শনিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

প্রকল্পের গাড়ি যাচ্ছে কোথায়

ব্যবহার করছেন সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যও

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

প্রকল্পের গাড়ি যাচ্ছে কোথায়

স্বাস্থ্য অধিদফতরের ‘মেটারনাল, নিওনেটাল, চাইল্ড অ্যান্ড অ্যাডোলেসেন্ট হেলথ’ নামে প্রকল্পে ২০০৮ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ৭টি প্রাডো জিপ ও ২টি পাজেরো জিপ কেনা হয়েছিল। মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা নিজেদের কাজে ব্যবহারের জন্য এসব গাড়ি শেষতক ভাগ-বাটোয়ারা করে নেন। এর মধ্যে ঢাকা মেট্রো-ঘ ১৩-৮০২৫ ও ঢাকা মেট্রো-ঘ ১৩-০২০২ নম্বরের প্রাডো জিপ দুটি স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দফতর এবং ঢাকা মেট্রো -১৩-৮০২৩ ও ঢাকা মেট্রো ঘ-১৩-৮০২২ এই প্রাডো জিপ দুটি ওই মন্ত্রণালয়ের সচিবের দফতর ও অতিরিক্ত সচিবের ব্যবহারের জন্য নেওয়া হয়। বাকি জিপগুলো গেছে অধিদফতরের মহাপরিচালক, অতিরিক্ত মহাপরিচালক ও পরিচালকের কাছে। সরকারের গৃহীত বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যবহৃত গাড়ির তথ্য চেয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরীবিক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ- ইমপ্লিমেন্টেশন, মনিটরিং অ্যান্ড ইভাল্যুয়েশন ডিপার্টমেন্ট (আইএমইডি) বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কাছে ২০১৭ সালে চিঠি দেয়। পরে মন্ত্রণালয়গুলো যে তথ্য দেয় সেখানে এ ধরনের শত শত গাড়ি (প্রকল্প শেষে) মন্ত্রণালয়, বিভাগ, সংস্থা, দফতর ও অধিদফতরের কাজে ব্যবহারের তথ্য মিলেছে। এমনও দেখা গেছে, এসব প্রকল্পের গাড়ি সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যও ব্যবহার করেছেন। একই সময়ে আইএমইডিতে পাঠানো পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)’র এফএ অ্যান্ড এমআইএস-এর উপপরিচালক স্বাক্ষরিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, পঞ্চম আদমশুমারি প্রকল্পের কাজ শেষ হয় ২০১১ সালে। কিন্তু সাত বছরেও ওই প্রকল্পে ব্যবহৃত গাড়ি বুঝে পায়নি বিবিএস। বিবিএস’র প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রকল্পে ব্যবহৃত ঢাকা মেট্রো চ ৫৩-৪৬৭২ গাড়িটি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির সভাপতির দফতরে ব্যবহৃত হচ্ছিল। আইএমইডি জানায়, ২০১৭ সালে সংগৃহীত এসব তথ্যের তেমন কোনো হেরফের হয়নি। প্রকল্প শেষ হওয়ার পরও মন্ত্রণালয়গুলো পরিবহন পুলে গাড়ি জমা দেয়নি। উন্নয়ন প্রকল্পের নামে মন্ত্রণালয়গুলো  যেসব গাড়ি কেনে, প্রকল্প শেষ হয়ে যাওয়ার পর  বেশির ভাগ গাড়ির আর হদিস মেলে না। আইন অনুযায়ী প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওইসব গাড়ি পরিবহন পুলে জমা দেওয়ার কথা। কিন্তু মন্ত্রণালয় ও বিভাগ আইনের পরোয়া না করে নিজেদের খেয়াল-খুশি মতো গাড়িগুলো ব্যবহার করে। অনেকে আবার বছরের পর বছর ধরে পারিবারিক কাজেও ব্যবহার করছে প্রকল্পের গাড়ি। আইএমইডি সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে তথ্য নেওয়ার পর চলতি বছরের মার্চে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায় প্রকল্প শেষে গাড়ি জমা না দেওয়ার বিষয়টি তুলে ধরা হয়। প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে বেশ কয়েকটি অনুশাসন দেন। এগুলো ছিল, প্রকল্প সমাপ্ত হওয়ার তিন মাসের মধ্যেই পিসিআর বা প্রকল্প সমাপ্ত প্রতিবেদন জমা দিতে হবে এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন শেষে প্রকল্পের গাড়ি, অফিস ও অন্যান্য সরঞ্জাম যথাস্থানে জমা দিতে হবে। তবে ওই অনুশাসনের পরও প্রকল্পের গাড়ি জমা দেওয়ার বিষয়ে মন্ত্রণালয় ও সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। প্রধানমন্ত্রীর ওই অনুশাসনের বিষয়টি নিশ্চিত করে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রকল্পের গাড়ি অপব্যবহারের বিষয়টি ভয়ংকর অবস্থায় পৌঁছেছে। প্রকল্প শেষে এখন কেউ গাড়ি ফেরত দিতে চায় না। মন্ত্রণালয় ও সংস্থার কর্মকর্তারা মনেই করেন যে, আওতাধীন প্রকল্পের গাড়িগুলোতে তাদের অধিকার রয়েছে এবং এগুলো তারা ব্যবহার করবেন। পরিবহন পুলে গাড়ি জমা না দিয়ে ব্যবহার করা শুধু বেআইনি নয়, এটিকে এক ধরনের ‘দুর্নীতি’ বলেও উল্লেখ করেন পরিকল্পনামন্ত্রী। আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে এভাবে গাড়ি ব্যবহার করাকে দুর্নীতির পর্যায়ে পড়ে বলেই মনে করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সংস্থাটি সম্প্রতি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো এক চিঠিতে বলেছে, ‘অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রকল্পের জন্য ক্রয়কৃত যানবাহন প্রকল্প সমাপ্তির পর সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী পরিবহন পুলে জমা প্রদান করার বিধান থাকলেও তা অনুসরণ করা হচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে নিয়ম বহির্ভূতভাবে বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা উক্ত যানবাহন ব্যবহার করে থাকেন। যা দুর্নীতির পর্যায়ে পড়ে।’ দুদকের ওই চিঠির পর যেসব প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে সেগুলোর গাড়ি ফেরত দেওয়ার বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থাগুলোকে গত ২৮ আগস্ট চিঠি পাঠায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও জন প্রশাসন বিভাগ।

সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, সরকারি যানবাহন পরিচালনা আইন অনুযায়ী প্রকল্প শেষ হওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে প্রকল্পে ব্যবহৃত যানবাহন পরিবহন পুলে জমা দিতে হবে। কোনো কারণে বা প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হলে ৬ মাস আগে কর্তৃপক্ষকে অবহিত করতে হবে। কিন্তু এসব নিয়মের বালাই নেই প্রকল্প ব্যবহৃত গাড়ি ফেরত দেওয়ার  ক্ষেত্রে। প্রকল্প শেষ হলেও বছরের পর বছর এসব গাড়ি অনৈতিকভাবে ব্যবহার করছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়। সরকারি যানবাহন অধিদফতরের কমিশনার মিজানুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আইন অনুযায়ী প্রকল্প শেষ হওয়ার পর পরিবহন পুলে গাড়ি জমা দেওয়ার কথা, কিন্তু সেটি হচ্ছে না। এক্ষেত্রে কোনো শৃঙ্খলাও নেই। কোন প্রকল্প কবে শেষ হচ্ছে, কতগুলো গাড়ি রয়েছে আইএমইডি থেকে যদি আমাদের এ সংক্রান্ত তথ্য দেওয়া হয়, তবে আমরা প্রকল্পের গাড়িগুলো ফেরত দেওয়ার জন্য মন্ত্রণালয়ের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পরি। আইএমডির সচিব আবুল মনসুর মো. ফয়েজউল্লাহ, এনডিসি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রকল্প শেষে গাড়ি জমা দেওয়ার বিষয়টি যে মন্ত্রণালয় বা সংস্থার প্রকল্প সেটি সে মন্ত্রণালয়ের দেখার বিষয়। এ ব্যাপারে আইএমইডি কোনো ফলোআপ করে না। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কেই নিশ্চিত করতে হবে যে, গাড়িগুলো নিয়মানুযায়ী পরিবহন পুলে যথাযথভাবে জমা হয়েছে। না হওয়াটা অনিয়ম। এতে সরকারি অর্থের অপচয় হয়। এক প্রকল্পের গাড়ি থাকার পরও অন্য প্রকল্পের জন্য আবার নতুন গাড়ি কিনতে হয়।

সর্বশেষ খবর