রবিবার, ২৭ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা

অপরাধের দায় নেবে না দল

আওয়ামী লীগের আটক ও বিতর্কিতদের বহিষ্কার, অবৈধ সম্পদের অধিকারী ও গডফাদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা

রফিকুল ইসলাম রনি

দলীয় পদ-পদবি বিক্রি করে চাঁদাবাজি, অবৈধ টেন্ডার বাণিজ্যসহ অপরাধকান্ডে জড়ালে তার দায় নেবে না আওয়ামী লীগ। দলীয় সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ব্যাপারে জিরো টলারেন্সে। দলীয় ব্যানারে অপরাধে জড়ালে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ প্রক্রিয়ায় গত দেড় মাসে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে ওয়ার্ড কাউন্সিলর, ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাসহ দুই শতাধিক নেতার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ও আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ক্যাসিনোকান্ডে জড়িত থাকা এবং অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে কয়েকজন এমপির ব্যাংক হিসাব জব্দ করাসহ তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক। দেশব্যাপী পরিচালিত এ অভিযানের তালিকা আরও বড় হতে পারে বলে জানা গেছে। সূত্রমতে, টানা পৌনে ১১ বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতাদের অনেকেই পদ-পদবি ব্যবহার করে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। একেকজন হয়ে উঠেছেন অপরাধ জগতের গডফাদার। টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, মাদক ব্যবসাসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছেন তারা। কেউ কেউ কমিটি বাণিজ্য করেও কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। দলের কিছু এমপি এলাকায় স্বঘোষিত ‘সম্রাট’। তাদের ইশারা ছাড়া কিছুই হয় না। নিজের আধিপত্য ধরে রাখতে ফ্রীডম পার্টি, বিএনপি ও জামায়াত-শিবির থেকে নেতা ভাড়া করে জায়গা করে দিয়েছেন আওয়ামী লীগে। এসব অপরাধীর এখন লাগাম টেনে ধরছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ১৮ অক্টোবর থেকে দুর্নীতি ও ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

চলমান দুর্নীতি-অনিয়মবিরোধী শুদ্ধি অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত রবিবার গণভবনে যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠকে তিনি বলেছেন, ‘যাদের  বিরুদ্ধে ক্যাসিনো কারবার, অনিয়ম, দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে, তাদের সবাইকে অভিযানের আওতায় আনা হবে। কে আমার আত্মীয়, কে আমার দলের বড় নেতা- তা দেখে অভিযান থামবে না। আমার আত্মীয়রাও পার পাবেন না। অভিযান চলছে, চলবে।’  ব্যক্তির দায় সংগঠন নেবে না জানিয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সংগঠনের নাম ভাঙিয়ে কেউ অপরাধ করলে সে দায় দল নেবে না। যারাই পদ-পদবি ব্যবহার করে অপকর্ম করবে, দলের বদনাম করবে তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কারণ দু-একজন ব্যক্তির জন্য দল বা সংগঠন কলুষিত হোক এটা মেনে নেওয়া হবে না। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জিরো টলারেন্সে।’ গত ১৪ সেপ্টেম্বর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে চাঁদাবাজিসহ টেন্ডার কাজে ভাগ নেওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করায় দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে। এরপর শুরু হয় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ভিতরে শুদ্ধি অভিযান। এর ধারাবাহিকতায় টেন্ডারবাজি নিয়ন্ত্রণ, অবৈধ অস্ত্র নিয়ে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ানো, ক্যাসিনো পরিচালনাসহ নানা অভিযোগে র‌্যাবের হাতে আটক হন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। সঙ্গে সঙ্গে তাকে বহিষ্কার করা হয়। এর ধারাবাহিকতায় গ্রেফতার হন কৃষক লীগের সদস্য ও কলাবাগান ক্রীড়া চক্রের সভাপতি শফিকুল ইসলাম ফিরোজ, প্রভাবশালী যুবলীগ নেতা জি কে শামীম, কৃষক লীগ নেতা শফিকুল আলম, গেন্ডারিয়ার আওয়ামী লীগ নেতা এনামুল হক এনু, রুপম ভূঁইয়া। ক্যাসিনো পরিচালনার অভিযোগে সবশেষ গ্রেফতার করা হয় ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটকে। তার সঙ্গে তার অন্যতম সহযোগী এনামুল হক আরমানকেও গ্রেফতার করে র‌্যাব। গ্রেফতারকৃত প্রত্যেককেই স্ব স্ব সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।  ক্যাসিনোকান্ডে বিতর্কিত বক্তব্য দিয়ে আলোচিত-সমালোচিত হন যুবলীগ চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ওমর ফারুক চৌধুরী। কয়েক দিনের মাথায় তার বিরুদ্ধেও অনিয়মের অভিযোগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে তার ব্যাংক হিসাব তলব করা হয়। ওমর ফারুকের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞাও দেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ গত রবিবার তাকে যুবলীগের চেয়ারম্যান পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এর আগে অবৈধ সম্পদ অর্জন, সংগঠনের শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে যুবলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয় পিয়ন থেকে দফতর সম্পাদক হওয়া কোটিপতি কাজী আনিসকে।

চলমান ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে বিভিন্ন সময় আলোচনায় আসেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা মো. আবু কাওছার। তিনি ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের সভাপতি। অভিযানের প্রথম দিকেই ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে অভিযান চালিয়ে ক্যাসিনোর সরঞ্জাম উদ্ধার করে র‌্যাব। কয়েক দিন আগে স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা কাওছার, তার স্ত্রী পারভীন লুনা, মেয়ে নুজহাত নাদিয়া নিলা ও তাদের প্রতিষ্ঠান ফাইন পাওয়ার সলিউশন লিমিটেডের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়েছে। গত বুধবার তাকে স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতির পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। নিজ নির্বাচনী এলাকায় নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ায় স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে এবং সংগঠনের সম্মেলন প্রক্রিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে পঙ্কজ দেবনাথকে। এর আগেও একাধিকবার দলের নেতা-কর্মীদের শোধরাতে বলেছিলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু বিতর্কিত নেতারা গা করেননি। বরং লাগামহীনভাবে বিতর্কিত কর্মকান্ডে  জড়িয়ে দলকে প্রশ্নের মুখোমুখি করেছেন। দল ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদের পাশাপাশি ক্যাসিনোকা- ও নানা অপকর্মের কারণে ইতিমধ্যে চট্টগ্রাম-১২ আসনের সরকারদলীয় এমপি এবং জাতীয় সংসদের হুইপ শামসুল হক চৌধুরী, ভোলা-৩ আসনের এমপি নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন, সুনামগঞ্জ-১ আসনের এমপি মোয়াজ্জেম হোসেন রতনের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। একই সঙ্গে তাদের বিদেশযাত্রায় দেওয়া হয়েছে নিষেধাজ্ঞা। তাদের অবৈধ সম্পদের ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক।  আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী ফোরাম নেতারা বলছেন, দলের পদ-পদবি ব্যবহার করে এলাকায় গডফাদারগিরি করার দিন শেষ। যারাই অপকর্মে জড়িয়ে পড়বে তাদের বিরুদ্ধেই অ্যাকশন। শুধু দলীয় পদ থেকে বহিষ্কার কিংবা অব্যাহতিই নয়, আইনগত ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হচ্ছে।  রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর সাহসী পদক্ষেপের ফলে দলের নাম ব্যবহার করে যারা অপকর্মে জড়িয়েছেন তারা সতর্ক হচ্ছেন। অপরাধীদের কাছে পরিষ্কার বার্তা যাচ্ছে, অপকর্ম করে শেখ হাসিনার আমলে কেউ রেহাই পাবেন না।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর