শনিবার, ২৬ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা

স্থবিরতা কাটছে না ঐক্যফ্রন্টে

ভারতবিরোধী কর্মসূচি চান না ড. কামাল, ক্ষুব্ধ শরিকরা

মাহমুদ আজহার

একাদশ জাতীয় নির্বাচনের পর জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে শুরু হওয়া স্থবিরতা এখনো কাটছে না। স্থবিরতা কাটিয়ে ওঠার জন্য ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের করা সর্বসাম্প্রতিক কয়েকটি চুক্তির বিরোধিতা করে ফ্রন্টগতভাবে কর্মসূচি দেওয়ার চিন্তাভাবনা করা হয়। কিন্তু ড. কামাল হোসেন এতে সায় দেননি। এ নিয়ে ড. কামালের চেম্বারে একাধিকবার বৈঠক করে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন ফ্রন্টের শীর্ষ নেতারা। তাতেও লাভ হয়নি। তিনি নেতাদের সাফ জানিয়ে দেন, ভারতবিরোধী কোনো কর্মসূচিতে তিনি থাকবেন না। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ হয় বিএনপি, জেএসডি ও নাগরিক ঐক্য। এরপর বুয়েট ছাত্র আবরার হত্যার প্রতিবাদে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের ঘোষণা দেয় ঐক্যফ্রন্ট। ঘোষণায় বলা হয়েছিল, অনুমতি না পেলেও কর্মসূচি পালন করা হবে। জানা যায়, বিএনপির হাইকমান্ডের অনীহার কারণে শেষ পর্যন্ত সে কর্মসূচি থেকেও সরে আসে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। ফ্রন্টের শীর্ষ নেতারা অবশ্য বলছেন, ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম উদ্যোক্তা বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দেশের বাইরে ছিলেন। তার ২১ অক্টোবর দেশে ফেরার কথা ছিল। কিন্তু ফিরতে দেরি হয়েছে। তাই নাগরিক শোক সমাবেশ স্থগিত করা হয়েছে। আবার কেউ কেউ বলছেন, অনুমতিই মেলেনি, কীভাবে করা হবে সমাবেশ! ২১ অক্টোবর বিকালে বেগম জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি চেয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে দেখা করে এসে জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেন, ‘অনুমতি না পেলেও যে কোনো মূল্যে নির্ধারিত সময়ে সমাবেশ হবে।’ এর কিছুক্ষণ পর ঐক্যফ্রন্ট থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলা হয়, সমাবেশ স্থগিত করা হয়েছে। ঐক্যফ্রন্টের শরিক দল নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনের পর থেকে ঐক্যফ্রন্ট পুরোপুরি কার্যকর তা বলা যাবে না। কয়েকটি বৈঠক হলেও তা ফলপ্রসূ বলা যাবে না। বিএনপি নিজেই মামলা-হামলাসহ নানা হয়রানিতে রয়েছে। নিজেদের সমস্যা নিয়ে জর্জরিত। তা ছাড়া ইস্যুভিত্তিক কর্মসূচি নিয়েও ভিন্নমতের কারণে কর্মসূচি ঠিকমতো হচ্ছে না। তবে আশা করছি, সামনে ফ্রন্টগতভাবে কর্মসূচি আসবে।’ জানা যায়, নির্বাচনের আগে থেকেই ড. কামালের সঙ্গে বিএনপির টানাপোড়েন চলছে। ড. কামালও ক্ষুব্ধ বিএনপির ওপর। একাদশ জাতীয় নির্বাচনের সময় জামায়াতের হাতে ধানের শীষ প্রতীক তুলে দেওয়ার পর থেকেই ড. কামালের সঙ্গে বিএনপির মতবিরোধ বাড়ে। এখনো তাদের সম্পর্কের বরফ গলেনি। এদিকে ড. কামালের বিভিন্ন বক্তব্যের তীব্র সমালোচনাও হয় বিএনপি নেতা-কর্মীদের মধ্যে। বিএনপি নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, সভা-সমাবেশে নানা বক্তব্যে তিনি বার বার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম উচ্চারণ করেন অথচ একবারও বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবি করেন না। তাই চিরকুট পাঠিয়ে তাকে মুক্তির দাবি স্মরণ করিয়ে দিতে হয়। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের নাম তো তিনি নেনই না। ঐক্যফ্রন্ট কার্যকর নয়, এমন অভিযোগ তুলে এরই মধ্যে ফ্রন্ট ছেড়েছে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ। বিএনপির নীতিনির্ধারক পর্যায়ের একাধিক নেতা জানান, এ মুহূর্তে জোট-ফ্রন্টের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক খুব বেশি জোরদার করার কোনো কারণ নেই। একাদশ জাতীয় নির্বাচন শেষ হয়েছে। এখন বিএনপি দল গোছানোর কাজেই ব্যস্ত। বেগম জিয়ার মুক্তি দাবিতে বিএনপি দলগতভাবে কর্মসূচি দিয়ে যাচ্ছে। এভাবে আরও কিছুদিন চলবে। প্রয়োজনে ফ্রন্ট ও জোটের সঙ্গে মিলেও কিছু কর্মসূচি দেওয়া হবে। ফ্রন্টকে পুরোপুরি কার্যকরে আরও বেশকিছু দিন লাগবে। বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বিএনপি এখন দল গোছানোয় ব্যস্ত। একই সঙ্গে আমাদের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবিতেও আমরা মাঠে সরব। আবরার হত্যা নিয়েও আমরা দলীয়ভাবে দুই দিনের কর্মসূচি পালন করেছি। জোট-ফ্রন্টের সঙ্গে আমাদের দূরত্ব নেই। তাদের সঙ্গে বৈঠকও হচ্ছে, যোগাযোগ আছে। কর্মসূচিও হবে। তবে আপাতত দলীয়ভাবে আমরা কর্মসূচি পালন করছি।’ সূত্রমতে, নির্বাচনের আগে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটি গঠনের শুরুতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ স্থায়ী কমিটির প্রভাবশালী দুই সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ অংশ নিতেন। একপর্যায়ে তারা ফ্রন্টের বৈঠকে যাওয়া বন্ধ করে দেন। পরে যুক্ত করা হয় স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও ড. আবদুল মঈন খানকে। এর মধ্যে একটি বৈঠকেও যাননি গয়েশ্বর রায়। এরপর নতুন সদস্য যুক্ত করা হয় স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুকে। তিনিই এখন নিয়মিত যাচ্ছেন। এমনকি দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও এখন ঐক্যফ্রন্টের বৈঠকে অংশ নেন না। তা ছাড়া ঐক্যফ্রন্টের ঢাকা মহানগরীর সমন্বয় কমিটিতে বিএনপির প্রভাবশালী দুই ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লা বুলু ও মোহাম্মদ শাহজাহানসহ চার নেতা অংশ নিতেন। তারাও এখন সমন্বয় সভায় অংশ নেন না। জানা যায়, দলগত কর্মসূচিতে বিএনপি নেতা-কর্মীদের সরব উপস্থিতি থাকলেও ঐক্যফ্রন্টের কর্মসূচিতে তারা কম আসেন। গত রবিবার আবরার হত্যার প্রতিবাদে এক অনুষ্ঠানে ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন তার দীর্ঘ বক্তৃতায় বেগম জিয়ার মুক্তি নিয়ে কথা বলেননি। একপর্যায়ে বিএনপির অনেক নেতা-কর্মী বেরিয়ে যেতে শুরু করেন। পরে অবশ্য বক্তৃতার শেষ মুহূর্তে স্লিপ পাঠানো হলে তিনি বেগম জিয়ার মুক্তি দাবি করেন। এ কারণে বিএনপির তৃণমূল নেতা-কর্মীরা ক্ষুব্ধ ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতাদের ওপর। তাই ঐক্যফ্রন্টের কোনো কর্মসূচিতে যোগ দিতে চান না তারা। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ঐক্যফ্রন্টে সমস্যা চলছে, এটা গোপন কিছু নয়। তবে ঐক্যফ্রন্টকে এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমি মনে করি, বিএনপি নেতৃত্বকে গতিশীল করতে কাউন্সিল জরুরি। তাহলেই বিএনপি চাঙা হবে। গণফোরামে এর আগে কোনো রাজনীতিই ছিল না। ঐক্যফ্রন্টকে ঘিরে এ দলটি জীবিত হয়। এখন সবাই মিলে ফ্রন্টকে চাঙা করতে হবে।’

সর্বশেষ খবর