সোমবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

৫৬ সেবা সংস্থায় জিম্মি সিটি করপোরেশন

সমন্বয়হীনতায় বাড়ছে অর্থের অপচয়

গোলাম রাব্বানী ও জয়শ্রী ভাদুড়ী

রাজধানীতে সেবা সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। সিটি করপোরেশন নতুন রাস্তা, ফুটপাথ তৈরির পরের মাসেই কেটে সুয়ারেজ লাইন বসাচ্ছে ওয়াসা। কখনো রাস্তা খুঁড়ে বিটিসিএল নিয়ে যাচ্ছে টেলিফোনের লাইন। সেবা সংস্থাগুলোর এই সমন্বয়হীনতা বিষয়ে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন মেয়রকে অভিযোগ দিলেও মেলেনি সমাধান। কার্যত ৫৬ সেবা সংস্থার কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে সিটি করপোরেশন। নাগরিক সেবা বাড়াতে সব সংস্থার মধ্যে সমন্বয় ঘটানোর জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকেও একটি পরিপত্র জারি করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও কাজ হচ্ছে না। এ অবস্থায় গত বছর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র সাঈদ খোকন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব বরাবর একটি অভিযোগপত্র দেন। এ ব্যাপারে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হওয়ায় নাগরিক সেবা নিশ্চিত করা এবং জবাবদিহিতা করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু অন্য সেবা সংস্থাগুলোর সে দায়বদ্ধতা নেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘সেবা সংস্থাগুলো সিটি করপোরেশনের আওতাধীন নয়। এ জন্য তারা মেয়রের নির্দেশনা মানতে বাধ্য নয়। রাজধানীর ভিতরে প্রত্যেকের প্রকল্প এবং বরাদ্দ আলাদা। এই সমন্বয় করাটাই আমাদের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ।’ সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, স্থানীয় সরকার-স্বরাষ্ট্র-রেল-বিদ্যুৎ ও জ্বালানি-গণপূর্ত-সড়ক ও যোগাযোগ এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় রাজধানীর উন্নয়নে প্রত্যক্ষভাবে কাজ করে। এ ছাড়া অর্থ এবং পরিকল্পনাসহ আরও কয়েকটি মন্ত্রণালয় পরোক্ষভাবে ঢাকার উন্নয়নের অংশীদার। এসব মন্ত্রণালয়ের অধীনে ২৬টি সেবাদানকারী সরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এগুলো হলো-  ঢাকা ওয়াসা, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ, তিতাস গ্যাস, ডিপিডিসি, ডেসকো, বিটিসিএল, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসন, বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি), র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব), বাংলাদেশ রেলওয়ে, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর, স্বাস্থ্য অধিদফতর, সমাজসেবা অধিদফতর, পরিবেশ অধিদফতর, এনজিও ব্যুরো, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি), তথ্য অধিদফতর, বিআরটিসি, সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ। এ ছাড়া ঢাকার উন্নয়নে কাজ করছে বিশ্বব্যাংক, জাপানি সাহায্য সংস্থা (জাইকা)-সহ সেবাদানকারী বেশ কিছু দেশি-বিদেশি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান। সব মিলিয়ে রাজধানীতে মোট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৫৬টি। এক সিটি করপোরেশনকে ভেঙে দুটি করার পাশাপাশি এর আয়তনও বাড়ানো হয়েছে। এর পরেও কাজে গতি আসছে না। সেবার মান বাড়ছে না। সেবা প্রদানকারী সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে সেবাদানে সরাসরি জড়িত এমন ২৬টি সংস্থার সমন্বয়হীনতার কারণে নগরবাসী তাদের কাক্সিক্ষত সেবা পাচ্ছেন না। এ অবস্থায়ই সেবা সংস্থাগুলোকে একই ছাতার নিচে আনতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পরিপত্র জারি করা হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১৭ সালের ২৭ জুন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক (প্রশাসন) ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ুন কবীর স্বাক্ষরিত ওই পরিপত্র জারি করা হয়। এতে বলা হয়, ‘সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত সেবা প্রদানকারী সংস্থা ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সরকারি দফতরের প্রধানরা সিটি করপোরেশনের আমন্ত্রণে সভায় যোগদান করবেন। সভার গৃহীত সংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন এবং বাস্তবায়নের অগ্রগতি সিটি করপোরেশনকে অবহিত করবেন।’ কিন্তু এসব কিছুই মানছে না সেবা সংস্থাগুলো। এ অবস্থায় সংস্থাগুলোর সমন্বয়কারী প্রতিষ্ঠান ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন বিষয়টি অবহিত করে গত বছরের ৫ মে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব বরাবরে চিঠি দিয়েছেন। ডিএসসিসি মেয়র চিঠিতে অভিযোগ করেন, ‘ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন আয়োজিত সেবা প্রদানকারী সরকারি দফতরগুলোর সমন্বয় সভায় বেশির ভাগ দফতরের প্রধানরা উপস্থিত থাকছেন না। তাদের প্রতিনিধি হিসেবে সভায় এমন সব কর্মকর্তাকে পাঠাচ্ছেন, যাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা মতামত দেওয়ার এখতিয়ার নেই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমন কর্মকর্তারা আলোচনায় অংশ নিতেও পারেন না। এ পর্যন্ত দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আহ্বানে যতগুলো সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে, তার প্রতিটিতেই অনুরূপ ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। সরকারের আদেশ অমান্য করে দফতর প্রধানরা সভায় অনুপস্থিত থাকার কারণে প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয় যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থায় সমন্বয় সভায় সেবা প্রদানকারী বিভিন্ন দফতর প্রধানদের অনুপস্থিতির বিষয়টি অবহিত করে এ বিষয়ে পরবর্তী নির্দেশনা প্রদানের জন্য আপনার ব্যক্তিগত সুদৃষ্টি কামনা করছি।’ কিন্তু এর পরেও সমস্যার সমাধান হয়নি।

নগর গবেষণা কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, উন্নয়নের পরিকল্পনা হতে হবে পুরো এলাকা ঘিরে এবং ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে। এমনিতেই এই শহরে দুই সিটি করপোরেশন তার ওপরে আবার ৫৬ সেবা সংস্থা। তাই সমন্বয়ের জন্য নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা কর্তৃপক্ষকে দায়িত্ব এবং ক্ষমতা দিতে হবে।

সমন্বয়হীনতার বেশ কিছু চিত্রের খোঁজ মিলেছে সরেজমিনে। রাজধানীর মিন্টো রোড সংস্কার করে বছরখানেক আগেই কার্পেটিং করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। এর ছয় মাস পার হতেই সুয়ারেজ লাইনের জন্য রাস্তার এক পাশ খোঁড়ে ওয়াসা। পুরো বর্ষা মৌসুম এই রাস্তা খোঁড়া ছিল। মিন্টো রোডে হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতাল থেকে শুরু করে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং সরকারি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বাসভবন রয়েছে। প্রায় এক কিলোমিটার রাস্তা খুঁড়ে রাখায় ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে আশপাশের বসবাসকারী পরিবার এবং রাস্তা ব্যবহারকারী যাত্রীদের। নতুন রাস্তা কাটার কারণে পাশে থেকে কার্পেটিং উঠে যাচ্ছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, সিটি করপোরেশনের সংস্কারের আগে এই সুয়ারেজ লাইনের কাজ করতে পারত ওয়াসা। বারবার রাস্তা খুঁড়ে যেমন সরকারি অর্থ খরচ হচ্ছে একইভাবে বাড়ছে জনভোগান্তি। রাজধানীর ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক উন্নয়ন, নর্দমা ও ফুটপাথ নির্মাণে ২০১৬ সালের পর থেকে ১ হাজার ৭৫৯ কোটি টাকা ব্যয় করেছে দুই সিটি করপোরেশন। এসব অর্থের বড় অংশই ব্যয় হয়েছে আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ভিআইপি রোডের ফুটপাথ-ড্রেন উন্নয়নে। কিন্তু মেট্রোরেলের কারণে ভাঙা হচ্ছে প্রায় আট কিলোমিটার ফুটপাথ-ড্রেন। ফার্মগেট পার্কসংলগ্ন ফুটপাথ তুলে ফেলা হয়েছে। বাংলামোটরের পর থেকে নতুন টাইলস বসানো ফুটপাথ ভেঙে ফেলা হয়েছে। এ ছাড়া এই রাস্তা ধরে বসানো সড়কবাতিগুলো সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। প্রায় ৩ কোটি টাকা খরচ করে এসব এলইডি সড়কবাতি লাগিয়েছিল দুই সিটি করপোরেশন। এই সড়কে যে মেট্রোরেল যাবে সে নকশা আগেই প্রস্তুত ছিল। তবুও ফুটপাথ সংস্কার করে এবং সড়কবাতি লাগিয়ে বিপুল অর্থ খরচ করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে নগর বিশ্লেষক স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, ‘পৃথিবীর অন্য দেশে নগর সরকারের হাতে নগরীর সব সংস্থা থাকে। কিন্তু ঢাকার দুই মেয়রের রাস্তা ঝাড়ু দেওয়া ছাড়া আর কোনো ক্ষমতা নেই। এই ৫৬ সেবা সংস্থার সমন্বয়হীনতা দূর করতে সংস্থাগুলোর দায়িত্ব এবং ক্ষমতা মেয়রদের হাতে দিতে হবে।’

সর্বশেষ খবর