শনিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

তবুও চলছে মরণযাত্রা

মানব পাচার বন্ধে আইন শুধু কাগজে কলমেই, বিশেষ ট্রাইব্যুনালে হয়নি একটি বিচারও শ্রমবাজারের বিকাশ ছাড়া পরিস্থিতি পাল্টাবে না- বলেছেন বিশ্লেষকরা

জুলকার নাইন

তবুও চলছে মরণযাত্রা

সংসারের অভাব-অনটন থেকে মুক্তি পেতে স্বামী-সন্তান রেখে বিদেশ যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন উত্তরাঞ্চলের এক গৃহবধূ। কাজ করতে অক্ষম স্বামী ও সাত বছরের বাচ্চার খরচ মেটাতে সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়ে দেশ ছাড়েন ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে। গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে তার যাওয়ার কথা ছিল লেবানন। সেজন্য ৯০ হাজার টাকা দিয়েছেন রিক্রুটিং এজেন্সিকে। লেবানন যাবেন বলে এয়ারপোর্টে গিয়ে বিমানে ওঠেন। কিন্তু বিমান থেকে নামার ৬ ঘণ্টা পর জানতে পারেন তিনি লেবানন নন, গিয়েছেন সিরিয়ায়। তখন যুদ্ধবিগ্রহে সিরিয়া উত্তাল। সেখানেই যৌনকর্মী হিসেবে বিক্রি করা হয়েছিল বাংলাদেশের গ্রামীণ এই বধূকে। একটানা নয় মাস চলে এই নির্যাতন। হাঁটাচলা করার শক্তিও প্রায় হারিয়ে ফেলা এই গ্রাম্যবধূ দেশে ফেরার সুযোগ পান র‌্যাবের সহায়তায়। তাকে দেশে আনার আগেই নতুন হওয়া মানব পাচার আইনে দোষী রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে মামলা করে র‌্যাব।

কিন্তু গ্রাম্যবধূর জীবন ধ্বংস করে দেওয়া সেই রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে ‘অপেক্ষাকৃত কঠোর’ মানব পাচার আইনে মামলা না নেওয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। চিঠিতে বলা হয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সংগঠন বায়রা। দেশ হারাচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা। মানব পাচার আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ-, অন্যদিকে অভিবাসন আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি পাঁচ বছরের জেল। তাই মানব পাচার আইনের পরিবর্তে রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইনে মামলা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন শীর্ষব্যক্তির (প্রতিমন্ত্রী) চিঠিতে। মামলা করার প্রায় পাঁচ বছর পার হওয়ায় এখন বিচারের আশা এক রকম ছেড়েই দিয়েছেন অর্ধশিক্ষিত ওই গৃহবধূ।

বিশ্লেষকরা বলছেন, মানব পাচারকে প্রায়ই ঘৃণ্যতম অপরাধ হিসেবে বক্তব্য-বিবৃতি প্রচার করা হয়। কিন্তু খোদ সরকারের মন্ত্রণালয়ের এমন সুপারিশ হতাশার। দায়িত্বশীলদের পক্ষ থেকে মানব পাচার বন্ধে সর্বোচ্চ নজরদারির কথা বলা হলেও তা শুধু মুখে মুখেই। আর প্রয়োগ না করায় ২০১২ সালে সরকারের করা কঠোর আইন শুধু কাগজ-কলমেই রয়ে গেছে। দুর্গম পথে বিদেশযাত্রা ও মানব পাচারের মতো অপরাধ এখনো বেপরোয়াভাবে চলার প্রধান কারণ বিচারহীনতা। মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য বন্ধে নজরদারির দুর্বলতা ও বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণে কোনো কিছুকেই তোয়াক্কা করছে না মানব পাচারকারীরা।

রেকর্ড অনুসারে, সারা দেশে মানব পাচার আইনে এখন পর্যন্ত মামলা হয়েছে ৪ হাজার ৬৬৮টি। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ২৪৫টি, বিচারাধীন রয়েছে ৪ হাজার ১০৬টি, আদালত স্থানান্তর হয়েছে ৩১৭টি মামলার। উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত রয়েছে ৭টি। নিরাপদ অভিবাসন কর্মীরা বলছেন, নিষ্পত্তি হওয়া মামলার মধ্যে আপসরফার সংখ্যাই বেশি। বাকিগুলোয় চলছে দীর্ঘসূত্রতা। অথচ মানব পাচার আইনে ৯০ দিনের মধ্যে অভিযোগ গঠন এবং ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার শেষ করার কথা থাকলেও নানা জটিলতায় আটকে আছে মামলাগুলো। এতে অভিযুক্তরা জামিনে বেরিয়ে আবারও মানব পাচারে সক্রিয় হচ্ছে। এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে অবস্থা আরও খারাপের দিকে যাওয়ার শঙ্কা বিশ্লেষকদের।

একই অভিমত যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরেরও। ‘ট্রাফিকিং ইন পারসন ২০১৯’ শীর্ষক প্রতিবেদনে ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্ট বলছে, বাংলাদেশ সরকার মানব পাচার প্রতিরোধে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিলেও তা কাজে আসছে না। প্রতি বছর বিশ্ব পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করা মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর এর আগে ২০১২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশকে রেখেছিল দ্বিতীয় স্তর অর্থাৎ টায়ার-টুতে। ২০১৭ সালে এক ধাপ নামিয়ে বাংলাদেশকে টায়ার-টুর ‘নজরদারিতে থাকা দেশের’ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সেই অবস্থার কোনো পরিবর্তন নেই বলে এখন মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মন্তব্য। সর্বশেষ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ‘ট্রাফিকিং ভিকটিম প্রটেকশন অ্যাক্ট’-এর কারণে বাংলাদেশকে টায়ার-থ্রিতে নামিয়ে দেওয়া হয়নি। এজন্য টানা তৃতীয়বারের মতো টায়ার-টু নজরদারি তালিকায় রাখা হলো। তবে অভিবাসন খাতে অবৈধ মধ্যস্বত্বভোগীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় পাচারের ঝুঁকি আরও বেড়ে গেছে। বাংলাদেশের সঙ্গে এ তালিকায় আরও রয়েছে কঙ্গো, গ্যাবন, হাঙ্গেরি, ইরাক, মালয়েশিয়া, রোমানিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ভিয়েতনাম, আলজেরিয়া, ব্রুনাই, কম্বোডিয়া, আফগানিস্তানসহ ৩৮টি দেশ। জানা যায়, চলতি বছরের মে মাসে ভূমধ্যসাগর দিয়ে অবৈধভাবে ইতালি যাওয়ার পথে নৌকা ডুবে মারা যান ৩৭ বাংলাদেশি। এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই মাত্র এক মাসের মধ্যে ইউরোপে পাড়ি দেওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরে ভাসতে থাকা ৬৪ বাংলাদেশি অভিবাসনপ্রত্যাশীকে তিউনিসিয়ার উপকূল থেকে উদ্ধার করা হয়। এভাবে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা নতুন নয়। শুধু ইউরোপ নয়, বছর চারেক আগে সাগরপথ দিয়ে হাজারো মানুষের মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে যাওয়ার ঘটনা আন্তর্জাতিক সব গণমাধ্যমে উঠে আসে। ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গত বছরের তথ্যানুযায়ী, প্রতি বছর ভারতে বাংলাদেশ থেকে গড়ে ৫০ হাজার নারী পাচার হয়। দীর্ঘদিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করা সাবেক এক কূটনীতিকের মতে, বিশ্বব্যাপী মানব পাচারকে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হলেও বাংলাদেশের বাস্তবতা ভিন্ন। মুখে কঠোর হওয়ার কথা থাকলেও এখানে পাচার নিয়ে সরকারের কোন অংশ কাজ করবে তা নিয়েই রয়েছে সমন্বয়হীনতা। যখনই পাচারের বিষয় আসছে, প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় মনে করে এটা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাজ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আবার অনেক সময় মনে করে এটা প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কাজ। সমন্বয়ের এ অভাব সরকারের সদিচ্ছাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। মানব পাচার ও নিরাপদ অভিবাসন নিয়ে কাজ করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. সি আর আবরারের মতে, বাংলাদেশে মানব পাচারের বিচারহীনতা বা দীর্ঘসূত্রতার কথা নতুন নয়। স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রতিবেদনেও বলা আছে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করতে না পারার কথা। প্রতিবেদনে অভিবাসন ব্যয় ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য নিয়েও বলা হয়েছে। অভিবাসনের নামে চলতে থাকা বিভিন্ন ধরনের প্রতারণার কথা প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসানের মতে, মানব পাচার বন্ধে বাংলাদেশের যে ‘ন্যাশনাল প্ল্যান অব অ্যাকশন’ আছে তা বাস্তবায়ন করতে পারলেই পরিস্থিতি পাল্টে যাবে। বাস্তবায়ন হয়ে যাবে স্টেট ডিপার্টমেন্টসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সুপারিশ।

উল্টো মামলা প্রত্যাহারের পরামর্শ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের : মানব পাচার বিষয়ে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে গত জুনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেওয়া চিঠিতে বলা হয়েছে, দেখা যাচ্ছে মানব পাচারের অপরাধে মামলা করার পর সাক্ষী আদালতে আসেন না। অভিযুক্তের সঙ্গে আপস করে টাকা নিয়ে নেন। টাকা পেয়ে গেলে আর মামলা নিয়ে এগোতে চান না। এজন্য মামলাগুলোর নিষ্পত্তি হয় না। তাই প্রয়োজনে মামলার বাদীদের সঙ্গে বসতে বলা হয়েছে। তাদের সঙ্গে কথা বলে যদি প্রয়োজন হয় মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়ার ব্যবস্থা নিতে বলেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর