সোমবার, ২৮ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা

আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের বাড়িতে অভিযান

বিপুল পরিমাণ বিদেশি মদ, সিসা ও ক্যাসিনোর সামগ্রী উদ্ধার

নিজস্ব প্রতিবেদক

আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের বাড়িতে অভিযান

আজিজ মোহাম্মদ ভাই। রাজধানীর গুলশানের বাড়ি থেকে উদ্ধার করা বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য -বাংলাদেশ প্রতিদিন

বহুল আলোচিত ও বিতর্ক সৃষ্টিকারী ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের ঢাকার গুলশানের বাসায় ‘মিনি বার’-এর সন্ধান পাওয়া গেছে। বার থেকে বিপুল পরিমাণ বিদেশি মদ, বিয়ারসহ সিসা উদ্ধার করা হয়েছে। সেই সঙ্গে উদ্ধার করা হয়েছে ক্যাসিনোর সরঞ্জাম। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর গতকাল গুলশান দুই নম্বরে আজিজ মোহাম্মদ ভাই এবং তার বোনের বাসায় অভিযান চালিয়ে এসব উদ্ধার করে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর জানিয়েছে, মাদকবিরোধী অভিযানের অংশ হিসেবে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের বাসায় অভিযান চালানো হয়। আজিজ মোহাম্মদ ভাই বাংলাদেশে নেই। দীর্ঘ ১২ বছর ধরে তিনি বিদেশে অবস্থান করছেন।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক খুরশিদ আলম সাংবাদিকদের জানান, গুলশান-২-এর ৫৭ নম্বর রোডের ১১/এ বাসায় এ অভিযান চালানো হয়। এ সময় সেখান থেকে বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য ও ক্যাসিনোর সরঞ্জাম পাওয়া গেছে। উদ্ধার হওয়া মাদকের মধ্যে রয়েছে ৪০০ বোতল মদ, তিন কেজি সিসার ফ্লেভার এবং অন্যান্য উপকরণ। এ ছাড়া পাওয়া গেছে ক্যাসিনোর সরঞ্জাম ও বিট কয়েন। এ সময় বাসা থেকে দুজন দারোয়ানকে আটক করা হয়। তিনি জানান, অভিযানে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের বাসার ভিতরে ক্যাসিনো ও ছাদে মিনি বার পাওয়া গেছে। এ ছাড়া পাওয়া গেছে বিপুল পরিমাণ মদের বোতল ও সিসার উপকরণ। আজিজ মোহাম্মদ ভাই একজন বাংলাদেশি ব্যবসায়ী। তিনি হত্যা ও মাদক পাচারসহ বেশ কয়েকটি গুরুতর অপরাধে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ৫০টির মতো চলচ্চিত্র প্রযোজনা করেছেন তিনি।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের উপ-পরিদর্শক মোশারফ হোসেন বলেন, ‘আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের বাসার ছাদে যে ক্যাসিনোটি পাওয়া যায়, এতে ডলারের মাধ্যমে খেলা হতো। সম্প্রতি রাজধানীতে যতগুলো ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে, সব জায়গায় দেখা গেছে খেলা হতো টাকা দিয়ে। কিন্তু এখানে খেলা হতো ১ সেন্ট থেকে শুরু করে ১০০ ডলারের কয়েন দিয়ে। এতেই বোঝা যায়, এখানে খুব হাই প্রোফাইল মানুষরা খেলতে আসতেন।

কে এই আজিজ মোহাম্মদ ভাই : আজিজ মোহাম্মদ ভাই একজন বাংলাদেশি ব্যবসায়ী হলেও তিনি আদতে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর তাদের পরিবার ভারতের গুজরাট থেকে বাংলাদেশে আসে। ধনাঢ্য এই পরিবার পুরান ঢাকায় বসবাস শুরু করে। তাদের পরিবার মূলত পারস্য বংশোদ্ভূত। তারা ‘বাহাইয়ান’ সম্প্রদায়ের লোক। ‘বাহাইয়ান’কে সংক্ষেপে ‘বাহাই’ বলা হয়। উপমহাদেশের উচ্চারণে এই ‘বাহাই’ শব্দটি পরবর্তী সময়ে ‘ভাই’ হয়ে যায়।

১৯৬২ সালে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের জন্ম হয় আরমানিটোলায়। আজিজ মোহাম্মদ ভাই তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে ইস্পাত প্রযোজকের পরিচালনায় সক্রিয়ভাবে নিযুক্ত ছিলেন। তিনি সার্ক চেম্বার অব কমার্সের আজীবন সদস্য। অলিম্পিক ব্যাটারি, অলিম্পিক বলপেন, অলিম্পিক ব্রেড ও বিস্কুট, এমবি ফার্মাসিটিউক্যাল, এমবি ফিল্ম ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের মালিক আজিজ মোহাম্মদ ভাই। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, হংকং, সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়ায় রয়েছে তার হোটেল ও রিসোর্ট ব্যবসা।

ব্যাংককে আছেন আজিজ মোহাম্মদ ভাই : বাংলাদেশের একসময়ের আলোচিত ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাই থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। সঙ্গে আছেন স্ত্রী নওরীন ও সন্তানরা। দেশের সঙ্গে দীর্ঘদিন বিচ্ছিন্ন থাকলেও নিয়মিত ঢাকায় ব্যবসার খোঁজ রাখছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে ঢাকা থেকে মাঝেমধ্যেই অনেক নামিদামি মডেল ও তারকা পাড়ি জমান ব্যাংককে। আড্ডা দেন আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সঙ্গে। আড্ডায় উঠে আসে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনীতি, চলচ্চিত্র জগৎসহ সবকিছু। পরিবার নিয়ে ব্যাংককে থাকলেও ইন্দোনেশিয়ার বালি, সিঙ্গাপুর, দুবাইসহ বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়ান আজিজ মোহাম্মদ ভাই। নানা জটিলতার কারণে দীর্ঘদিন দেশে না ফেরা ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের জীবনযাপনে আসেনি কোনো পরিবর্তন। পরিবার-পরিজন নিয়ে উচ্ছলতার সঙ্গেই কাটে তার প্রবাসজীবন।

দেশ ছাড়ার পর বিদেশে পর্যটন ব্যবসা শুরু করেন তিনি। এর অংশ হিসেবে তিনি বিদেশে রিসোর্ট ব্যবসা করছেন। ইন্দোনেশিয়ার বালি, সিঙ্গাপুর, দুবাই ও থাইল্যান্ডে রয়েছে তার বিশাল রিসোর্ট। ব্যবসার প্রয়োজনে এসব দেশে ঘন ঘন যাতায়াত করেন আজিজ মোহাম্মদ ভাই। থাইল্যান্ডে বসবাস করলেও ইন্দোনেশিয়া, দুবাই, সিঙ্গাপুরেও তার বাড়ি রয়েছে। আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো জানিয়েছেন, থাইল্যান্ডে গিয়ে তিনি প্রথমে ওঠেন পাতায়ার একটি রিসোর্টে। সেখান থেকেই তিনি দেশের খবর রাখতেন। ওয়ান-ইলেভেনের আগের দিন ২০০৭ সালের ১০ জানুয়ারি দেশ ছাড়েন রহস্যময় এ ব্যবসায়ী। অনেকের ধারণা, আলোচিত এই ব্যবসায়ী আগেভাগেই ওয়ান-ইলেভেনের খবর পেয়ে গিয়েছিলেন।

গ্রেফতারও হয়েছিলেন : বাংলাদেশের রহস্যময় পুরুষ বলা হয়ে থাকে তাকে। আজিজ মোহাম্মদ ভাইকে নিয়ে নানা মুখরোচক গল্পও রয়েছে। তবে সব গল্পেই রয়েছে নারী চরিত্র। নারী ছাড়া আজিজ মোহাম্মদ ভাই চলাফেরাও করেন না বলে কথিত রয়েছে। আজিজ মোহাম্মদ ভাইকে রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে প্রথম গ্রেফতার করা হয়েছিল। তাকে মুক্ত করতে আগা খান, প্রিন্স করিম আগা খান নিজেই বাংলাদেশে এসেছিলেন।

১৯৯৭ সালে জনপ্রিয় চিত্রনায়ক সালমান শাহকে হত্যা করার অভিযোগ ওঠে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের বিরুদ্ধে। যদিও হত্যাকান্ডের সময় থাইল্যান্ডে ছিলেন আজিজ। সালমানের মৃত্যু আত্মহত্যা বলে ময়নাতদন্তের রিপোর্ট ও পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে। কিন্তু সালমান শাহর মায়ের অভিযোগ, এটি হত্যাকা-। সালমান শাহর মৃত্যুর দুই বছর পর ১৯৯৯ সালে ঢাকা ক্লাবে খুন হন আরেক চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী। এ হত্যাকান্ডেও আজিজ মোহাম্মদ ভাই ও তার পরিবারের জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে। সেবার তিনি গ্রেফতারও হয়েছিলেন।

১৯৯৬ সালে প্রতারণার মাধ্যমে শেয়ারবাজার থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ ও আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের বিরুদ্ধে মামলা করে বিএসইসি। এই শেয়ার কেলেঙ্কারির মামলায় গত বছর ২৯ আগস্ট আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা (ওয়ারেন্ট) জারি করে ঢাকার একটি ট্রাইব্যুনাল। এখন তিনি পলাতক।

সর্বশেষ খবর