শনিবার, ১২ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা

ভারতে পালানোর সময় পাগলা মিজান আটক

বিদেশি পিস্তল ও তিন লাখ টাকা জব্দ

নিজস্ব প্রতিবেদক

ভারতে পালানোর সময় পাগলা মিজান আটক

সরকারের চলমান শুদ্ধি অভিযানে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৩২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগ নেতা হাবিবুর রহমান মিজান ওরফে পাগলা মিজানকে র‌্যাব গ্রেফতার করেছে। গতকাল ভোরে তাকে মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলে গ্রেফতার করা হয়। র‌্যাব জানায়, এ সময় তার কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল ও প্রায় তিন লাখ টাকা জব্দ করা হয়েছে।

তার বিরুদ্ধে জমি দখল, প্রভাব বিস্তার, চাঁদাবাজি, ফ্রীডম পার্টির সঙ্গে সম্পৃক্ততা, খুন ও সন্ত্রাসে জড়িত থাকার বহু অভিযোগ রয়েছে। এসব কুকর্মের জন্য তিনি সম্প্রতি আলোচনায় ছিলেন।

ঢাকায় ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে আত্মগোপনে থাকা মিজান শ্রীমঙ্গল সীমান্ত হয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। এমন খবরের ভিত্তিতে শ্রীমঙ্গলের গুহ রোডের মৃত ফজলুর রহমানের বাসা থেকে তাকে ধরা হয়েছে। র‌্যাব সদর দফতরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লে. কর্নেল সারওয়ার বিন কাশেম জানান, চলমান জুয়া ও ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের অংশ হিসেবে হাবিবুর রহমান মিজানকে আটক করা হয়েছে। কাউন্সিলর মিজান দেশ ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করছেনÑ

এমন তথ্যের ভিত্তিতে শ্রীমঙ্গল থেকে ভোরে তাকে আটক করা হয়। র‌্যাব-২ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ জানান, গতকাল দুপুরেই মিজানকে ঢাকায় আনা হয়। এরপর তাকে নিয়ে তার লালমাটিয়ার কার্যালয় ও আওরঙ্গজেব রোডে তার বাড়িতে অভিযান চালানো হয়। শ্রীমঙ্গলে আটকের সময় একটি বিদেশি অস্ত্র, পাঁচ রাউন্ড গুলি ও নগদ তিন লাখ টাকা জব্দ করা হয়েছে। আশ্রয় দাত্রী মৃত ফজলুর রহমানের স্ত্রী নূরজাহান বেগম জানান, মিজান (পাগলা মিজান) তার মেয়ে জামাইয়ের বন্ধু। তার মেয়ের জামাই মোস্তাক আহম্মেদ সাত বছর আগে মারা গেছেন। বৃহস্পতিবার দুপুরে মিজান তাদের বাসায় আসেন। তার হাতে ছিল শুধু একটি ব্যাগ। এক রাত থেকে পরের দিন (শুক্রবার) সিলেটে মাজারে যাবেন বলেছিলেন মিজান। গত বছরও তিনি একবার এসে এক রাত থেকে পরের দিন মাজারে গিয়েছিলেন। মিজান খারাপ লোক জানলে তারা তাকে বাসায় ঢুকতেই দিতেন না। নূরজাহান বেগমের মেয়ে শিউলি বলেন, মিজানের বন্ধু ছিলেন আমার স্বামী। এই সুবাদে কয়েকবারই আমাদের বাসায় এসেছিলেন। তার কাছে হানিফ বাসের টিকিট দেখে বোঝা গেছে এবার তিনি বাসে করে এসেছেন। আগে আসতেন গাড়ি নিয়ে। এর আগে মঙ্গলবার রাতে রাজধানীর অর্থবিত্তে হঠাৎ করে ফুলেফেঁপে ওঠা পাগলা মিজানের মোহাম্মদপুরের বাড়িতে অভিযান চালায় র‌্যাবের একটি দল। রাত ১টা থেকে দেড়টা পর্যন্ত আওরঙ্গজেব রোডে পাগলা মিজানের বাড়ির বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে মিজানকে পাওয়া যায়নি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র জানায়, পাগলা মিজান ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী। তার বিরুদ্ধে সিটি করপোরেশনের ম্যানহোলের ঢাকনা চুরি থেকে শুরু করে মানুষ হত্যার মতো গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে তার বাসায় যারা হামলা করেছিল তার একজন পাগলা মিজান। অথচ সময়ের স্রোতে পাল্টে গেছে অনেক কিছু। ভোল পাল্টিয়েছেন তিনি। পাল্টে ফেলেছেন নামটিও। তিনি এখন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা। মোহাম্মদপুরে গড়ে তুলেছেন অপরাধ সাম্রাজ্য। মাদক কারবার থেকে শুরু করে খুনখারাবি পর্যন্ত নানা অপরাধমূলক কাজে তার নাম উঠে এসেছে বার বার। আওয়ামী লীগের এই নেতার বর্তমান নাম হাবিবুর রহমান মিজান ওরফে পাগলা মিজান হলেও আগে তার নাম ছিল মিজানুর রহমান মিজান। সূত্র জানায়, মহাজোট সরকার আমলে মিজান বাহিনী ৩০০-৪০০ কোটি টাকার শুধু টেন্ডারবাজি করেছে। এ ছাড়া ভূমি দখল, চাঁদাবাজিসহ মোহাম্মদপুর বিহারি ক্যাম্পে মাদক ও চোরাই গ্যাস-বিদ্যুতের ব্যবসার নিয়ন্ত্রক তিনি। স্থানীয়রা বলেন, খুনখারাবি তো পাগলা মিজানের বাম হাতের খেলা। ভয়ে এলাকায় তার বিরুদ্ধে কেউ কথাও বলে না। ২০১৪ সালে মোহাম্মদপুরে ৬৫ বছরের বৃদ্ধ বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আহমেদ পাইন ও তার অসুস্থ স্ত্রী মরিয়ম বেগমকে তুচ্ছ ঘটনায় শত শত মানুষের সামনে জুতাপেটা করেন এই পাগলা মিজান। সরকারের উচ্চপর্যায়ের অনেক নেতা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু অসৎ কর্মকর্তা তার অপকর্মে সহযোগিতা করেন। এ কারণে অপরাধ করেও তিনি পার পেয়ে যান সবসময়।

চলমান সন্ত্রাসবিরোধী সাঁড়াশি অভিযানের মধ্যেও একাধিক খুনের মামলা নিয়ে তিনি প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। তার নামে মোহাম্মদপুর থানায় ১৯৯৬ সালে ইউনূস হত্যা ও ২০১৬ সালে সাভার থানায় জোড়া হত্যার মামলা রয়েছে। গত বছর জমি দখলকে কেন্দ্র করে একদল সন্ত্রাসী মোহাম্মদপুর ঢাকা উদ্যানসংলগ্ন তুরাগ নদের ওপারে একটি রিয়েল এস্টেটের ছয় কর্মীকে গুলি এবং আরও ১৪ জনকে কুপিয়ে জখম করে। এ সময় সন্ত্রাসীরা জুয়েল নামের একজনকে হত্যা করে লাশ তুরাগে ফেলে দেয়। এ হত্যায়ও হাবিবুর রহমান মিজানের নাম উঠে এসেছে। শুধু তাই নয়, জমি জবরদখলেও সিদ্ধহস্ত তিনি। পাগলা মিজান শ্যামলী মাঠের পশ্চিম পাশের জমির একাংশ দখল করে বানিয়েছেন মার্কেট। সেখানে তিন শতাধিক দোকানঘর তুলে ব্যবসায়ীদের কাছে ভাড়া দিয়েছেন। সম্প্রতি মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে পুলিশের সঙ্গে ক্যাম্পবাসীর সংঘর্ষের নেপথ্যেও তার সম্পৃক্ততার তথ্য পাওয়া গেছে। মিজান ক্যাম্পের বিদ্যুৎ লাইন থেকে ক্যাম্প-লাগোয়া কাঁচাবাজার ও তিন শতাধিক মাছের দোকানে অবৈধ সংযোগ দিয়ে মাসে প্রায় পাঁচ লাখ টাকা আয় করতেন। এ কারণেই বিদ্যুৎ অফিসের সঙ্গে ক্যাম্পবাসীর ঝামেলার সূত্রপাত। জানা যায়, ১৯৭৪ সালে ঝালকাঠি থেকে ঢাকায় আসেন মিজানুর রহমান। শুরুতে মিরপুরে হোটেলবয়ের কাজ করতেন। এরপর মোহাম্মদপুরে ম্যানহোলের ঢাকনা চুরি শুরু করেন। চুরি করা সেই ঢাকনাই আবার বিক্রি করতেন সিটি করপোরেশনের কাছে। ১৯৭৫ সালের শেষ দিকে খামারবাড়ির খেজুরবাগানে ছিনতাই করতে গেলে পুলিশের ধাওয়া খেয়ে লালমাটিয়ায় মসজিদের পাশের পুকুরে ঝাঁপ দেন। পুলিশ বার বার নির্দেশ দিলেও তিনি পুকুর থেকে ওঠেননি। কয়েক ঘণ্টা পর কোনো কাপড় ছাড়াই উলঙ্গ অবস্থায় উঠে আসেন। এ কারণে পুলিশ তাকে ‘পাগল’ আখ্যা দিয়ে ছেড়ে দেয়। তখন থেকেই তার নাম হয় ‘পাগলা মিজান’। ওই বছরই ফ্রীডম পার্টিতে যোগ দেন তিনি। ফ্রীডম পার্টির সদস্য হিসেবে গেরিলা প্রশিক্ষণ নিতে লিবিয়া যান। ১৯৭৬ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাতবার্ষিকীতে আওয়ামী লীগ নেত্রী রেজিয়া বেগমের খাবারের পাত্র লাথি দিয়ে ফেলে দিয়ে প্রথমবারের মতো আলোচনায় আসেন মিজান। ’৮৯ সালের ১০ আগস্ট মধ্যরাতে ফ্রীডম পার্টির সদস্য কাজল ও কবিরের নেতৃত্বে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে হামলা চালায় একটি চক্র। তারা সেখানে গুলি করে এবং বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। এ সময় শেখ হাসিনা বাড়ির ভিতর অবস্থান করছিলেন। বাড়ির নিরাপত্তাকর্মীরা পাল্টা গুলি চালালে হামলাকারীরা পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় ধানমন্ডি থানায় মামলা হয়। ’৯৭ সালে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ১৬ জনকে আসামি করে মামলার অভিযোগপত্র দেয়। অভিযোগপত্রে মিজানুর রহমান ওরফে পাগলা মিজানকে হামলার পরিকল্পনাকারীদের একজন বলে উল্লেখ করা হয়। হামলাকারীদের মধ্যে মিজানের ছোট ভাই মোস্তাফিজুর রহমানও ছিলেন। শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা ব্যর্থ হওয়া এবং এরপর দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলে মিজানুর রহমান নিজের নাম পাল্টে হয়ে যান হাবিবুর রহমান মিজান। ফ্রীডম পার্টি ছেড়ে যোগ দেন আওয়ামী লীগে। তিনি এখন মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগের আলোচিত নেতা। ছিলেন আগের কমিটির সাধারণ সম্পাদক। গড়ে তুলেছেন বিশাল অপরাধ সাম্রাজ্য ও বিত্তের পাহাড়।

পাগলা মিজানের বাসায় অভিযান চালিয়ে ৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকার চেক ও ১ কোটি টাকার স্থায়ী আমানতের (এফডিআর) কাগজ জব্দ করেছে র‌্যাব। গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত মোহাম্মদপুরের আওরঙ্গজেব রোডের বাসায় অভিযান চালিয়ে এগুলো জব্দ করে র‌্যাব। র‌্যাব সদর দফরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলমের নেতৃত্বেই সেখানে অভিযান পরিচালনা করা হয়। এছাড়া বৃহস্পতিবার মিজান ব্যাংক থেকে ৬৮ লাখ টাকা তুলেছেন, এ সংক্রান্ত তথ্যও পেয়েছে র‌্যাব। কিন্তু এ টাকা কোথায় আছে, সেসব উদ্ধারেও কাজ করছে র‌্যাব।

সর্বশেষ খবর