সোমবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

বিদেশে মিশনগুলোর কী কাজ

ব্র্যান্ডিংয়ের নামে নামসর্বস্ব রোডশো বা আলোচনা, কমার্শিয়াল উইংয়ের ব্যর্থতা বিশ্ব মিডিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন, লেবার উইংয়ের সেবা পান না প্রবাসী শ্রমিকরা

জুলকার নাইন

নতুন বিনিয়োগ, বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও শ্রমবাজার তৈরি, বিদেশে আপদে-বিপদে বাংলাদেশিদের পাশে দাঁড়ানো, সর্বোপরি দেশের সুনাম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারছে না কূটনৈতিক মিশনগুলো। শুধু নামসর্বস্ব রোডশো বা আলোচনা অনুষ্ঠানের বাইরে সত্যিকার ‘বাংলাদেশ ব্র্যান্ডিং’-এ প্রায় ব্যর্থ পেশাদার কূটনীতিকরা। বিদেশবিভুঁইয়ে খেটে-খাওয়া মানুষগুলো নিজ দেশের দূতাবাসে গিয়ে প্রায়ই শিকার হচ্ছেন ভোগান্তি-দুর্ব্যবহারের। কিন্তু বিশ্বের অন্য দেশের প্রবাসীদের জন্য দূতাবাস তাদের বন্ধু। এমন পরিস্থিতিতে কূটনৈতিক মিশনগুলোর কার্যকারিতা নিয়েই উঠেছে প্রশ্ন।

ইউরোপের দেশ স্পেনে প্রায় এক যুগের বেশি সময় ধরে থাকেন জমির সরকার। সেখানে তার বসবাসের জন্য স্থায়ী রেসিডেন্স কার্ড রয়েছে। কয়েক দফায় তা নবায়নও হয়েছে। কিন্তু এবার তিনি পড়েছেন মহাসমুদ্রে। আটকে গেছে কার্ড নবায়ন। কারণ ফিঙ্গার প্রিন্ট জটিলতায় আটকে আছে তার পাসপোর্ট। দূতাবাস থেকে পাসপোর্ট না পাওয়ায় চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন জমিরের মতো স্পেনের শতাধিক প্রবাসী। তাদের রেসিডেন্স কার্ড বাতিল হয়ে যায় কিনা তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় তারা। ওমান প্রবাসী সাইফুল ইসলাম বলেন, অন্য দেশের লোকেরা যখন দেখে বাংলাদেশিরা নিজ দেশের দূতাবাসেই সম্মান পায় না, তখন সে দেশের মানুষজনও আমাদের কর্মীদের অসম্মান করে। আমরা যদি নিজের দেশের লোককে মর্যাদা না দিই, তাহলে অন্য দেশও দেবে না। আমাদের অর্থনীতিতে যারা এত অবদান রাখছে, তাদের সম্মান দেওয়াটা জরুরি। মালয়েশিয়া প্রবাসী সিকান্দার আবু জাফর বলেন, বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমিকদের বেশিরভাগই স্বল্পশিক্ষিত। তাই তারা যখন নিজেদের পাসপোর্ট বা অন্যান্য সেবা নিতে যান তখন তাদের সহজ ভাষায় বুঝিয়ে বলা প্রয়োজন। কিন্তু দূতাবাসের কর্মকর্তাদের দেখাই পাওয়া যায় না। দেখা পেলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কর্মকর্তারা ভালো ব্যবহার করেন না। প্রবাসীদের অভিযোগ, কথায় কথায় বলা হয়, প্রবাসীরা দেশের অর্থনীতি সচল রাখছে। কিন্তু বাস্তবে প্রবাসীরা কোথাও তেমন মর্যাদা পান না। কর্মীদের বিদেশ যাওয়ার পথে ভোগান্তি, সেখানে যতদিন থাকে তখন ভোগান্তি, ফেরার পরও ভোগান্তি। তবে সবচেয়ে কষ্টের বিষয় বেশিরভাগ সময় দূতাবাসে সাহায্যের জন্য গেলে সেখানে পদে পদে ভোগান্তি, অসম্মান ও অবহেলা করা হয়। শ্রমঘন দেশগুলোতে থাকা প্রবাসীদের সাধারণ অভিযোগ, দূতাবাসের নিম্নপদস্থ কর্মচারী ও সাধারণ কর্মকর্তাদের সঙ্গে দালালদের যোগসাজশে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দুর্নীতি হয়। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে টাকা দিলে সহজেই কাজ হয়, না হলে বছরের পর বছর ঘুরতে হয়। অথচ এসব অভিযোগ দেওয়ার জন্য খুঁজলেও পদস্থ কূটনীতিকদের সঙ্গে দেখা করারই সুযোগ হয় না সাধারণ প্রবাসীদের। দূতাবাসে জনবল নিয়োগে যে মন্ত্রণালয়গুলো কাজ করছে তাদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব, সেইসঙ্গে দূতাবাসের কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ না থাকায় যথাযথ সেবা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না বলে মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন কবির। তিনি বলেন, এক্ষেত্রে দুটি বিষয়ে নজর দেওয়া প্রয়োজন। প্রথমত, যে মন্ত্রণালয়গুলো এই দূতাবাসগুলোয় লোক পাঠায়, ঢাকায় তাদের মধ্যে একটা সমন্বয় করা। বাংলাদেশে এই সমন্বয়ের যথেষ্ট অভাব আছে। দ্বিতীয়ত, যারা দূতাবাসে কাজ করতে যাবেন, তাদের জন্য যথোপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। যেন তারা নতুন দেশে, নতুন পরিবেশ, সংস্কৃতি, প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও কাজের ধরনের সঙ্গে সহজেই খাপ খাইয়ে নিতে পারেন। যারা এই প্রশিক্ষণে উত্তীর্ণ হবেন, শুধু তাদেরকেই মিশনে পাঠানো প্রয়োজন। না হলে একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে বলে তিনি আশঙ্কা করেন।

লেবার উইংয়ে যেতে চায় না ৭৪ শতাংশ শ্রমিক : দূতাবাসে প্রয়োজনীয় সেবা না পাওয়ার অভিযোগ নতুন নয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত বাংলাদেশি অভিবাসীদের কাক্সিক্ষত সেবা দিতে পারছে না বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম উইংগুলো। অবশ্য অনেক ক্ষেত্রে এখন দূতাবাসমুখীই হন না প্রবাসীরা। আইএলওর ‘দ্য হোমকামিং : প্রোফাইলিং দ্য রিটার্নিং মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কার্স অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিদেশে অবস্থান করা প্রবাসী বাংলাদেশির মধ্যে ৭৪ দশমিক ৫ শতাংশই কোনো সমস্যায় পড়লে স্থানীয় দূতাবাসের সহায়তা নেন না। প্রবাসী খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্বের ২৫টি দেশে বাংলাদেশের ২৯টি শ্রম উইং রয়েছে। তবে এসব শ্রম উইংয়ে পর্যাপ্ত জনবল না থাকায় প্রবাসী বাংলাদেশিরা প্রত্যাশিত সেবা পাচ্ছেন না। ফলে নানাভাবে তারা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। সৌদি আরব প্রবাসী ব্যবসায়ী রাহাত আহমেদ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে নিজের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে বলেন, দূতাবাসে সাধারণ কর্মীদের সাক্ষাৎ পাওয়াটাই দুষ্কর। আর মিশনের দায়িত্বে থাকা কূটনীতিকরা সাধারণ প্রবাসীদের কাছে রীতিমতো আকাশের চাঁদ। হাতে গোনা জাতীয় কয়েকটি অনুষ্ঠানে শুধু বক্তব্য দেওয়ার সময়ই তাদের দেখতে পাওয়া যায়। তাও আমন্ত্রিত প্রবাসীরাই সেই সুযোগ পান।

ব্যর্থতা বাণিজ্যিক উইংয়ের : বাংলাদেশ থেকে সাধারণত ৫৭টি দেশে পণ্য ও সেবা রপ্তানি হয়ে থাকে। এসব দেশে রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হলে অর্জিত হয় রপ্তানির সামগ্রিক লক্ষ্যমাত্রা। বিদেশে বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনগুলোতে আবার গুরুত্ব বুঝে বেশ কয়েকটি বাণিজ্যিক উইং রয়েছে। এসব উইংয়ের কাজই হলো সংশ্লিষ্ট দেশে বাংলাদেশের বাণিজ্য সম্প্রসারণে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করা। কিন্তু বেশিরভাগ উইং কাজটি সঠিকভাবে করতে পারছে না। বাণিজ্যিক মিশনগুলোর এই ব্যর্থতা নতুন নয়। গত অর্থবছরে ৫৭ গন্তব্যের ২৫টিতেই অর্জিত হয়নি লক্ষ্যমাত্রা। তবে বাকি ৩২টি গন্তব্যে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করেছে। এর মধ্যে ১২টি মিশনে ভালো প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। মিশনগুলো হচ্ছে বার্লিন, টোকিও, সিঙ্গাপুর, কুয়ালালামপুর, প্যারিস, মস্কো, ম্যানিলা, জাকার্তা, স্টোকহোম, রাবাত, কাঠমান্ডু ও কলম্বো। বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হালনাগাদ তথ্যে এসব জানা গেছে।

বিচ্ছিন্ন প্রেস উইং : বিশ্ব মিডিয়ায় বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বাড়ানোর উদ্দেশ্যে বিশ্বের ৮ গুরুত্বপূর্ণ দেশে বাংলাদেশ মিশনে প্রেস উইং রাখা হলেও সেই বিশ্ব মিডিয়া থেকেই প্রায় বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছে উইংগুলো। বিদেশি মূলধারার কোনো সাংবাদিক যদি কিছু জানতে চান তিনি প্রথমেই গুগলে সার্চ দিয়ে বাংলাদেশ হাইকমিশন বা দূতাবাসের ওয়েবসাইটে যাবেন। ফলো করবেন বাংলাদেশ দূতাবাস বা মিশনের টুইটার। কিন্তু সেভাবে এগুলোর কোনোটাই নেই, থাকলেও তা আপডেট নয়। আবার বাংলাদেশ নিয়ে মার্কিন বা ব্রিটিশ গণমাধ্যমের খবরের সেই একই ধরনের নেতিবাচক ধারা চলছে বছরের পর বছর। যুগের পর যুগ প্রেস উইং থাকলেও নানা কারণে এই ধারার পরিবর্তন সম্ভব হয়নি।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর