বৃহস্পতিবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

পূরণ হয়নি নিরাপদ সড়কের দাবি

সড়কে শৃঙ্খলা ফেরেনি, নৈরাজ্য ও দুর্ঘটনায় বাড়ছে প্রাণহানি

শিমুল মাহমুদ ও শামীম আহমেদ

পূরণ হয়নি নিরাপদ সড়কের দাবি

রাজধানীর বাংলামোটরে এলোমেলো হাঁটছেন পথচারীরা -রোহেত রাজীব

নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনের এক বছর পেরিয়ে গেলেও শিক্ষার্থীদের অধিকাংশ দাবি পূরণ হয়নি। শৃঙ্খলা ফিরে আসেনি সড়ক পরিবহনে। উপরন্তু সড়ক-মহাসড়কে নৈরাজ্য এবং বেপরোয়া যানবাহনের কারণে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বন্ধ হয়নি রাস্তায় ফিটনেসবিহীন গাড়ির অবাধ চলাচল এবং লাইসেন্সবিহীন-মাদকাসক্ত চালকদের দৌরাত্ম্য। নগর পরিবহনে বাসের প্রতিযোগিতা আগের মতোই অব্যাহত। তবে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সড়ক নিরাপত্তায় বেশ কিছু পদক্ষেপের ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেগুলোর কিছু বাস্তবায়ন হয়েছে আর কয়েকটির কাজ চলছে। ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই দুই বাসের রেষারেষির সময় রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে কুর্মিটোলা উড়ালসেতুর নিচে অপেক্ষারত শিক্ষার্থীদের ওপর উঠে যায় জাবালে নূর বাস। নিহত হন শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী দিয়া খানম মিম ও আবদুল করিম। আহত হন আরও ১৩ জন। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা। ঘটনার পর ৩১ জুলাই পরিবহন সংশ্লিষ্টদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার কার্যালয়ে ডেকে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি ট্রাফিক ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফেরাতে কঠোর নির্দেশনা দেন। এ সময় নিরাপদ সড়ক বাস্তবায়নে ও দুর্ঘটনা রোধে রমিজ উদ্দিন কলেজ সংলগ্ন বিমানবন্দর সড়কে আন্ডার পাস নির্মাণ, দেশের প্রতিটি স্কুল-সংলগ্ন রাস্তায় স্পিডব্রেকার বসানো এবং শুধু স্কুলের জন্য প্লাকার্ড সম্বলিত বিশেষ ট্রাফিক পুলিশ নিয়োগ দেওয়ার কথাও ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী অপ্রাপ্ত বয়স্ক ও ড্রাইভিং লাইসেন্সবিহীন অবৈধ গাড়িচালকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশকে (ডিএমপি) নির্দেশ দেন। এ সময় সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা ও দ্রুত মামলা নিষ্পত্তির বিধান রেখে বিদ্যমান আইন সংশোধন করে কঠোর ট্রাফিক আইন দ্রুত পাস করার উদ্যোগ নেয় সরকার।  এদিকে গত বছরই সংসদে সড়ক আইন-২০১৮ পাস হয়। সে আইন পাস হওয়ার পরপরই তৎকালীন মন্ত্রিসভার এক ক্ষমতাধর মন্ত্রীর সংগঠনের নেতারা এর বিরোধিতা করে আইনটি যেন বাস্তবায়ন না হয় সেজন্য দেশব্যাপী ধর্মঘট ডেকে জিম্মিদশায় ফেলে পুরো দেশবাসীকে।

অন্যদিকে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনের সময় তৎকালীন নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খানের পদত্যাগের পাশাপাশি সড়কে নিরাপত্তার জন্য সরকারের কাছে ৯টি দাবি তুলে ধরে। সেগুলো হলো- ১. বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালিয়ে দুজন শিক্ষার্থীর মৃত্যুর জন্য দায়ী চালককে মৃত্যুদ  প্রদান করতে হবে এবং এই শাস্তি সংবিধানে সংযোজন করতে হবে। ২. দুর্ঘটনার পর দেওয়া নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খানের বক্তব্য প্রত্যাহার করে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে। ৩. শিক্ষার্থীদের চলাচলে এমইএস ফুটওভার ব্রিজ বা বিকল্প নিরাপদ ব্যবস্থা নিতে হবে। ৪. প্রত্যেক সড়কের দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকায় স্পিডব্রেকার দিতে হবে। ৫. সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ছাত্রছাত্রীদের দায়ভার সরকারকে নিতে হবে। ৬. শিক্ষার্থীরা বাস থামানোর সিগন্যাল দিলে থামিয়ে তাদের বাসে তুলতে হবে। ৭. শুধু ঢাকা নয়, সারা দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ৮. ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় চলাচল বন্ধ ও লাইসেন্স ছাড়া চালকরা গাড়ি চালাতে পারবেন না। ৯. বাসে অতিরিক্ত যাত্রী নেওয়া যাবে না। শিক্ষার্থীদের এসব দাবির অধিকাংশই পূরণ হয়নি। এর মধ্যে মন্ত্রী শাজাহান খান ক্ষমা না চাইলেও দুর্ঘটনার পাঁচ মাস পর গঠিত সরকারের নতুন মন্ত্রিসভায় ঠাঁই হয়নি তার। ফিটনেসবিহীন গাড়ি নিয়েও কার্যকর কোনো অগ্রগতি নেই। গত ২২ জুলাই বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) হাই কোর্টে দেওয়া এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে ফিটনেসবিহীন বা ফিটনেস নবায়ন না করা গাড়ি রয়েছে ৪ লাখ ৭৯ হাজার ৩২০টি। পরে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্ট বেঞ্চ সড়ক দুর্ঘটনা রোধে গণপরিবহনের ফিটনেস যাচাইয়ে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে ১৫ সদস্যের কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয়। একই সঙ্গে ফিটনেসবিহীন যান চলাচল বন্ধের নির্দেশ দেয় আদালত। এর আগে গত বছর আগস্টে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে ১৭টি নির্দেশনা দেওয়া হয়। নির্দেশনার পর ঢাকার দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়রসহ সড়ক সংশ্লিষ্টরা কাজেও নামেন। তবে শেষ পর্যন্ত সেসব বাস্তবায়ন হতে দেখা যায়নি। প্রধানমন্ত্রীর ওই নির্দেশনার মধ্যে ছিল- রাজধানীর গণপরিবহন চলাকালে সবসময় দরজা বন্ধ রাখা এবং বাস স্টপেজ ছাড়া যাত্রী ওঠানামা সম্পূর্ণ বন্ধ রাখা, গণপরিবহনে (বিশেষত বাসে) দৃশ্যমান দুটি স্থানে চালক ও হেলপারের ছবিসহ নাম, চালকের লাইসেন্স নম্বর, মোবাইল ফোন নম্বর প্রদর্শন, ঢাকা শহরে রিমোট কন্ট্রোলড অটোমেটিক বৈদ্যুতিক সিগন্যালিং পদ্ধতি চালু। কিন্তু এক বছর পার হলেও রাজধানীর গণপরিবহন ব্যবস্থার চিত্র বদলায়নি। এখনো সড়কে চলে গণপরিবহনের বেপরোয়া ও ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিযোগিতা। রাস্তা আটকে যত্রতত্র গাড়ি দাঁড় করিয়ে যাত্রী তোলা।

এদিকে এ বছর গত ১৯ মার্চ প্রগতি সরণিতে জেব্রা ক্রসিংয়ে বাসচাপায় বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিউপি) শিক্ষার্থী আবরার আহমেদের মৃত্যুর ঘটনায় ফের আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে বেশ কিছু দাবি তুলে ধরে। ঢাকা উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম এবং ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া তাদের বুঝিয়ে আন্দোলন স্থগিত করান। শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দেন মেয়র। শিক্ষার্থীদের দাবির মধ্যে ছিল ১০ দিনের মধ্যে আবরার হত্যার জন্য দায়ী সুপ্রভাত বাসের চালক, হেলপার ও মালিকের ফাঁসি, সুপ্রভাত ও জাবালে নূরসহ দুর্ঘটনা ঘটানো বাস কোম্পানীর রুট পারমিট বাতিল, চালক-হেলপারের ডোপ টেস্ট, বাসসহ গণপরিবহনের চালক-হেলপারের আইডি কার্ড প্রদর্শন করা, জেব্রা ক্রসিং, আন্ডারপাস নির্মাণসহ নিহত আবরারের নামে ফুটওভার ব্রিজ করা, জেব্রা ক্রসিংয়ের সামনে ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা স্থাপন ইত্যাদি। শিক্ষার্থীদের অধিকাংশ দাবিই বাস্তবায়ন হয়নি। শুধু অভিযুক্ত সুপ্রভাত স্পেশাল পরিবহনের বাস বন্ধ করা হয়। চালককে গ্রেফতার করা হয় এবং দুর্ঘটনাস্থলে একটি ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করা হয়। শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে তখন রাজধানীর বিভিন্ন সিগনালে জেব্রা ক্রসিং দেওয়া হলেও সেখানে দাঁড়ায় না গাড়ি। পুলিশের সামনেই জেব্রা ক্রসিং দখল করে দাঁড়িয়ে থাকে যানবাহন। আর জাবালে নূর ও সুপ্রভাতের বাস নাম বদল করে দিব্যি চলাচল করছে রাজধানীতে।

এ ব্যাপারে পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ড. এস এম সালেহ উদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী যে নির্দেশনাগুলো দিয়েছিলেন সেগুলো বাস্তবায়ন হলে সড়কের বিশৃঙ্খলা অনেকটাই কমে যেত। নির্দেশনাগুলো অত্যন্ত বাস্তবসম্মত। দুর্ভাগ্য, এগুলো বাস্তবায়নের দায়িত্বে যারা তারা ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। অধিকাংশ দুর্ঘটনার পর দেখা যায় চালক মূলত ওই গাড়ির হেলপার। এটা বন্ধ করা জরুরি। আমাদের চালক সংকট আছে। অধিকাংশই দিনে ১৪-১৫ ঘণ্টা বিরামহীন গাড়ি চালান। তারা ক্লান্ত থাকেন। এ জন্য দুর্ঘটনা ঘটে। বিআরটিএ এবং বেসরকারি গণপরিবহন কোম্পানিগুলোর উচিত প্রশিক্ষণ দিয়ে আরও দক্ষ চালক তৈরি করা। একই সঙ্গে জনসচেতনতাও জরুরি। ঢাকায় অনেক ফুটওভার ব্রিজ ও জেব্রা ক্রসিং থাকার পরও পথচারীরা সেগুলো দিয়ে রাস্তা পার হয় না। জেব্রা ক্রসিংয়ে চালক গাড়ির গতি কমায় না। আইন অমান্য করলে চালক ও পথচারী উভয়ের জরিমানা করতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর