শনিবার, ১২ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা

বুয়েটে নিষিদ্ধ রাজনীতি

এজাহারভুক্ত ১৯ জন সাময়িক বহিষ্কার, দিনভর উত্তাল আন্দোলন, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বৈঠকে ক্ষমা চাইলেন ভিসি

নিজস্ব প্রতিবেদক

বুয়েটে নিষিদ্ধ রাজনীতি

আবরার হত্যার প্রতিবাদ ও অভিযুক্তদের বিচার দাবিতে গতকাল বুয়েটে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা - বাংলাদেশ প্রতিদিন

মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যার বিচারসহ বিভিন্ন দাবিতে শিক্ষার্থীদের টানা আন্দোলনের পর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়-বুয়েটে সব রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত ১৯ ছাত্রকে বুয়েট থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। গতকাল বিকালে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বৈঠকে এ ঘোষণা দেন বুয়েট উপাচার্য অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম। বুয়েট কেন্দ্রীয় অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত বৈঠকে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা হর্ষধ্বনিতে এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানান। তবে গত রাত সাড়ে ১০টায় আনুষ্ঠানিকভাবে শিক্ষার্থীরা জানায়, ১০ দাবির মধ্যে পাঁচটি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তাদের আন্দোলন চলবে। বিকালের বৈঠকে উপাচার্য আরও বলেন, ‘নিজ ক্ষমতাবলে ও স্ট্যাটিউটের ক্ষমতা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের সব  রাজনৈতিক সংগঠনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হলো। হলগুলোয় র‌্যাগিংয়ের নামে শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতনের বিষয়ে দ্রুততম সময়ে তদন্ত কমিটি করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ প্রায় ৩ হাজার ছাত্রছাত্রীর উপস্থিতিতে শুরু হয় বৈঠক। উপাচার্য শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো নিয়ে একে একে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘খুনিদের শাস্তির ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলেছেন। তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি কোর্টের মাধ্যমে আসবে। সিসিটিভির ফুটেজ দেখে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। বুয়েটের তদন্ত কমিটি কাজ করছে। মামলায় এজাহারভুক্ত ১৯ জনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হলো। প্রতিবেদন পাওয়ার পর জড়িতদের আজীবন বহিষ্কারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’ তিনি বলেন, ‘মামলার সব খরচ ও আবরার পরিবারের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একমত। শিগগিরই এর অফিশিয়াল নোটিস প্রকাশ করা হবে। মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পরিচালনার ব্যাপারে সম্পূর্ণভাবে একমত আমরা। সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। তারা বিন্দুমাত্র অবহেলা করবে না। ট্রাইব্যুনালে লিখিত চিঠিতে আবার জানাব।’ উপাচার্য বলেন, ‘চার্জশিটের কপির ব্যাপারে কিছু প্রক্রিয়ার জন্য অপেক্ষা করছি। চার্জশিটের কপি পেলে শিক্ষার্থীদের জানিয়ে দেওয়া হবে। র‌্যাগিংয়ের নামে আবাসিক হলগুলোয় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন বন্ধে ছাত্র পরিচালক ব্যবস্থা নেবেন।’ বক্তব্যের শুরুতে আবরার ফাহাদের মৃত্যু-উত্তর নিজের ভূমিকার জন্য ক্ষমা চান ভিসি অধ্যাপক মো. সাইফুল ইসলাম। তিনি শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমার কিছুটা ভুল হয়েছে, আমার ভুল আমি স্বীকার করছি, আমি তোমাদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করছি। তোমরা আমাকে ক্ষমা করে দাও।’ ভিসি বলেন, ‘আবরার আমার সন্তানের মতো ছিল। তোমাদের যেমন কষ্ট লাগছে তার মৃত্যুতে আমারও অনেক খারাপ লেগেছে। এটি আমি মেনে নিতে পারিনি। তার মৃত্যুতে তোমরা যেমন দুঃখ পেয়েছ, আমিও পেয়েছি। আমরা সবাই মর্মাহত।’ এর আগে, আবরার ফাহাদ হত্যায় জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবিতে গতকাল সকাল থেকে টানা পঞ্চম দিনের মতো বিক্ষোভ করছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা। ১০ দফা দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় বুয়েট শহীদ মিনার চত্বরে সমবেত হলে স্লোগানে স্লোগানে উত্তাল হয়ে ওঠে ক্যাম্পাস। বিক্ষোভ মিছিল ও অবস্থান কর্মসূচির পাশাপাশি দুপুরে প্রতিবাদী পথনাটক ও গ্রাফিতি এঁকে কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া আবরার হত্যার বিচার দাবিতে একটি প্রতীকী বিতর্কের আয়োজন করা হয়। আবরারের লাশ পুঁজি করে কেউ নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চাইলে তাকে প্রতিহত করার হুঁশিয়ারি দেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলবে : শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিলেও আগামী ১৪ অক্টোবরের মধ্যে ৫ দাবি আদায়ে আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। গতরাত সাড়ে ১০টায় বুয়েট শহীদ মিনারে আনুষ্ঠানিকভাবে তারা এ ঘোষণা দেন। শিক্ষার্থীরা বলেন, আমাদের মোট ১০ দফা দাবি রয়েছে। এর মধ্যে পাঁচ দাবি বাস্তবায়ন হলে ১৪ অক্টোবর প্রথম বর্ষে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। দাবি বাস্তবায়ন না হলে ভর্তি পরীক্ষা বন্ধ থাকবে। শিক্ষার্থীরা জানান, ৫ দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক সব কাজ বন্ধ থাকবে। তবে প্রশাসনিক কাজ চলবে।

গতকাল পর্যন্ত দাবি আদায়ে আলটিমেটাম দিয়েছিলেন শিক্ষার্থীরা। দাবি না মানলে আজ (শনিবার) থেকে বুয়েটের সব ভবনে তালা ঝুলিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন তারা। আবরারের খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা, জড়িতদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আজীবন বহিষ্কার, আবরার হত্যা মামলার সব খরচ ও ক্ষতিপূরণ বুয়েট থেকে বহন, দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্বল্পতম সময়ে মামলা নিষ্পত্তি, অবিলম্বে অভিযোগপত্র প্রকাশ, বিভিন্ন সময়ে নির্যাতনে জড়িতদের ছাত্রত্ব বাতিল এবং বুয়েটে সাংগঠনিক ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি করেন শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া আবরার হত্যার বিচারসহ সাত দফা দাবি ছিল বুয়েট শিক্ষক সমিতির। সমিতির পক্ষ থেকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর বিভিন্ন নির্যাতনের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দীর্ঘদিনের নির্লিপ্ততা-নিষ্ক্রিয়তা, আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ এবং আবাসিক হলসমূহে নিরাপত্তা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে উপাচার্যের ধারাবাহিক অবহেলা ও ব্যর্থতার অভিযোগ আনা হয়। উপাচার্য স্বেচ্ছায় পদত্যাগ না করলে শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে সরকারের কাছে তাকে অপসারণের দাবি জানায় শিক্ষক সমিতি। দায়িত্বে ব্যর্থতার জন্য উপাচার্যের পদত্যাগ দাবি করেছিল বুয়েট অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনও।

সাময়িক বহিষ্কার : আবরার ফাহাদ হত্যা ঘটনায় সাময়িক বহিষ্কার ১৯ শিক্ষার্থী হলেনÑ মেহেদী হাসান, সিই বিভাগ (কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ১৩তম ব্যাচ), মুহতাসিম ফুয়াদ (১৪তম ব্যাচ, সিই বিভাগ), অনীক সরকার (১৫তম ব্যাচ), মেহেদী হাসান রবিন (কেমিক্যাল বিভাগ, ১৫তম ব্যাচ), ইফতি মোশাররফ হোসেন (বায়ো মেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৬তম ব্যাচ), মনিরুজ্জামান মনির (পানিসম্পদ বিভাগ, ১৬তম ব্যাচ), মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন (মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৫তম ব্যাচ), মাজেদুল ইসলাম (এমএমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), মোজাহিদুল (ইইই বিভাগ, ১৬তম ব্যাচ), তানভীর আহম্মেদ (এমই বিভাগ, ১৬তম ব্যাচ), হোসেন মোহাম্মদ তোহা (এমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), জিসান (ইইই বিভাগ, ১৬তম ব্যাচ), আকাশ (সিই বিভাগ, ১৬তম ব্যাচ), শামীম বিল্লাহ (মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), শাদাত (এমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), তানীম (সিই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), মোর্শেদ (এমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), মোয়াজ মনতাসির আল জেমি (এমআই বিভাগ)।

আবরার ফাহাদের কুলখানি : কুষ্টিয়া প্রতিনিধি জানান, গতকাল কুষ্টিয়ায় গ্রামের বাড়িতে আবরার ফাহাদের কুলখানি হয়েছে। বাদ জুমা পরিবারের পক্ষে রায়ডাঙ্গা জামে মসজিদে কুলখানির আয়োজন করা হয়। আবরারের পরিবারের সদস্য, প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন, রায়ডাঙ্গা গ্রামবাসীসহ সর্বস্তরের মানুষ এতে অংশ নেন। অনুষ্ঠানে আবরারের রুহের মাগফিরাত কামনায় দোয়া করা হয়। পরে পরিবারের সদস্যরা তার কবর জিয়ারত করেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর