বুধবার, ১৬ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা

বাড়ছে নৃশংস অপরাধ

মাহবুব মমতাজী ও জয়শ্রী ভাদুড়ী

সারা দেশে নৃশংস অপরাধ বেড়ে চলেছে। নিষ্ঠুরভাবে খুনের পাশাপাশি মানুষের প্রতি নির্মম অপরাধপ্রবণতা ছড়িয়ে পড়ছে। গতকাল সারা দেশ থেকে এক দিনের প্রাপ্ত খবরে ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে। স্বামীর হাতে স্ত্রী, স্ত্রীর হাতে স্বামী, মায়ের হাতে সন্তান, বাবার হাতে ছেলে, চাচার হাতে ভাতিজা, ভাইয়ের হাতে ভাই- ঘরের ভিতর-বাইরে এমনসব খুনোখুনি এখন স্বাভাবিক ঘটনায় রূপ নিচ্ছে। খুনের পর লাশ রাখা হচ্ছে শয়নকক্ষে, বাড়ির পাশে ঝোপে, রাস্তায়, বালুর ভিতর, বস্তার ভিতর, কাদার ভিতর, পানির ট্যাংকে, ড্রেনে কিংবা ডাস্টবিনে। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক দ্বন্দ্বই অধিকাংশ খুনের কারণ। গত সাত দিনেই অন্তত ১০টি নৃশংসতার ঘটনা ঘটে। গত সোমবার রাতে খোদ ঢাকার উত্তরখানে চাচাতো ভাইয়ের ছুরিকাঘাতে নিহত হয়েছে রিয়াদ হোসেন ওরফে সাগর (১৪) নামে এক কিশোর। পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে সারা দেশে খুন হয়েছে ১৭ হাজারের বেশি মানুষ। একই সময়ে রাজধানীতে খুন হয়েছে ১ হাজারের বেশি। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর পেছনে অন্যতম কারণ পরকীয়া, জমিসংক্রান্ত বিরোধ ও মাদকের অর্থ জোগাড়। ইন্টারনেটের অপব্যবহার. অসহিষ্ণুতা, অতিমাত্রার ক্ষোভ, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক বৈষম্য, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণেও মানুষের মাঝে দিন দিন মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে নিষ্ঠুরতা। তুচ্ছ কারণে অসহিষ্ণু হয়ে খুনের ঘটনা ঘটাচ্ছে। তবে বীভৎস বিকৃত খুনের ঘটনার বেশির ভাগই ঘটছে অপেশাদার খুনিদের মাধ্যমে। পুলিশের তথ্যানুযায়ী, গত পাঁচ বছরে সারা দেশে খুনের ঘটনা ঘটেছে ১৬ হাজার ৯৭৪টি। এর মধ্যে ২০১৭ সালে খুন হয়েছে ৩ হাজার ৫৪৯, ২০১৬ সালে ৮৭৯, ২০১৫ সালে ৪ হাজার ৩৫, ২০১৪ সালে ৪ হাজার ৫২৩ আর ২০১৩ সালে ৩ হাজার ৯৮৮ জন। ২০১৮ সালের প্রথম তিন মাসে খুন হয়েছে ৮৭৪ জন। এ ছাড়া শুধু রাজধানীতেই খুন হয়েছে ১ হাজার ১২ জন। এর মধ্যে ২০১৭ সালে ২১৮, ২০১৬ সালে ৪৮, ২০১৫ সালে ২৩৯, ২০১৪ সালে ২৬২ আর ২০১৩ সালে ২৪৫ জন। পুরান ঢাকার বিশ্বজিৎ, সিলেটের খাদিজা, ফেনীর নুসরাত, বরগুনার রিফাত, নরসিংদীর ফুলন রানী, বুয়েটের আবরারের পর সুনামগঞ্জের পাঁচ বছরের শিশু তুহিন মিয়ার ওপর ঘটেছে নৃশংসতা। দিনে, দুপুরে, রাতে নারকীয় ও রোমহর্ষক খুনের শিকার তারা। গত রবিরার রাতে সুনামগঞ্জে পাঁচ বছরের শিশু তুহিন মিয়াকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় পরদিন তুহিনের মা মনিরা বেগম অজ্ঞাত ১০-১২ জনের বিরুদ্ধে দিরাই থানায় হত্যা মামলা করেন। এরপর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয় তুহিনের বাবা, চার চাচা, চাচাতো ভাই, এক চাচি ও এক চাচাতো বোনকে। গতকাল বিকালে সুনামগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক শ্যামকান্ত সিনহা শিশু তুহিনকে নৃশংসভাবে হত্যার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে তার বাবা আবদুল বাছির, চাচা আবদুল মছব্বির ও প্রতিবেশী চাচা জমশেদ আলীর তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

পুলিশ জানায়, কদম গাছের ডালে ঝুলছিল শিশু তুহিনের নিথর দেহ। পেটে ঢোকানো ছিল দুটি লম্বা ছুরি। তার দুটি কান ও যৌনাঙ্গ কেটে ফেলা হয়। এই শিশুর বাড়ি সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার রাজানগর ইউনিয়নের কেজাউরা গ্রামে। গত ৬ অক্টোবর বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকান্ডে র ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে চারজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। গত ৩ অক্টোবর অপহৃত হয় পাপ্পু নামে এক কিশোর। এ ঘটনায় বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুঁজির পর না পেয়ে ৮ অক্টোবর যাত্রাবাড়ী থানায় সাধারণ ডায়েরি (ডিজি) করেন তার মা রুনা পারভীন রুনু। তবে এই জিডির সূত্র ধরেই রহস্য উন্মোচন করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। যাত্রাবাড়ীর পূর্ব ধোলাইপাড়ে গলা টিপে পাপ্পুকে হত্যার পর বস্তায় লাশ ঢুকিয়ে ৫০ কেজি ওজনের বই নেওয়া হয়। এরপর পিকআপে করে ওই বস্তা নিয়ে যাওয়া হয় লৌহজংয়ে। সেখানে পদ্মা রিসোর্ট থেকে ৫০০ গজ দক্ষিণ দিকে পদ্মার শাখা নদীর তীরে বস্তাটি নদীতে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। ১ অক্টোবর গাজীপুরে একটি বাড়িতে ঢুকে আবদুর রউফ (৬০) নামে এক ব্যক্তিকে হত্যা করে স্বর্ণালঙ্কার লুট হয়। ২৯ সেপ্টেম্বর কিশোরগঞ্জ সদরে নানি জয়নব বিবিকে (৭০) ছুরিকাঘাতে হত্যা করে কিশোর নাতি (১৪)। ১৭ জুলাই রাতে কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ায় স্মৃতি আক্তার রিমা (১৪) নামে এক কিশোরীকে প্রেমের জালে ফাঁসিয়ে সংঘবদ্ধভাবে ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা ঘটে। হত্যার পর লাশ গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয় বলে অভিযোগ করেন স্বজনরা।

এর আগেও চলতি বছরের ২৬ জুন বরগুনায় খুনের শিকার হন শাহনেওয়াজ ওরফে রিফাত শরিফ (২৬)। প্রকাশ্যে দিবালোকে ফিল্মস্টাইলে রামদা দিয়ে কুপিয়ে তাকে হত্যা করে খুনিরা। এ ঘটনার পর দিন নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে শিশু সন্তানের সামনে রাসেল ভূঁইয়া (৩২) নামে একজনকে কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা করে সন্ত্রাসীরা। ৬ এপ্রিল ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১০ এপ্রিল রাতে মারা যান নুসরাত। ২১ এপ্রিল রাজধানীতে গৃহবধূ জান্নাতি আক্তারের শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেন শ্বশুরবাড়ির লোকজন। ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর কেরানীগঞ্জের বেউতা এলাকায় মালয়েশিয়াপ্রবাসী আল-আমিনের বাড়িতে সাভারের ভাকুর্তা এলাকার কবিরাজ মফিজুর রহমানকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। পরে ৮ থেকে ১০ টুকরা করে প্রতিবেশীর মাগুর মাছের খামারসহ বিভিন্ন স্থানে ফেলে রাখা হয়। একই বছরের ২ নভেম্বর ঢাকার বাড্ডার হোসেন মার্কেট এলাকার ময়নার টেকের একটি বাসায় স্বামী জামিল শেখ ও মেয়ে নুসরাতকে খুন করেন আরজিনা বেগম ও তার কথিত প্রেমিক শাহীন মল্লিক। আগের রাত ১ নভেম্বর কাকরাইলে পারিবারিক কলহের কারণে খুন হন মা শামসুন্নাহার ও ছেলে সাজ্জাদুল করিম শাওন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর