সোমবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

পুলিশকে টার্গেট করল কারা

সায়েন্স ল্যাবের ঘটনা নিয়ে চলছে বিশ্লেষণ

সাখাওয়াত কাওসার

পুলিশকে টার্গেট করল কারা

পুলিশ টার্গেট করে একের পর এক একই কায়দায় হামলা করছে দুর্বৃত্তরা। আহতও হচ্ছেন অনেক পুলিশ সদস্য। তবে এসব ঘটনা ঠিক কারা ঘটাচ্ছে সে সম্পর্কে এখনো হলফ করে বলতে পারছে না পুলিশ। অনুমাননির্ভর বক্তব্যই দিচ্ছেন পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, পুলিশ কাদের টার্গেট? হামলাকারীরাই বা কারা? পুলিশ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব প্রশ্নের জবাব খুঁজতেই গোয়েন্দারা কাজ শুরু করেছে। অন্যদিকে, বোমা হামলার ঘটনায় রাজধানীসহ সারা দেশে পুলিশের সব ইউনিটকে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছে পুলিশ সদর দফতর। এদিকে শনিবার দিবাগত রাতে রাজধানীর সায়েন্স ল্যাব মোড়, কিছুদিন আগে পল্টন মোড়ে ও খামারবাড়ী এলাকায় দুর্বৃত্তদের ফেলে রাখা বোমা আগের তুলনায় অনেক উন্নতমানের হওয়ায় তা ভাবিয়ে তুলছে পুলিশের সদস্যদের। দফায় দফায় পরীক্ষা করে পুলিশেরই বোমা বিশেষজ্ঞরা মতামত দিয়েছেন, এগুলোতে টাইমার সেট করা ছিল। অথবা বোমাগুলো ছিল রিমোট কন্ট্রোলড। সে হিসেবে আগে থেকেই দুর্বৃত্তরা তাদের সুবিধাজনক সময়ে নির্দিষ্ট জায়গায় বোমাগুলো রেখে দিচ্ছে। হামলা চালাচ্ছে নির্দিষ্ট টার্গেটে।

পুলিশ মহাপরিদর্শক ড. জাবেদ পাটোয়ারী বিভিন্ন সময় বলেছেন, জঙ্গিদের টার্গেটে রয়েছে পুলিশ। তবে পুলিশের প্রতিটি সদস্য এ ব্যাপারে সতর্ক। গত শনিবার রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আহত পুলিশ সহকারী উপপরিদর্শক সাহাবুদ্দীন ও ট্রাফিক পুলিশের কনস্টেবল আমিনুল ইসলামকে দেখতে গিয়ে তিনি বলেন, সাহাবুদ্দীন ডিউটিতে ছিল না। আক্রমণকারীদের লক্ষ্য কী ছিল বলতে পারছি না। আমাদের বোমা এক্সপার্ট ও অন্যান্য এক্সপার্টরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।  এদিকে পুলিশ রাজধানীর সায়েন্স ল্যাব মোড়ে হাতবোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ টার্গেট ছিল বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া। গতকাল দুপুরে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ডিএমপি কমিশনার বলেন, আনুমানিক সোয়া ৯টার দিকে সায়েন্স ল্যাব মোড়ে একটি বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এর পরপরই আমরা ঘটনাস্থল পরিদর্শনসহ বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করেছি। বিভিন্ন সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। আশপাশের সব সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। এর বাইরে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে। তাই তদন্তাধীন এ বিষয়ে এখনই চূড়ান্ত মতামত দেওয়া যাবে না। তবে প্রাথমিকভাবে প্রতীয়মান হয়েছে, হামলায় ব্যবহৃত বস্তুটি একটি আইইডি ছিল। কোনো সন্ত্রাসীগোষ্ঠী পুলিশকে টার্গেট করে এ বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হামলাকারীদের অতি দ্রুত খুঁজে বের করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা উচিত। নইলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে এর প্রভাব পড়বে। এক প্রশ্নের জবাবে ডিএমপি কমিশনার বলেন, প্রায় তিন মাস আগে গুলিস্তান পুলিশ বক্সকে লক্ষ্য করে বোমা হামলা চালানো হয়েছিল। এরপর মালিবাগে পুলিশের গাড়িতে হামলা চালানো হয়েছে। পল্টন-খামারবাড়ীতেও পুলিশ বক্সের কাছ থেকে বিস্ফোরক পুঁতে রাখা হয়েছিল। এ থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রাথমিকভাবে প্রতীয়মান হয়েছে, সবগুলো হামলায় টার্গেট পুলিশ। সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর পুলিশের ওপর ক্ষোভ থাকা স্বাভাবিক মন্তব্য করে তিনি বলেন, ২০১৫ সালে দেশজুড়ে আগুন সন্ত্রাসের মাধ্যমে তা ব চালনো হয়েছিল। ২০১৬ সালে হলি আর্টিজানে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার পর পুলিশ মোটাদাগে তাদের নেটওয়ার্ক দুর্বল করে দিতে সক্ষম হয়েছে। যে কারণে পুলিশের ওপর ক্ষোভ থাকা স্বাভাবিক। এসব ঘটনা সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে ধারাবাহিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করার প্রয়াস কি না, কিংবা পুলিশের মনোবল ভেঙে দেওয়ার চক্রান্ত কি না তদন্ত করে দেখা হবে। জনগণের মনে ভীতি সৃষ্টি করে পুলিশের মনোবল ভেঙে দেওয়ার চক্রান্ত সফল হতে দেওয়া হবে না বলেও জানান তিনি। গুলিস্তান-মালীবাগে হামলার ঘটনায় তদন্তে অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রত্যেকটি ঘটনার বিষয়েই আমাদের বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তারা নানাভাবে খতিয়ে দেখছেন। ইতিমধ্যে এসব ঘটনার তদন্তে বলার মতো অগ্রগতি আছে, তবে তদন্তের স্বার্থে কিংবা জড়িতদের গ্রেফতারের স্বার্থে এখনই বলা যাচ্ছে না। প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, গুলিস্তানের বোমাটি টাইমার সেট করা, মালীবাগেরটি রিমোট কন্ট্রোল আর পল্টন-খামারবাড়ীর বোমা দুটি ছিল পুঁতে রাখা। সন্ত্রাসবাদের সমস্যা বৈশ্বিক মন্তব্য করে তিনি বলেন, ঘটনার পর পরই আইএস-এর দায় স্বীকার কতটা সত্য তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক কোনো সংগঠনের যোগাযোগ আদৌ আছে কি না, নাকি অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে এসব প্রচারণা। তা জানার জন্য আমরা আন্তর্জাতিক পর্যায়েও যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছি। এসব ঘটনার সঙ্গে রাজনৈতিক ও বৈশ্বিক চক্রান্ত রয়েছে কি না খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তবে এসব ঘটনায় জনসাধারণের আতঙ্কের কোনো কারণ নেই মন্তব্য করে তিনি বলেন, হোম গ্রোন জঙ্গি রয়েছে, তাদের নাম ভিন্ন হলেও বেসিক মিল রয়েছে। জঙ্গিদের নেটওয়ার্ক দুর্বল করে দিলেও হুমকি ও অপতৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। সেসব অপতৎপরতা চিহ্নিত করতে আমরা আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছি। অতীতের মতো এবারও আমরা সফল হব। অনভিপ্রেত কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশকে অকার্যকর করতে না পারা, পাকিস্তান-আফগানিস্তান বা সিরিয়ার মতো রাষ্ট্র করতে না পারার কারণে একটি গোষ্ঠী পুলিশকে টার্গেট করতে পারে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

পুলিশ সদর দফতরের বিশেষ বার্তা : রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবে পুলিশের ওপর বোমা হামলার ঘটনায় রাজধানীসহ সারা দেশে পুলিশের সব ইউনিটকে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছে পুলিশ সদর দফতর। নির্দেশনা অনুযায়ী পুলিশের যে কোনো গাড়িকে আন-অ্যাটেন্ডেড না রাখাসহ পুলিশের যে কোনো স্থাপনায় প্রবেশকালে সবাইকে বিধি মোতাবেক সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে তল্লাশি করতে বলা হয়েছে। পুলিশ সদর দফতরের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। এ বিষয়ে পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) মো. সোহেল রানা বলেন, রবিবার (১ সেপ্টেম্বর) সকালে পুলিশের সব এসপি, ডিআইজি ও ইউনিট প্রধানদের  মৌখিকভাবে এ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সূত্র বলছে, নিরাপত্তা সতর্কতা হিসেবে সংশ্লিষ্ট সব ইউনিটকে করণীয় বিষয়ে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ পুলিশের সব ইউনিটকে প্রয়োজনীয় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হয়েছে। পুলিশের যে কোনো স্থাপনায় প্রবেশ করতে চাইলে যে কাউকে বিধি অনুযায়ী সতর্কতার সঙ্গে তল্লাশি করতে করা হবে। একই সঙ্গে সতর্কতার সঙ্গে ব্লক রেইড, চেক পোস্টে তল্লাশি অভিযান পরিচালনা করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

প্রসঙ্গত, শনিবার রাত ৯টার দিকে রাজধানীর মিরপুর রোডের সায়েন্স ল্যাব মোড়ে পুলিশকে লক্ষ্য করে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায় দুর্বৃত্তরা। ওই ঘটনায় সেখানে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশের কনস্টেবল আমিনুল ইসলাম ও মন্ত্রীর নিরাপত্তা দলের অফিসার সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) শাহাবুদ্দিন আহত হন। পরে তাদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গতকাল সন্ধ্যায় আহতদের দেখতে ঢামেক হাসপাতালে যান র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন র‌্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

সর্বশেষ খবর