মঙ্গলবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

রোহিঙ্গাদের নিয়ে ক্ষোভ-হতাশা

দুই বছরে ৪৬ খুন, অপহরণ ও মুক্তিপণের ঘটনা বেড়েছে, ক্যাম্পের ভিতরেই হাটবাজার, রোহিঙ্গা নিয়ন্ত্রণে নিরাপত্তা বেষ্টনী নির্মাণের সুপারিশ

নিজামুল হক বিপুল

রোহিঙ্গাদের নিয়ে ক্ষোভ-হতাশা

রোহিঙ্গা ক্যাম্পকে নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে নিয়ে আসা, ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করা, রোহিঙ্গাদের ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে দূরে রাখা, মোবাইল সিম জব্দ করা- এ রকম বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেছে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কাছে সম্প্রতি পাঠানো এক প্রতিবেদনে এ সুপারিশ করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নিয়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে পর্যটন কেন্দ্র কক্সবাজারের সাধারণ মানুষের মধ্যে। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ভূ-প্রকৃতিগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে দিন দিন হতাশা ও ক্ষোভের সঞ্চার হচ্ছে। প্রতিবেদনে টেকনাফ ও উখিয়ায় আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নিয়ে উঠে এসেছে আরও অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য-উপাত্ত। গত কয়েক মাসে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৪৬টি হত্যাকান্ডে র ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ স্থানীয় এক যুবলীগ নেতাকে গুলি করে হত্যা করেছে রোহিঙ্গারা। তারা বিভিন্নভাবে ইয়াবা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছে। এতে রোহিঙ্গাদের অপরাধপ্রবণতা দিন দিন আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাতের বেলা নানারকম অপরাধ কর্মকান্ডে র স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয় রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো। সুরক্ষিত সীমানাপ্রাচীর না থাকা এবং নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সিআইসির সার্বক্ষণিক ক্যাম্পে অবস্থান না করার কারণে ইয়াবা পাচার, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধ কর্মকান্ডে  জড়াচ্ছে রোহিঙ্গারা। এসব কারণে বিভিন্ন ইস্যুকে ঘিরে সন্ত্রাসী গ্রুপ তৈরি হচ্ছে ক্যাম্পগুলোয়। আবার স্থানীয়দের বাদ দিয়ে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় (এনজিও) রোহিঙ্গাদের মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে চাকরি দেওয়া হচ্ছে। এতে ক্ষুব্ধ স্থানীয় জনসাধারণ। এর বাইরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় ছোট-বড় অসংখ্য বাজারহাট গড়ে উঠেছে। এসব বাজারে নিয়মিত চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটছে এবং এসব ঘটনার সঙ্গে রোহিঙ্গারা জড়িত। কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের আশঙ্কা, রোহিঙ্গারা গত ২৫ আগস্ট সমাবেশ করে যেভাবে মানসিক ও সাংগঠনিকভাবে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে তাতে তাদের প্রত্যাবসন প্রক্রিয়া বিলম্বিত হতে পারে। কক্সবাজারের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে অন্তত ছয়টি পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা সরকারকে জানানো হয়েছে। এ ছাড়া কক্সবাজার জেলা কোর কমিটির সভায়ও এসব বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনাসাপেক্ষে অন্তত ১৫টি পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসকের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমার থেকে বলপ্রয়োগে বাস্তচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। নতুন ও পুরান মিলে বর্তমানে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের কুতুপালং রেজিস্টার্ড ক্যাম্পসহ ক্যাম্পের বাইরে কুতুপালং থেকে পালংখালী পর্যন্ত বিভিন্ন ক্যাম্পে বসবাস করছে। মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হওয়ার দুই বছর পূর্তি উপলক্ষে গত ২৫ আগস্ট ‘আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যানরাইটস’ নামের একটি সংগঠনের ব্যানারে দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের অনুমতি নিয়ে মিয়ানমারের নাগরিকত্ব লাভ ও নিষ্ঠুরতার বিচার চেয়ে মহাসমাবেশ করে রোহিঙ্গারা। তারা সমাবেশ থেকে পাঁচ দফা দাবি জানায়। প্রতিবেদনে বলা হয়, রোহিঙ্গা ক্যাম্পর অভ্যন্তরে ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি অপহরণের ঘটনা ঘটেছে এবং অপহৃতদের কয়েকজন মুক্তিপণের বিনিময়ে ছাড়া পেয়েছেন। রোহিঙ্গাদের আগমন থেকে শুরু করে গত দুই বছরে অন্তত ৪৬টি হত্যাকা  ঘটেছে, যা খুবই উদ্বেগজনক। এতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, দেশের জন্য হুমকি রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি এনজিও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিরোধিতা করছে। এসব এনজিওর ইন্ধন ও সহযোগিতায় রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে না যাওয়ার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এসব এনজিওর বিরুদ্ধে দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।

জেলা প্রশাসকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো সুরক্ষিত না হওয়ায় প্রতিনিয়ত রোহিঙ্গারা ক্যাম্প ছেড়ে বিভিন্নভাবে পালিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে চলে যাচ্ছে। এ পর্যন্ত কক্সবাজার জেলা থেকে ৫৫ হাজার ১৮৬ জন রোহিঙ্গাকে শনাক্ত করে ক্যাম্পে ফেরত পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আরও ৪ হাজার নয়জন রোহিঙ্গাকে ক্যাম্পে ফেরত আনা হয়েছে। এর বাইরে জেলা প্রশাসনের মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে ৬২৩ জন রোহিঙ্গাকে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে। তার পরও রাাতে ক্যাম্পের বাইরে রোহিঙ্গারা বিভিন্নরকম অপরাধমূলক কর্মকান্ডে  লিপ্ত হচ্ছে। তাই দ্রুততম সময়ের মধ্যে পুরো ক্যাম্প ঘিরে কাঁটাতারের বেড়া দ্বারা নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করা জরুরি।

রোহিঙ্গারা দিন দিন বিভিন্ন অপরাধ কর্মকান্ডে  জড়িয়ে পড়ায় স্থানীয় অধিবাসীদের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে তাই তারা রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার পাঠানোর দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠছে। স্থানীয় যুবসমাজ ও সচেতন নাগরিকরা ইদানীং রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সভা-সেমিনারে বক্তব্য দিচ্চেন। অদূর ভবিষ্যতে তাদের ঐক্যবদ্ধভাবে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে।

জেলা প্রশাসনের ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রায় প্রতিটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভিতরে রোহিঙ্গাদের ছোট ছোট বাজার গড়ে উঠেছে। যেখানে রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন গ্রুপ নিয়মিত চাঁদা তুলে থাকে। ক্যাম্পের ভিতরে আন্তগ্রুপ কলহের এটি অন্যতম কারণ। এ ছাড়া রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা কার্যক্রম বাস্তবায়নে দেশি-বিদেশি ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও এনজিওর ২ শতাধিক শাখা ও অফিস রয়েছে। এসব সংস্থার অফিস ও কর্মকর্তাদের বাসস্থানের জন্য আবাসিক ভবনের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ওই এলাকায় বাসা ভাড়াসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। একই সঙ্গে কৃষিজমিতেও আবাসিক ভবন নির্মাণের ফলে চাষযোগ্য জমি দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। এসব অবস্থার প্রতিকারে প্রতিবেদনে যে ৬টি সুপারিশ রয়েছে তার অন্যতম হচ্ছে ক্যাম্প এলাকার চারপাশে টেকসই সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ; ক্যাম্প এলাকার চারদিকে বর্তমান ১১টি চেকপোস্টে তল্লাশি কার্যক্রম নিশ্চিত করা; প্রতিটি ক্যাম্পে সিআইসিদের ২৪ ঘণ্টা অবস্থান নিশ্চিত করা। এ ক্ষেত্রে পুলিশ ও সশস্ত্র বাহিনী নিরাপত্তা দিতে সম্মত হয়েছে; রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করতে বিটিআরসিকে নির্দেশনা দেওয়া, ক্যাম্পে প্রত্যেক পরিবারের সদস্যের সংখ্যার ভিত্তিতে খাদ্যসহায়তা প্রদান এবং অতিরিক্ত খাদ্যসহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণারোপ।

জেলা প্রশাসকের ওই প্রতিবেদনে গত ২৬ আগস্ট অনুষ্ঠিত জেলা কোর কমিটির সভায় নেওয়া ১৫টি সিদ্ধান্তের কথাও তুলে ধরা হয়েছে।

এসব সিদ্ধান্তের মধ্যে অনত্যম হচ্ছে রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পের বাইরে চলাচল বন্ধ করা; প্রত্যাবাসন বাধাগ্রস্ত করার কাজে নিয়োজিত কিংবা আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটাতে পারে এমন এনজিও ও সংস্থা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা; রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তায় কোন কোন দ্রব্য দেওয়া প্রয়োজন নেই সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে এনজিও ব্যুরোতে চিঠি পাঠানো; রোহিঙ্গাদের আয়বর্ধক কোনো কাজে নিয়োজিত না করা ও স্থানীয় জনসাধারণের মধ্য থেকে ভলান্টিয়ার, শ্রমিক ইত্যাদি নিয়োগ করা; দেশের প্রচলিত আইন, বিধি অনুসরণ করে বাজার পরিচালনা করা; রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় মোবাইল কোর্টের অভিযান বৃদ্ধি করা; ক্যাম্প পরিচালনায় যে কোনো গাফিলতি বা শৈথিল্য পরিলক্ষিত হলে কিংবা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার প্রমাণ পাওয়া গেলে ক্যাম্প ইনচার্জের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া; ক্যাম্পের ভিতরে কোনো ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট কানেকশন না রাখা; ক্যাম্পে অনুদান হিসেবে নগদ টাকা না দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ; ক্যাম্প এলাকায় মাদক ব্যবসায় জড়িতদের তালিকা করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ; ক্যাম্পে বেনামে ও স্থানীয়দের নামে উত্তোলিত মোবাইল সিম চিহ্নিত করে সেগুলো বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়া এবং ক্যাম্পের ভিতরে ও ক্যাম্পসংলগ্ন যেসব বাজারে অবৈধ বিদেশি পণ্য কেনাবেচা হয় সেগুলো বন্ধে অভিযান পরিচালনা করা।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর