শুক্রবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

ভেঙেই গেল জাতীয় পার্টি

রওশনকে চেয়ারম্যান ঘোষণা আনিসের । কাদের বললেন, এখতিয়ার নেই, ব্যবস্থা নেব

শফিকুল ইসলাম সোহাগ

ভেঙেই গেল জাতীয় পার্টি

সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের (বামে) ও বেগম রওশন এরশাদ (ডানে) -বাংলাদেশ প্রতিদিন

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর দেড় মাসের মাথায় ভেঙে গেল জাতীয় পার্টি। সর্বশেষ গতকাল জাতীয় পার্টির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান বেগম রওশন এরশাদকে দলের চেয়ারম্যান ঘোষণা করে দলের একটি অংশ। দুপুর ১২টার দিকে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ রওশন এরশাদের গুলশানের বাসভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেন। এ সময় ব্যারিস্টার আনিসের পাশে রওশন এরশাদ বসা ছিলেন। আনিসুল ইসলাম মাহমুদের ঘোষণায় রাঙ্গাকে মহাসচিব রাখার কথা বলা হয়। দুই অংশেই মহাসচিব থাকা মসিউর রহমান রাঙ্গাকে অবশ্য গতকাল রওশন এরশাদের বাসায় কিংবা বনানী পার্টি অফিসে দেখা যায়নি।

এর আগে এরশাদের মৃত্যুর পর গত ১৮ জুলাই জি এম কাদেরকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান করা হয়। মসিউর রহমান রাঙ্গা এ ঘোষণা দেন। অবশ্য এরশাদ জীবিত থাকাকালীন তিনি নিজেই সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘আমার অবর্তমানে পার্টির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করবেন জি এম কাদের।’ 

তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের সাংবাদিকদের বলেন, ‘ব্যারিস্টার আনিসের এমন ঘোষণা দেওয়ার এখতিয়ার নেই। দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

আনিসুল ইসলাম মাহমুদের সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে রওশন এরশাদ বলেন, ‘পার্টিতে কী হচ্ছে? জাপা অতীতেও ভাগ হয়েছে, এবারও কি সেটি হচ্ছে নাকি? হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এত কষ্ট করে পার্টি গড়ে তুলেছেন, এখন সেই পার্টিটা ভালোভাবে চলুক, মান-অভিমান ভুলে যারা চলে গেছেন, তারা ফিরে আসুক। আমি চাই পার্টির সবাই মিলেমিশে জনগণের সেবা করবেন।’

ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, রওশন এরশাদ পার্টির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করবেন। আগামী ছয় মাসের মধ্যে কাউন্সিল করে গণতান্ত্রিক উপায়ে স্থায়ী চেয়ারম্যান ঠিক করব। তিনি অভিযোগ করেন, জি এম কাদের জাতীয় পার্টির ‘গঠনতন্ত্র ভেঙে’ চেয়ারম্যান হয়েছেন। যে প্রক্রিয়ায় তিনি নিজেকে পার্টির চেয়ারম্যান দাবি করেছেন তাতে গলদ রয়েছে। তবে জি এম কাদেরকে কো- চেয়ারম্যানের সম্মান দেবেন রওশন এরশাদ। তিনি বলেন, জি এম কাদের পার্লামেন্টারি বোর্ড গঠনে গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন করেছেন। এতে স্পষ্ট বলা আছে,  চেয়ারম্যান, মহাসচিবের বাইরে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে ৭ সদস্য থাকবে। তিনি যা করেছেন, সবই অবৈধ। এরশাদের অসুস্থতা ও মৃত্যুর কারণে আমরা এ নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করিনি।

প্রসঙ্গত, গত সপ্তাহে জি এম কাদের দলের পার্লামেন্টারি বোর্ড গঠন করেন। এতে দলে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে।  

সংবাদ সম্মেলনে বেগম রওশন এরশাদ ও ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ছাড়াও সংসদ সদস্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন মজিবুল হক চুন্নু, ফখরুল ইমাম, সেলিম ওসমান, লিয়াকত হোসেন খোকা ও গোলাম কিবরিয়া টিপু। প্রেসিডিয়াম সদস্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন মাসুদ পারভেজ সোহেল রানা, ফয়সল চিশতী, মীর আবদুস সবুর আসুদ, খালেদ আখতার ও শফিকুল ইসলাম সেন্টু। শফিকুল ইসলাম সেন্টু মিছিল নিয়ে এতে অংশ নেন। সাংবাদিক সম্মেলন চলাকালেই এক পক্ষ রওশনের পক্ষে স্লোগান দেয়। এ সময় ছাত্র সমাজের নেতা-কর্মীরাও দল না ভাঙার পক্ষে স্লোগান দেন রওশনের বাসার সামনে।

সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে : রওশন এরশাদের সংবাদ সম্মেলন শেষে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের প্রতিক্রিয়া জানতে বনানীর কার্যালয়ে গেলে গণমাধ্যম কর্মীদের তিনি বলেন, দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তাকে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দিয়ে গেছেন। দলের প্রেসিডিয়াম সভাও এতে সমর্থন দিয়েছে। জি এম কাদের বলেন, এরশাদ পত্নী রওশনকে তিনি ‘মায়ের মতো’ সম্মান করেন। রওশন এরশাদ নিজ মুখে তো আর বলেননি তিনি চেয়ারম্যান। আশা করি, তিনি এমন কিছু করবেন না, যাতে তার সম্মান নষ্ট হয়। তার (রওশন এরশাদ) কতটুকু সমর্থন রয়েছে তা ভবিষ্যতে দেখা যাবে।

দল ভাঙনের মুখে পড়েনি দাবি করে জি এম কাদের বলেন, কেউ নিজেকে রাজা ঘোষণা করলেই হয় না, তার রাজ্য, প্রজা সমর্থন থাকতে হয়। এরশাদের মৃত্যুতে তিনটি বিষয়ে শূন্যতা তৈরি হয়। এক পার্টির চেয়ারম্যান পদ, পার্লামেন্টারি পার্টির নেতা ও তার মৃত্যুতে শূন্য হওয়া রংপুর আসন। গঠনতন্ত্র মোতাবেক পার্লামেন্টারি পার্টির নেতা হবেন পার্টির চেয়ারম্যান। পার্টির প্রেসিডিয়ামের বৈঠকে সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে স্পিকারকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এখন বিষয়টি স্পিকার নির্ধারণ করবেন। চেয়ারম্যান আমি কিনা প্রশ্ন উঠেছে। গঠনতন্ত্রের ২০ এর ক ধারায় স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে, পার্টির চেয়ারম্যান যাকে খুশি যে কোনো পদে নিয়োগ, বহিষ্কার কিংবা স্থলাভিষিক্ত করতে পারবেন। এটা আমরা মনে করছি, আমাকে এরশাদের স্থলাভিষিক্ত করেছেন। তিনি মৃত্যুর আগে সাংগঠনিক আদেশে আমাকে চেয়ারম্যান করে গেছেন। তার মৃত্যুর পর পার্টির প্রেসিডিয়ামের সভায় আমাকে চেয়ারম্যান হিসেবে ধন্যবাদ গৃহীত হয়েছে। এখন কেউ যদি আমাকে চেয়ারম্যান না মানেন, সেটা তার বিষয়। এ সময় পাশে বসা জিয়াউদ্দিন আহম্মেদ বাবলু বলেন, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী জি এম কাদের পার্টির চেয়ারম্যান। তিনি এর পক্ষে নানা যুক্তি তুলে ধরেন। জি এম কাদেরের সঙ্গে সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, সালমা ইসলাম, গোলাম কিবরিয়া টিপু, নাজমা আকতার, এস এম ফখর-উজ-জামান জাহাঙ্গীর, মোস্তাফিজার রহমান মোস্তাফা, রানা মোহাম্মদ সোহেল, রংপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা, সুনীল শুভ রায়, কাজী মামুনুর রশীদ, আলমগীর সিকদার লোটন, হাসিবুল ইসলাম জয়, এনাম জয়নাল আবেদীনসহ বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। সংবাদ সম্মেলন চলাকালে ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদের বিরুদ্ধে নানা স্লোগান দেন নেতা-কর্মীরা। পরে পার্টি অফিসের সামনেও তারা বিক্ষোভ মিছিল বের করেন।

পার্লামেন্টারি বোর্ডও গঠন করলেন রওশন : গতকাল রওশন এরশাদ জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে পার্টির পার্লামেন্টারি বোর্ড গঠন করেন। এ ছাড়াও নিজেকে চেয়ারম্যান দাবি করে স্পিকারের কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন। চিঠিতে উল্লেখ করেছেন, রওশন এরশাদ ছাড়া অন্য কাউকে যেন চেয়ারম্যান হিসেবে গণ্য করা না হয়। রংপুর-৩ আসনে নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ের জন্য রওশন এরশাদকে আহ্বায়ক, দলের মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গাকে সদস্য সচিব করা হয়। 

পার্লামেন্টারি বোর্ডে আছেন দলের কো-চেয়ারম্যান জি এম কাদের এমপি, ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এমপি, সাবেক মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার, মুজিবুল হক চুন্নু এমপি, কাজী ফিরোজ রশীদ এমপি, দেলোয়ার হোসেন খান, গোলাম কিবরিয়া টিপু, ফখরুল ইমাম এমপি, সুনীল শুভ রায়, আতিকুর রহমান আতিক, মজিবুর রহমান সেন্টু। এ ব্যাপারে সুনীল শুভ রায় বলেন, আমার নাম দেওয়ার আগে অনুমতি নেওয়া হয়নি।

জাতীয় পার্টির যত ভাঙন : প্রথম দফায় জাতীয় পার্টি ভাঙনের কবলে পড়ে মিজানুর রহমান চৌধুরী ও আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বে। দ্বিতীয় দফায় ভাঙনের শিকার হয় নাজিউর রহমানের নেতৃত্বে। প্রয়াত কাজী জাফর আহমদের হাত ধরে ভাঙনের শিকার হয়েছে। এরশাদের জীবদ্দশায় জাতীয় পার্টি তিন দফায় ভেঙেছে। তার মৃত্যুর দুই মাস পূর্ণ হওয়ার আগেই আরেকবার ভাঙনের মুখে পড়ল দলটি। তিনটি দলই লাঙল প্রতীক ব্যবহার করছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর