রবিবার, ২৭ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা

অপরাধ সাম্রাজ্যে কাউন্সিলররা

সাঈদুর রহমান রিমন

অপরাধ সাম্রাজ্যে কাউন্সিলররা

মাদক, চাঁদা আর দখলবাজিতে ভাগ্য ফিরিয়েছেন রাজধানী ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের দুই ডজন ওয়ার্ড কাউন্সিলর, যাদের বেশির ভাগই আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মী। কাউন্সিলর আর দলীয় পদ-পদবি ব্যবহার করে তাদের বেশির ভাগই হয়েছেন জিরো থেকে হিরো। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে শুদ্ধি অভিযান শুরুর পর থেকে এসব অভিযুক্ত কাউন্সিলরের আর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। গোয়েন্দা নজরদারিতে আছেন ঢাকা সিটি করপোরেশনের উত্তর ও দক্ষিণের এসব কাউন্সিলর। তাদের বেশির ভাগই গা-ঢাকা দিয়েছেন, কেউ কেউ পাড়ি জমিয়েছেন বিদেশে।

হত্যা, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, মদ, জুয়া, নারী কেলেঙ্কারি,  জুলুম, অত্যাচারসহ নানা ধরনের গুরুতর অভিযোগ আছে তালিকাভুক্ত ওই ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের বিরুদ্ধে। তাদের সম্পর্কে একটা তদন্ত প্রতিবেদনও তৈরি করেছে গোয়েন্দা সংস্থা।

জানা গেছে, বিভিন্ন দল থেকে ভুঁইফোড় নেতারা ক্ষমতাসীন দলে যোগ দিয়ে ওয়ার্ড কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েই অঢেল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। যে কোনো সময় গ্রেফতার হতে পারেন আরও কয়েকজন ওয়ার্ড কাউন্সিলর। বেশ কয়েকজন কাউন্সিলর আরও আগে থেকেই সিটি করপোরেশনের কর্মকা- থেকে বিরত রয়েছেন। হাজির হচ্ছেন না করপোরেশনের সভায়ও। সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, আইন অনুযায়ী যারা একাধারে তিন থেকে আটটি সভায় অনুপস্থিত থাকছেন, তালিকা তৈরি করে তাদের বিরুদ্ধে বরখাস্ত করার প্রক্রিয়া চলছে। একাধারে তিন সভায় অনুপস্থিত থাকার কারণে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর এ কে এম মমিনুল হক সাঈদকে ইতিমধ্যে বরখাস্ত করা হয়েছে। সন্ত্রাসী কর্মকা- ও মাদক ব্যবসায় ভাগ্য ফেরানোর অভিযোগ উঠেছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ওইসব কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় যাদের নাম উঠে এসেছে তারা হচ্ছেন- দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) আনিসুর রহমান আনিস (ওয়ার্ড-২), মমিনুল হক সাঈদ (ওয়ার্ড-৯), মোহাম্মদ হোসেন (ওয়ার্ড-৫৬), আবদুল বাসিত খান বাচ্চু (ওয়ার্ড-৭), মোস্তফা জামান পপি (ওয়ার্ড-১৩), ফরিদ উদ্দিন রতন (ওয়ার্ড-২০), তরিকুল ইসলাম সজীব (ওয়ার্ড-২২) ও ময়নুল হক মঞ্জু (ওয়ার্ড-৩৯)। উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) অভিযুক্তরা হচ্ছেন- রজ্জব হোসেন (ওয়ার্ড-৬), হাবিবুর রহমান মিজান (ওয়ার্ড-৩২) ও তারেকুজ্জামান রাজীব (ওয়ার্ড-৩৩)। ইতিমধ্যে নজরদারিতে থাকাবস্থায় গ্রেফতার হয়েছেন ডিএনসিসির ৩২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজান ওরফে পাগলা মিজান। সম্প্রতি ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সিলেট থেকে র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়েছেন তিনি। ক্যাসিনো সম্রাটের সহযোগী খ্যাত আরেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজীব (ওয়ার্ড-৩৩) গ্রেফতার হয়েছেন রাজধানীর ভাটারা এলাকা থেকে। ডিএসসিসির ৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর এ কে এম মমিনুল হক সাঈদ অভিযানের শুরুতেই গ্রেফতার এড়াতে সিঙ্গাপুর পালিয়ে গেছেন। সূত্র জানায়, ক্যাসিনো, মাদক ব্যবসা, ফুটপাথ ও পরিবহন সেক্টরে চাঁদাবাজি, দখলদারির সঙ্গে জড়িত মোট অর্ধশতাধিক কাউন্সিলরের তালিকা করা হয়েছে। যাদের সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া শুরু করেছে গোয়েন্দারা। তালিকায় থাকা কাউন্সিলরদের অনেকেই মালয়েশিয়া, দুবাই, ইউরোপ-আমেরিকায় গড়ে তুলেছেন সেকেন্ড হোম। সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে আলোচিত ক্যাসিনো জুয়া আর মাদকের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে অন্তত সাতজন কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে। এরমধ্যে মমিনুল হক সাঈদ, মোস্তফা জামান পপি, ফরিদ উদ্দিন রতন, আনিসুর রহমান আনিস ও তারেকুজ্জামান রাজীব।  ক্যাসিনোতে জড়িত থাকা নিয়ে সবচেয়ে আলোচিত হয়ে ওঠা তারেকুজ্জামান রাজীব উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড (মোহাম্মদপুর এলাকা) কাউন্সিলর। জানা গেছে, বছর কয়েক আগেও রাজীবের বাবা তোতা মিয়া ও তার তিন ভাই রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন ঢাকা শহরে। এখন তাদের সবারই আছে বাড়ি-গাড়ি। ঢাকা সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর হয়ে খুব অল্প সময়ে অঢেল সম্পত্তির মালিক হয়ে উঠেছেন রাজীব। গত চার বছরে তিনি মার্সিডিজ, বিএমডব্লিউ, ক্রাউন প্রাডোসহ ১০টির বেশি নামিদামি ব্র্যান্ডের গাড়ি কিনেছেন। গুলশান, বনানী, বারিধারায় একাধিক ফ্ল্যাট কিনেছেন তিনি। ফ্ল্যাট রয়েছে তার বিদেশেও। এ ছাড়া গত কয়েক বছরে তিনি ১৫-২০টি প্লট ও ফ্ল্যাট দখল করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ডিএসসিসির ১৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোস্তফা জামান পপি পল্টন থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি। কাউন্সিলর ও দলীয় পদের প্রভাব খাটিয়ে গুলিস্তান, পল্টন, কাকরাইল, শান্তিনগর, রাজারবাগ, মৌচাক ও মালিবাগ এলাকার সব ফুটপাথ নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ এই কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে। ডিএসসিসির ২২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. তরিকুল ইসলাম সজীব ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তার বিরুদ্ধে হাজারীবাগ কোম্পানিঘাট মসজিদ মার্কেট দখল করে ভাড়া-বাণিজ্য, ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে মোটা অঙ্কের চাঁদা আদায়, ফুটপাথ থেকে চাঁদাবাজি এবং মাদক ব্যবসায়ীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ৫৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোহাম্মদ হোসেনের রয়েছে বিশাল ক্যাডার বাহিনী। সাধারণ মানুষের জমি, খাসজমি, নদীর তীর, খেয়াঘাট, ট্রলারঘাট, রাস্তা, ফুটপাথ, মার্কেট এলাকার সবই তার বাহিনীর দখলে বলে অভিযোগ রয়েছে। একসময় তিনি বিএনপি নেতা নাসিরউদ্দিন আহম্মেদ পিন্টুর ক্যাডার ছিলেন। কাউন্সিলর হওয়ার আগেও কামরাঙ্গীরচরে একটি টিনশেড বাড়িতে থাকতেন। তার শ্বশুর বিএনপি নেতা রফিক ওরফে বানচাল রফিক এলাকায় পিন্টুর ক্যাডার হিসেবে পরিচিত। কাউন্সিলর হওয়ার পর হোসেনের অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। তিনি কামরাঙ্গীরচরের হুজুরপাড়া নূরজাহান স্কুলের সামনে ১০ কাঠা জমিতে বিলাসবহুল বাড়ি করেছেন। এ ছাড়া আশ্রাফাবাদ দশআনী বাজারে সাত কাঠা জমি, ইসলামনগর মদিনাবাগ মসজিদের সামনে ছয়তলা বাড়িসহ বিপুল সম্পত্তির মালিক। ২০১৫ সালে চাঁন মসজিদ এলাকায় আবদুল মোতালেব নামে এক পুলিশ সদস্যকে মারধরের অভিযোগ পাওয়া যায় হোসেনের বিরুদ্ধে। কিল, ঘুষি, লাথি মারার একপর্যায়ে ওই পুলিশ সদস্যের ইউনিফর্ম ছিঁড়ে নেওয়ার পাশাপাশি বাঁশি ছিনিয়ে নিয়ে উল্লাস করতে থাকে হোসেনের লোকজন। পরে খবর পেয়ে এএসআই রায়হানসহ অতিরিক্ত পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে মোতালেবকে উদ্ধার করে।  ডিএসসিসির ৩০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. হাসান পিল্লু স্থানীয় এমপি হাজী সেলিমের ভাগ্নে। তার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে পুরান ঢাকার সোয়ারীঘাটসহ আশপাশের এলাকা। ওইসব এলাকায় যত মালবাহী বাহন রয়েছে, সেগুলোর নিয়ন্ত্রক তিনি। এ থেকে মাসে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। ডিএসসিসির ২০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফরিদ উদ্দিন আহমেদ রতনের বিরুদ্ধে ডিএসসিসির মার্কেট দখল, চাঁদাবাজিসহ বহু অভিযোগ রয়েছে। ক্যাসিনো জুয়ার সবচেয়ে পুরনো ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত গুলিস্তানের মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন তিনি। এ ছাড়া কাউন্সিলর হয়েও তিনি অবৈধ দাপট খাটিয়ে অন্য একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে ডিএসসিসির বিভিন্ন ঠিকাদারি কাজ বাগিয়ে নিয়েছেন। ডিএসসিসির ২৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাসিবুর রহমান মানিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ গুরুতর। ডিএসসিসির প্রকল্পের কাজে বাধা দিয়ে ঠিকাদারের কাছ থেকে বড় অঙ্কের অর্থ আদায়, এলাকার দোকান, মার্কেটসহ বিভিন্ন স্থাপনা থেকে চাঁদা আদায় ও মাদক ব্যবসায় সহযোগিতা করাসহ নানা অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্ত করছেন সংশ্লিষ্টরা। ডিএনসিসির ৩০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবুল হাসেম হাসুর বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ পেয়েছেন তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা। এসব অভিযোগের মধ্যে আছে প্রভাবশালীদের নাম ভাঙিয়ে এলাকায় জনগণকে ভীতি প্রদর্শন, মাদক, জবরদখল ও চাঁদাবাজির পৃষ্ঠপোষকতা করা।

সর্বশেষ খবর