটির ২ হাজার ৫০০ এনআরসি সেবা কেন্দ্র (এনএসকে), ১৫৭টি আঞ্চলিক কার্যালয়, ৩৩টি জেলা ডেপুটি কমিশনার কার্যালয়েও টাঙিয়ে দেওয়া হয় ওই তালিকা। সেখানেই তালিকা দেখতে ভিড় জমায় মানুষ। নাম থাকা ব্যক্তি যতটা উৎফুল্ল হয়েছেন, নাম বাদ পড়ায় ততটাই মুষড়ে পড়েছেন নাম না থাকা ব্যক্তি। চোখেমুখে ফুটে ওঠে হতাশা ও আতঙ্কের ছবি। ভারতীয় গণমাধ্যম বলছে, যাদের নাম বাদ পড়েছে তার বেশির ভাই হিন্দু। বাঙালি, রাজস্থানি, বিহারি এমনকি গুজরাটি। এরা দীর্ঘদিন ধরেই আসামে বসবাস করছেন। এ কারণে আসাম বিজেপি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। আসামের দ্বিতীয় প্রভাবশালী মন্ত্রী হেমন্ত বিশ্বাস বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, ‘এনআরসির এ তালিকা মানছি না। কারণ, বাংলাদেশের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের আগে এসেছেন তাদেরও বাদ দেওয়া হয়েছে।’ অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন আরএসএস-প্রধান মোহন ভাগওয়াতও। তিনি বলেন, ‘হিন্দুদের নাগরিক তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার ষড়যন্ত্র করা হয়েছে।’ আসামের প্রভাবশালী বিধায়ক শিলাদিত্য সেন বলেন, ‘হিন্দুদের বিরুদ্ধে এনআরসি ষড়যন্ত্র করছে।’ নাগরিক তালিকা থেকে বাদ পড়া মানুষ ভারতের ভোটার তালিকায় স্থান পাবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। ইতিমধ্যে আসামে নির্বাচন কমিশন ‘সন্দেহজনক’ ভোটার বলে এক তালিকা করে বলেছে, এরা কেউ ভোট দিতে পারবে না।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর