রবিবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতিতে সাফল্য চ্যালেঞ্জ

গোলাম রাব্বানী ও জয়শ্রী ভাদুড়ী

প্রাতিষ্ঠানিক অনিয়ম-দুর্নীতিতে সরকারের সাফল্য চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।  এরই মধ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বেশ কয়েকটি আলোচিত দুর্নীতির ঘটনায় নানা প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বালিশ কান্ডের পর স্বাস্থ্য অধিদফতরে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা দামের বই ৮৫ হাজার ৫০০ টাকায় কেনা হয়েছে। পুকুর খনন শিখতে বিদেশ যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। সম্প্রতি পর্দার দাম সাড়ে ৩৭ লাখ টাকা, ওয়াসার ৩৮০০ কোটি টাকার প্রকল্পের পাইপ কেলেঙ্কারি এবং সরকারিভাবে কেনা চালে জীবন্ত-মৃত কীট পাওয়া নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে জনমনে।

৫ হাজার ৫০০ টাকার বই ৮৫ হাজার ৫০০ টাকা : সরকারি বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ শিক্ষার্থীদের জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রায় সাত কোটি টাকার বই কেনা নিয়ে হরিলুটের অভিযোগ উঠেছে। বাজার মূল্যে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা দামের একটি বই স্বাস্থ্য অধিদফতর কিনেছে ৮৫ হাজার ৫০০ টাকায়। জানা গেছে, সার্জারির শিক্ষার্থীদের ‘প্রিন্সিপাল অ্যান্ড প্র্যাকটিস অব সার্জারি’ বইটি গোপালগঞ্জের শেখ সায়েরা খাতুন মেডিকেল কলেজের জন্য ১০ কপি কিনেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। বইটির বাজারমূল্য সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা হলেও স্বাস্থ্য অধিদফতর প্রতিটি বই কিনেছে ৮৫ হাজার ৫০০ টাকায়। ১০ কপি বইয়ের দাম পরিশোধ করা হয়েছে ৮ লাখ ৫৫ হাজার টাকা। গত ১৯ জুন টেন্ডার দুটির কার্যাদেশ পেয়েছে হাক্কানী পাবলিশার্স। তারাই বাজার থেকে বইগুলো কিনে স্বাস্থ্য অধিদফতরকে সরবরাহ করেছে।

পুকুর খনন শিখতে বিদেশ সফর : বরেন্দ্র অঞ্চলের পুকুরগুলো অনেক আগে থেকেই স্থানীয় লোকজন সেচের কাজে ব্যবহার করতেন। সেগুলো পুনঃখনন করা হবে। এসব পুকুরের পানি আবার সেচের কাজে ব্যবহার করা হবে। এ জন্য বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) ‘পুকুর পুনঃখনন ও ভূ-উপরিস্থ পানি উন্নয়নের মাধ্যমে ক্ষুদ্র সেচে ব্যবহার’ শীর্ষক একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এ কাজে দক্ষতা লাভের জন্য এই প্রকল্পের ১৬ জন কর্মকর্তা বিদেশ সফর করবেন। এ জন্য ব্যয় হবে ১ কোটি ২৮ লাখ টাকা। ২৭ আগস্ট একনেক সভায় প্রকল্পটি অনুমোদন করা হয়। প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। প্রকল্পের ১৬ কর্মকর্তা অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, নেদারল্যান্ডসসহ যে কোনো একটি দেশ সফর করবেন।

এক পর্দার দাম সাড়ে ৩৭ লাখ টাকা : ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আইসিইউতে ব্যবহৃত একটি পর্দার দাম ধরা হয়েছে ৩৭ লাখ টাকা। দুর্নীতির অভিযোগে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স অনিক ট্রেডার্সের প্রায় ১০ কোটি টাকার বিল বছরখানেক আগে আটকে দিয়েছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। পরে বিল পরিশোধের আবেদন জানিয়ে ২০১৭ সালের ১ জুন রিট করে প্রতিষ্ঠানটি।

জানা যায়, হাসপাতালটির ১১ কোটি ৫৩ লাখ ৪৬৫ টাকার মেডিকেল যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম কেনাকাটায় বিল দেখানো হয়েছে ৫২ কোটি ৬৬ লাখ ৭১ হাজার ২০০ টাকা। এই একটি কেনাকাটাতেই মেসার্স অনিক ট্রেডার্স বাড়তি বিল দেখিয়েছে ৪১ কোটি ১৩ লাখ ৭০ হাজার ৭৩৭ টাকা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আইসিইউতে ব্যবহৃত একটি পর্দার দাম ৩৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা ছাড়াও একটি অক্সিজেন জেনারেটিং প্ল্যান্ট কেনার খরচ দেখানো হয়েছে ৫ কোটি ২৭ লাখ টাকা। একটি ভ্যাকুয়াম প্ল্যান্ট ৮৭ লাখ ৫০ হাজার, একটি বিএইইস মনিটরিং প্ল্যান্ট ২৩ লাখ ৭৫ হাজার, তিনটি ডিজিটাল ব্লাড প্রেসার মেশিন ৩০ লাখ ৭৫ হাজার, আর একটি হেডকার্ডিয়াক স্টেথোসকোপের দাম ১ লাখ ১২ হাজার টাকা। এমন অবিশ্বাস্য দামে ১৬৬টি যন্ত্র ও সরঞ্জাম কিনেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

লুটপাটে ডুবল ওয়াসার ৩৮০০ কোটি টাকার প্রকল্প : মুন্সীগঞ্জের যশলদিয়া থেকে পদ্মার পানি পরিশোধন করে ঢাকায় সরবরাহের প্রকল্প শেষ হয়েছে আট মাস আগে। কিন্তু এখনো তা চালু হয়নি। সম্প্রতি পরীক্ষামূলকভাবে একবার চালু করা হলেও পাঁচ মিনিটেই পানির পাইপ ফেটে ভেস্তে গেছে পুরো প্রকল্প। কম পুরুত্বের নিম্নমানের পাইপ ব্যবহারে এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ব্যবহৃত পাইপ বুয়েটে পরীক্ষা করা হয়নি। এভাবেই লুটপাট এবং অনিয়মে ডুবতে বসেছে ওয়াসার ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকার এই প্রকল্প। এ ছাড়া নিম্নমানের বলে অভিযুক্ত এই ‘কে৯’ পাইপ সরবরাহ না করতে ঠিকাদারকে চিঠি দেওয়ায় সরিয়ে দেওয়া হয় প্রকল্প পরিচালককে।

চালে দুর্গন্ধ, জীবন্ত-মৃত কীট-পতঙ্গ : খাদ্য অধিদফতরের মাঠ পর্যায়ের চাল কেনাকাটায় ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। নিম্নমানের দুর্গন্ধযুক্ত চাল কেনা হচ্ছে। এ ছাড়া প্রায় অর্ধশত এলএসডির (স্থানীয় সরবরাহ কেন্দ্র) চালের মান নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। গুদামে সংরক্ষিত পুরনো চালের সঙ্গে নতুন কেনা চালে পাওয়া যাচ্ছে জীবন্ত-মৃত কীট-পতঙ্গ। সেই সঙ্গে চালের ওজন নিয়ে কারসাজি, বিলের টাকা আত্মসাৎ, বিল পরিশোধে অনিয়ম এবং গুদামে অবৈধভাবে চাল আটকে রাখারও অভিযোগ আছে এলএসডি গুদাম কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক ঢাকা, বরিশাল, খুলনা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও সিলেটের গুদাম পরিদর্শন প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

বালিশ কাণ্ড  : রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের থাকার জন্য নির্মিত গ্রিনসিটিতে আসবাবপত্র ও অন্যান্য জিনিসপত্র ক্রয়ে লাগামছাড়া দুর্নীতি হয়েছে। দেখা যায়, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের থাকার জন্য নির্মিত ভবনের ফ্ল্যাটগুলোর জন্য ১ হাজার ৩২০টি বালিশ কেনা হয়েছে। একটি বালিশের পেছনে ব্যয় দেখানো হয়েছে ৬ হাজার ৭১৭ টাকা। এর মধ্যে দাম বাবদ ৫ হাজার ৯৫৭ টাকা আর সেই বালিশ নিচ থেকে ফ্ল্যাটে উঠাতে খরচ ৭৬০ টাকা উল্লেখ করা হয়েছে।

সর্বশেষ খবর