সোমবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

প্রশাসনের মুখোমুখি উপজেলা চেয়ারম্যানরা

বিদেশ সফর ও ক্ষমতা নিয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বিরোধ

নিজামুল হক বিপুল

প্রশাসনের মুখোমুখি উপজেলা চেয়ারম্যানরা

সরকারি আদেশ মানছেন না মাঠের কর্মকর্তারা

উপজেলা চেয়ারম্যান ও আমলাতন্ত্র এখন মুখোমুখি। উপজেলা পরিষদকে কার্যকর ও গতিশীল করতে বিভিন্ন সময়ে জারি করা সরকারের নির্দেশনা কার্যত মানছেন না উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা (ইউএনও)। স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে নতুন নতুন নির্দেশনা জারি করে উপজেলা পরিষদকে রীতিমতো অকার্যকর করে রেখেছেন আমলারা। উপজেলা চেয়ারম্যানদের বিদেশ ভ্রমণের বিষয়ে স্থানীয়  সরকার বিভাগের সচিবের একটি মৌখিক নির্দেশনার পর অসন্তোষ বিরাজ করছে দেশের ৪৯২টি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও অন্য সদস্যদের। ইতিমধ্যে বিষয়টি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলামকে লিখিতভাবে জানালেও গত দেড় মাসেও এর কোনো সুরাহা হয়নি। একাধিক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, পুরো বিষয়টি তারা শিগগির প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করবেন। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতা গ্রহণের পর ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে কয়েক ধাপে উপজেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনের পর উপজেলা পরিষদকে কার্যকর করতে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করে বাংলাদেশ উপজেলা পরিষদ অ্যাসোসিয়েশন। সরকার পরিষদকে কার্যকর করতে তাদের বেশ কিছু দাবি-দাওয়া মেনে নিয়ে ২০১০ সালের ৪ এপ্রিল স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে।

উপজেলা পরিষদ আইন, ১৯৯৮ (২০০৯ সালে ২৭ নং আইন দ্বারা সংশোধিত) এবং স্থানীয় সরকার বিভাগ হতে জারিকৃত প্রজ্ঞাপন, বিধি ও অন্যান্য নির্দেশনা অনুসারে জারিকৃত ওই প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছিল, উপজেলা পরিষদ নিয়ে ইতিমধ্যে সরকারের জারিকৃত প্রজ্ঞাপন, বিধি ও অন্যান্য নির্দেশনাসমূূহ উপজেলা পরিষদ কর্তৃক যথাযথভাবে অনুসৃত হচ্ছে না। এতে বলা হয়, উপজেলা পরিষদের কার্যক্রম বাস্তবায়ন বিধিমালা ২০১০ এর বিধি-১৪ অনুযায়ী চেয়ারম্যানের অনুমোদন প্রয়োজন এমন সব কাগজপত্র ও নথি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে চেয়ারম্যানের নিকট উপস্থাপন করতে হবে। কিন্তু বাস্তবে সে সব নথিপত্র চেয়ারম্যানের কাছে উপস্থাপন হচ্ছে না। উপজেলা পরিষদে হস্তান্তরিত দফতরসমূহের কর্মকর্তাদের কর্মতালিকা সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন অনুসরণে হস্তান্তরিত বিষয় সংশ্লিষ্ট উপজেলা পর্যায়ে সব কর্মকর্তা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের তত্ত্বাবধানে এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সমন্বয়ে দায়িত্ব পালন করবেন। প্রকৃতপক্ষে এ বিধানও অনুসরণ করা হচ্ছে না। ওই আদেশে উপজেলা পরিষদ আইন অনুযায়ী এসব বিষয় যথাযথভাবে অনুসরণের নির্দেশনা হয়। এই আদেশের আলোকে ওই বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে আরেকটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। (এসআরও নং ৩২৩-আইন/২০১০)। এতে বলা হয়, ‘তৃতীয় তফসিলে উল্লিখিত দফতরসমূহের কর্মকর্তারা, সরকার কর্তৃক উপজেলা পরিষদের নিকট হস্তান্তরিত বিষয়ে সব কাগজপত্র ও নথি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের কাছে অনুমোদনের জন্য পেশ করবেন।’ কিন্তু বাস্তবে গত ১১ বছরেও এগুলো কার্যকর হয়নি। উপজেলা চেয়ারম্যানরা অভিযোগ করেছেন, উপজেলা পরিষদ আইন এবং সরকারের সব প্রজ্ঞাপন ও নির্দেশনা উপেক্ষা করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা নিজেদের ইচ্ছামতো পরিষদের কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। উপজেলা পর্যায়ে হস্তান্তরিত সরকারের ১৭টি দফতরের কোনো কাগজপত্র বা নথি অনুমোদনের জন্য উপজেলা চেয়ারম্যানের কাছে উপস্থাপন করা হয় না। উপজেলা চেয়ারম্যানকে পাশ কাটিয়ে প্রত্যেক উপজেলার ইউএনও নিজেই সেগুলো অনুমোদন দেন। এতে করে স্থানীয় সরকার বিভাগের একটি পূর্ণাঙ্গ পরিষদ কোনো রকম কার্যকারিতা পায়নি। এদিকে উপজেলা পরিষদ কার্যকর না হলেও এখন নতুন করে নানা নির্দেশনা জারি করছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। পরিষদ গঠনের পর থেকেই পরিষদের চেয়ারম্যানরা ব্যক্তিগত কাজে বিদেশ যাওয়ার জন্য সরাসরি স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিবের মাধ্যমে মন্ত্রীর অনুমোদন নিয়ে বিদেশ যেতেন। অনুমোদনের এই প্রক্রিয়া তিন থেকে চার দিনের মধ্যে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে জরুরি হলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেও সম্পন্ন হতো। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিবের দায়িত্ব নেওয়ার কিছুদিন পর এই নিয়মের পরিবর্তন আনেন। তিনি স্থানীয় সরকার বিভাগের উপজেলা শাখাকে মৌখিক নির্দেশনা দেন যে, এখন থেকে কোনো উপজেলা চেয়ারম্যান দেশের বাইরে যেতে হলে সরাসরি সচিবের কাছে আবেদন করতে পারবেন না। তাকে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে আবেদন করতে হবে। এই প্রক্রিয়া নিয়েই এখন মুখোমুখি উপজেলা পরিষদ ও স্থানীয় সরকার বিভাগ। বাংলাদেশ উপজেলা পরিষদ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ও নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. সাইফুল ইসলাম খান বীরু ব্যক্তিগত কাজে সাত দিনের জন্য ভারত যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে ছুটি চেয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের উপজেলা পরিষদ শাখায় সচিব বরাবরে আবেদন করেন গত আগস্ট মাসে। তখন তাকে জানিয়ে দেওয়া হয়, এখন সচিব বরাবর আবেদন করা যাবে না। ডিসির মাধ্যমে আবেদন করতে হবে। পরে চেয়ারম্যান নরসিংদীর ডিসি বরাবর গত ১৩ আগস্ট ছুটির আবেদন করেন। ডিসি সেই আবেদন ফরোয়ার্ড করেন এসপিকে। এসপি একটি প্রতিবেদন চেয়ে মনোহরদী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ফরোয়ার্ড করেন। ওসি সেই আবেদন পেয়ে একটি প্রতিবেদন জমা দেন, যা খুবই আপত্তিকর ও অপমানজনক বলে মনে করছেন ওই চেয়ারম্যান ও অন্যান্য উপজেলা চেয়ারম্যানরাও। ওসি তার প্রতিবেদনে লিখেছেন, ‘চেয়ারম্যানের বিদেশ গমনে উপজেলা পরিষদের সরকারি কাজকর্মে কোনো অসুবিধা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তাহার স্বভাব চরিত্র ভালো। তিনি রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কার্যকলাপে জড়িত নয় বলে জানা গেছে। থানার রেকর্ডপত্রে তার বিরুদ্ধে বিরূপ কোনো তথ্য পাওয়া গেল না। তিনি বিদেশে থেকে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।...’

মনোহরদী উপজেলা চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এটা খুবই অপমানজনক ও আপত্তিকর। এর মাধ্যমে গণতান্ত্রিক দেশে জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হেয় প্রতিপন্ন করা হয়েছে। তিনি বলেন, নতুন সচিব স্থানীয় সরকার বিভাগের দায়িত্ব নেওয়ার পর সহজ কাজকে আমলাতন্ত্রের গ্যাঁড়াকলে ফেলে কঠিন করে দিয়েছেন। যেখানে ডিসির কোনো প্রয়োজনই নেই, সেখানে তিনি এখন পুলিশের মাধ্যমে আমাদের চারিত্রিক সনদ নিচ্ছেন, যা খুবই আপত্তিকর। তিনি বলেন, ছুটির অনুমোদন পেতে এই প্রক্রিয়ায় ২০ দিন থেকে এক মাস সময় লেগে যায়। অথচ আগে দুই থেকে চার দিনের মধ্যেই ছুটি মঞ্জুর হয়ে যেত। এখন যদি কেউ জরুরি চিকিৎসার জন্য যেতে চান, তাহলেও যেতে পারবে না আমলাতান্ত্রিক জটিলতায়। তিনি জানান, বিষয়টি আমাদের অ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমে আমরা স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাকে অবহিত করেছি। তিনি সচিবকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু গত প্রায় দুই মাসেও এ ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি হয়নি।

সাইফুল ইসলাম বলেন, শুধু এই সমস্যা নয়, গত ১১ বছরেও উপজেলা পরিষদ কার্যকর হয়নি। ১৭টি বিভাগের নথি উপজেলা চেয়ারম্যানদের অনুমোদনের জন্য উপস্থাপনের কথা থাকলেও ইউএনও’রা সেটি করছেন না। আমরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে তাকে পুরো বিষয়টি অবহিত করব এবং সমাধান চাইব। চট্টগ্রামের রাউহান উপজেলা চেয়ারম্যান এহসানুল হায়দার বাবুল বলেন, উপজেলা চেয়ারম্যানদের কাজ শুধু কবর জিয়ারত ও মেজবানি খাওয়া। আর কোনো কাজ নেই। তিনি বলেন, ইউএনওরা এখনো উপজেলা পরিষদকে গ্রহণ করতে পারছে না। তারা যে কোনো অনুষ্ঠানের ব্যানারে উপজেলা পরিষদের বদলে উপজেলা প্রশাসন লিখে।

অবশ্য স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এটা সত্য নয়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের আদেশ অনুযায়ীই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা ১৭টি দফতরের সব কাগজপত্র ও নথি অনুমোদনের জন্য উপজেলা চেয়ারম্যানদের কাছে উপস্থাপন করেন। তবে মুখ্য কর্মকর্তা হিসেবে ইউএনওরা কিছু নথি নিজেরাই অনুমোদন দেন। তিনি বলেন, কোনো ইউএনও সরকারের নির্দেশনা মানছেন না সেটা সুনির্দিষ্টভাবে চেয়ারম্যানরা জানালে সংশ্লিষ্ট ইউএনওর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর চেয়ারম্যানদের ছুটির বিষয়ে তিনি বলেন, ডিসিদের মাধ্যমে আবেদন করার প্রক্রিয়া আগেও ছিল। তবে নরসিংদীর মনোহরদীর ক্ষেত্রে যেটা ঘটেছে সেটিকে ‘বাড়াবাড়ি’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা কোনো পুলিশি রিপোর্টের জন্য বলিনি। ভবিষ্যতে যাতে এ রকম কোনো ঘটনা না ঘটে সে জন্য সংশ্লিষ্টদের সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর