শনিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

আত্মগোপনে জি কে শামীমের পার্টনাররা

নিজস্ব প্রতিবেদক

আত্মগোপনে জি কে শামীমের পার্টনাররা

গ্রেফতারের পর জি কে শামীমের মুখ থেকে একের পর এক বেরিয়ে আসছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। কীভাবে টেন্ডার বাগিয়ে নিতেন, কীভাবে জাল কাগজপত্র দেখিয়ে টেন্ডার দাখিল করতেন, আর টেন্ডারের ঘোষণা অনুযায়ী কাজ না করে কীভাবে অর্থ আত্মসাৎ করতেন- এমন             

সব নতুন নতুন তথ্য জানিয়ে মুখ খুলছেন তিনি। তবে তার অবৈধ কর্মকাে র পেছনে ছিলেন একাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তি। শামীমের টেন্ডারবাজির অন্যান্য সহযোগীও বর্তমানে নজরদারিতে রয়েছেন বলে জানা গেছে। গণপূর্ত অধিদফতরের কর্মকর্তাদের মাঝে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। জি কে শামীমের ঘনিষ্ঠ ছিলেন এসব কর্মকর্তা।

গোয়েন্দা পুলিশের তদন্তে টেন্ডারবাজ শামীমের ব্যবসায়িক সহযোগীদের অন্যতম ফেনী জেলা বিএনপির উপদেষ্টা ফজলুর করীম চৌধুরী স্বপনের নাম বেরিয়ে এসেছে। দ্য বিল্ডার্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের স্বত্বাধিকারী তিনি। তার বিরুদ্ধে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। তার হাতে জি কে শামীমের মাধ্যমে পাওয়া প্রায় এক হাজার কোটি টাকার কাজ রয়েছে বলে জানা গেছে। স্বপন এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডে কালা রাজ্জাকসহ শামীমের সব সহযোগী এখন গা ঢাকা দিয়েছেন।

জানা যায়, জি কে শামীম ও ফজলুল করীম চৌধুরী স্বপন মিলে বান্দরবানে একটি পাঁচ তারকা রিসোর্ট তৈরির জন্য ৪৮ একর জমি অধিগ্রহণ করে দখল করেছেন ১০০ একর জমি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) কর্তৃপক্ষ ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে নতুন কলা অনুষদ ভবনের দ্বিতীয় পর্যায়ের নির্মাণ কাজের দরপত্র আহ্বান করে। ওই সময় কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই ৭৫ কোটি টাকার কাজটি পায় যুবলীগ নেতা জি কে শামীমের মালিকানাধীন মেসার্স দ্য বিল্ডার্স ইঞ্জিনিয়ার্স-জিকেবিএল (জেভি)। এই টেন্ডারকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামের আলোচিত ছাত্রলীগ নেতা দিয়াজ ইরফান চৌধুরী হত্যার ঘটনা ঘটে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। এই কাজে জাল কাগজপত্র দিয়ে জি কে বিল্ডার্সের কাজ বাগিয়ে নেওয়ার প্রমাণ পেয়েছে দুদক। এ ছাড়া জি কে শামীমের সহযোগী ফজলুল করীম চৌধুরী স্বপন বিজয়নগরে শ্রমভবনের ২৩ তলার টেন্ডার নিয়ে নির্মাণ করেছেন ২২ তলা ভবন। অথচ টাকা নিয়েছে পুরো ২৩ তলা নির্মাণের কথা বলে। এখানেও প্রায় ১ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। একইসঙ্গে শান্তিনগরে এক প্রতিবন্ধীর জায়গা দখল করে বিল্ডিং নির্মাণেরও অভিযোগ পাওয়া গেছে। ওই স্থানে রাজউক ৮ তলা বিল্ডিং নির্মাণের অনুমোদন দিলেও সেখানে ১০ তলা ভবন নির্মাণ করেছে স্বপনের মালিকানাধীন ইউরেকা প্রপার্টিজ লিমিটেড। ২০১১ সালের ১৬ অক্টোবর শান্তিনগরের আমিনুল হক নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে প্রায় আড়াই কাঠা জমি ইউরেকা প্রপার্টিজ লিমিটেডের নামে ‘ব্যাপক ক্ষমতা সম্পন্ন আমমোক্তারনামা দলিল’ করা হয়। ওই জমির পাশেই আমিনুলের প্রতিবন্ধী ভাই জিয়াউল হকের আরও আড়াই কাঠা জায়গা ছিল। আমমোক্তারনামা দলিলের পর পুরো জায়গাটিই দখলে নেয় স্বপন। ২০১৩ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রাজউকের কাছ থেকে ওই স্থানে ৮ তলা ভবন নির্মাণের অনুমোদন নেওয়া হয়। এদিকে ২০১২ সালের ৬ জুন সাড়ে ৭৭ কোটি টাকা শুল্ক ফাঁকির অভিযোগে দ্য বিল্ডার্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেছিল দুদক। যা এখনো চলমান। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭৫ কোটি টাকার টেন্ডারের আগে ২০১৪ সালে অন্য একটি টেন্ডার নিতে কাজ সমাপ্তির জাল সনদ দাখিল করে দ্য বিল্ডার্স ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেড। সেখানে অভিজ্ঞতা হিসেবে রাজধানীর মালিবাগে সিআইডি সদর দফতর ভবনের ৩য়, ৪র্থ ও ৫ম তলা নির্মাণের ১৯ কোটি ২১ লাখ ৫৮ হাজার টাকার কাজ দেখানো হয়। ২০১৬ সালের ১৬ জুন বিষয়টি যাচাই করতে ঢাকা গণপূর্ত বিভাগ-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলীকে একটি চিঠি দেয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী। এর তিন দিনের মাথায় চিঠির জবাব দিয়ে গণপূর্তের নির্বাহী প্রকৌশলী শঙ্কর কুমার মালো জানান, দ্য বিল্ডার্স ইঞ্জিনিয়ার্স মূলত ৯ কোটি ২১ লাখ ৫৮ হাজার ৭১২ টাকার কাজ করেছেন। তার ১৯ কোটি টাকার কাজ দেখানোর সনদটি সঠিক নয় বলেও জানিয়ে দেন। এভাবে জি কে শামীম আর তার সহযোগীরা মোটা অঙ্কের কাজ সমাপ্তির জাল সনদ দাখিল করে সরকারি বড় বড় প্রকল্পের টেন্ডার হাতিয়ে নিতেন। তবে জি কে শামীম গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে স্বপনসহ অন্যদের খোঁজ কোথাও মিলছে না বলে জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। 

আতঙ্কে গণপূর্তের প্রকৌশলীরা : গণপূর্ত অধিদফতরের কর্মকর্তাদের মাঝে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। ইতিমধ্যে তড়িঘড়ি করে গণপূর্ত অধিদফতরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী উৎপল কুমার দেকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি-রিজার্ভ) করা হয়েছে। র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) সদর দফতরের নতুন ভবন নির্মাণ কাজের  টেন্ডারে ঘুষকান্ড নিয়ে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তবে অভিযোগ উঠেছে, অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলীকে ‘বাঁচাতেই’ তড়িঘড়ি করে তাকে ওএসডি করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার দুই মাস পর উৎপল কুমার নতুন দায়িত্ব নিয়েছিলেন।

গণপূর্ত অধিদফতর কর্মকর্তাদের মতে, উৎপল কুমার  দে দক্ষ, যোগ্য ও পরিশ্রমী একজন কর্মকর্তা। মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে উৎপল কুমারকে ওএসডি করা হয়েছে। বর্তমানে প্রধান প্রকৌশলী মো. সাহাদাত  হোসেনের বিরুদ্ধে ঠিকাদার গোলাম কিবরিয়া (জি  কে) শামীমের দেওয়া ঘুষ কেলেঙ্কারির অভিযোগে ওঠে। জি কে শামীম যে কজন প্রকৌশলীর নাম বলেছে পুলিশের কাছে তাদের মধ্যে এই প্রধান প্রকৌশলীও রয়েছেন। তিনি আছেন বহাল তবিয়তে। র‌্যাব সদর দফতরের টেন্ডারের সময় এবং উৎপল কুমারের যোগ দেওয়ার সময়ের কিছু নথিতে দেখা যায়, র‌্যাব সদর দফতরের কাজের টেন্ডার আহ্বান করা হয় গত বছরের ৫ জুন। এই সময়ের টেন্ডার নিষ্পত্তির চেয়ারম্যান ছিলেন গণপূর্তের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী প্রকল্প ও বিশেষ প্রকল্পের (পিএনএসপি) বর্তমান কর্মকর্তা ড. মঈনুল ইসলাম। প্রচলিত বিধি অনুযায়ী, প্রকল্পের দরপত্র গণপূর্ত ঢাকা সার্কেল-৩ থেকে আহ্বান ও তৎকালীন ঢাকা গণপূর্ত  জোন থেকে মূল্যায়ন দেওয়ার কথা। র‌্যাব সদর দফতরের কাজের টেন্ডার গণপূর্ত ঢাকা সার্কেল-৩-এর অধীনে। কিন্তু নিয়মনীতি না মেনে বর্তমান অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে নিয়োজিত ড. মইনুল ইসলাম ও তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলামের সঙ্গে যোগসাজশে অতিরিক্ত কমিশন আদায়ের জন্য গণপূর্ত অধিদফতরের (সদর দফতর) থেকে টেন্ডার আহ্বান করা হয়। উৎপল কুমার দে ঢাকা গণপূর্ত মেট্রোপলিটন জোনের দায়িত্ব  পেয়েছেন গত বছরের ২৬ আগস্ট। জি কে শামীমের মালিকানাধীন জি কে বিল্ডার্সের কাজের ৯৯ ভাগ কাজ তার দায়িত্ব নেওয়ার আগেই ওয়ার্ক অর্ডার পায়।

সর্বশেষ খবর