রবিবার, ৩ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

সর্বগ্রাসী চাঁদাবাজি দেশজুড়ে

যেখানে-সেখানে গ্রুপ দৈনিক সাপ্তাহিক মাসিক হারে আদায় চাঁদাবাজির শীর্ষে পরিবহন খাত পুলিশ লোভী নেতা ও জনপ্রতিনিধিদের পৃষ্ঠপোষকতায় ওরা বেপরোয়া

সাঈদুর রহমান রিমন

সর্বগ্রাসী চাঁদাবাজি দেশজুড়ে

রাজধানীর ফুটপাথ থেকে শুরু করে বহুতল ভবন পর্যন্ত সর্বত্রই চলে চাঁদাবাজি। পরিবহন, ডিস, ইন্টারনেট প্রোভাইডার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি-কোচিং বাণিজ্যসহ অনিয়ম-দুর্নীতি টিকিয়ে রাখার কর্মকান্ডেও নিয়মিত চাঁদা দিতে হয়। এসব চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িয়ে আছে পাঁচ শতাধিক সিন্ডিকেটের কয়েক হাজার অপরাধী। নির্বিঘ্নে চাঁদাবাজি সংঘটনের সুযোগ সৃষ্টিসহ নেপথ্যের ইন্ধনদাতা হিসেবে রয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ সদস্য ও ক্ষমতাসীন দলের লোভী নেতা। নানা সিন্ডিকেটে বিভক্ত চাঁদাবাজরা নিজেদের রক্ষাকবচ হিসেবে ব্যবহার করছে ‘লীগের সাইনবোর্ড’। ফলে স্থানীয় প্রশাসনও তাদের চাঁদাবাজি রোধের ঝক্কিঝামেলায় পা বাড়ায় না। আবার অনেক ক্ষেত্রে থানা পুলিশের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সহায়তা নিয়েই চলে বাধাহীন চাঁদাবাজি। এমনকি পরিবহন সেক্টরে চাঁদাবাজির শেষ নেই। থানার চাঁদা, ফাঁড়ির চাঁদা, ঘাট চাঁদা, স্পট চাঁদা, বোবা চাঁদা, বেকার ভাতা, ক্লাব খরচা, নিরাপত্তা ফি, শ্রমিক কল্যাণ ফান্ড, মাস্তান ভাতা, নেতার সম্মানী, মহল্লা চাঁদা, অফিস সালামি ইত্যাদি নানা নামে নানা ঢঙে বছরজুড়ে চলে চাঁদার উৎসব।

ফুটপাথেই কোটি কোটি টাকার চাঁদাবাজি : রাজধানীর ফুটপাথে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে লাইনম্যান নামধারীরা হরদম চাঁদা তোলে। গুলিস্তান, পল্টন, বায়তুল মোকাররম, মৌচাক-মালিবাগ, শান্তিনগরসহ আশপাশের ফুটপাথে চলে কয়েক কোটি টাকার চাঁদাবাজি। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, শুধু গুলিস্তান-পল্টন নয়, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটির আড়াই শতাধিক পয়েন্টে ফুটপাথ এবং ২৩টি স্থানে অবৈধ হাটবাজার বসিয়ে চাঁদাবাজরা কোটি কোটি টাকা চাঁদা তুলছে। ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী, পুলিশ আর চাঁদাবাজ সিন্ডিকেট এসব টাকা ভাগাভাগি করে নেয়। শুধু রাজধানী নয়, দেশের প্রতিটি নগর-মহানগর, এমনকি জেলা শহর পর্যায়েও ফুটপাথে চাঁদাবাজি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় পর্যায়ের নেতা-কর্মী, পুলিশের সোর্স, মাস্তান-লাইনম্যানরা ফুটপাথের চাঁদাবাজিতে সরাসরি জড়িত থাকলেও বিভিন্ন স্থানে ওয়ার্ড কাউন্সিলররা চাঁদাবাজির নেপথ্যে থাকেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ভয়ঙ্কর তথ্য হচ্ছে, এ কাজে পিছিয়ে নেই পুলিশও।

পরিবহন সেক্টরে বিস্তৃত চাঁদাবাজি : রাজধানী ও আশপাশের বিভিন্ন রুটের প্রায় ১৫ হাজার বাস থেকে প্রতিদিন ৬ কোটি টাকা চাঁদাবাজির অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রতিদিন সারা দেশে পরিবহনের ১৯টি খাতে চাঁদাবাজি ঘটে প্রায় ১২ কোটি টাকার। পরিবহন মালিক, শ্রমিক ও নেতাদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, পরিবহন শ্রমিক সংগঠনের নামে, মালিক সমিতির নামে ও বিভিন্ন রুট কমিটির ব্যানারে অপ্রতিরোধ্য চাঁদাবাজি ঘটছে বছরের পর বছর। অন্যদিকে পুলিশের নাম করেও পরিবহন খাত থেকে দৈনিক প্রায় ৩ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ট্রাফিক সার্জেন্টরা টাকা তোলেন মাসোহারা হিসেবে। এ ছাড়া আছে বেকার ভাতা, রাস্তা ক্লিয়ার ফি, ঘাট ও টার্মিনাল সিরিয়াল, পার্কিং ফি নামের অবৈধ চার্জ। এমন নানা নামে, নানা কায়দায় চলছে এ চাঁদাবাজির ধকল। 

নিষিদ্ধ গাড়ির অফুরন্ত চাঁদা : রাজধানীর প্রতিটি থানা এলাকায় কয়েক হাজার টেম্পো ও হিউম্যান হলার চলাচল করে। স্থানভেদে যাত্রী পরিবহনের এসব যান থেকে প্রতিদিন ২০০ থেকে ৪০০ টাকা করে চাঁদা তোলা হয়। টেম্পো বা হিউম্যান হলার থেকে সবচেয়ে বেশি চাঁদাবাজি হয় মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর, বাড্ডার শাহজাদপুর, ফার্মগেট, গুলিস্তান, যাত্রাবাড়ী, শনিরআখড়া, জুরাইন রেলগেট, নিউমার্কেট, আজিমপুর, নয়াপল্টন, মোহাম্মদপুর, গাবতলী, মিরপুর মাজার রোড, উত্তরখান, দক্ষিণখান ও খিলক্ষেত এলাকায়। 

ঘাটে ঘাটে চাঁদাবাজি : সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, কল-কারখানা, দেশি-বিদেশি ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে হাসপাতাল, ক্লিনিক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষক, মসজিদের ইমাম, রিকশাচালক, কুলিশ্রমিক কেউ চাঁদাবাজির ধকল থেকে রেহাই পাচ্ছে না। সম্প্রতি বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের অবসর সুবিধা বোর্ড ও কল্যাণ ট্রাস্টের চাঁদার হার ১০ শতাংশ করার প্রতিবাদে চূড়ান্ত আন্দোলনের ঘটনাও ঘটে। রাজধানীর বৃহত্তম পাইকারি আড়ত কারওয়ান বাজার এখন চাঁদাবাজদের অভয়ারণ্য। মাসে এখানে চাঁদাবাজির পরিমাণ ১০ কোটি টাকারও বেশি। প্রায় ২৪ ঘণ্টা নানা বাহানায় এখানে চলে চাঁদা উত্তোলন। সরেজমিন কারওয়ান বাজার ঘুরে ও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে পাওয়া গেছে চাঁদাবাজির এসব তথ্য। প্রতিদিন কারওয়ান বাজারে আসা চার শতাধিক পণ্যবাহী ট্রাক ঢোকে। প্রতিটি থেকে চাঁদা তোলা হয় ১০০ থেকে ৩০০ টাকা করে। ট্রাক থেকে পণ্য নামিয়ে যেসব ভ্যানে তোলা হয়, সেগুলোকে চাঁদা দিতে হয় ৫০ টাকা করে। আবার পিকআপে লোড করতে হলেও পাইকারদের চাঁদা গুনতে হয়। পাঁচ হাজার পাইকারের কাছ থেকে প্রতি রাতে জনপ্রতি ১০০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা হাতিয়ে নেওয়া হয়। সড়ক ও ফুটপাথে প্রতি রাতে এক হাজারের বেশি সবজির অস্থায়ী দোকান বসে। তিন বর্গফুট আয়তনের ভাসমান দোকানের জন্য চার হাজার ও ছয় বর্গফুটের দোকানের জন্য মাসে ১০ হাজার টাকা ‘ভাড়া’ দিতে হয়।

অরক্ষিত নৌপথ, ঘাটে ঘাটে চাঁদা : প্রায় ছয় হাজার কিলোমিটার সচল নৌপথে নিবন্ধনকৃত ১০ সহস্রাধিক যাত্রী ও পণ্যবাহী নৌযান চলাচল করে থাকে। নিবন্ধনের বাইরে রয়েছে আরও প্রায় ২৫ হাজার ছোট ও মাঝারি শ্রেণির নৌযান। নৌপরিবহন মালিক ও শ্রমিক সমিতিগুলোর তথ্যমতে, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সীমান্ত থেকে জ্বালানি ও নির্মাণসামগ্রী পরিবহনকারী পাঁচ হাজার বাল্কহেড নৌযান ও কার্গো ভয়াবহ চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছে। একেকটি মালবাহী নৌযানকে সীমান্ত থেকে ঢাকায় পৌঁছতে ঘাটে ঘাটে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। একেকটি পয়েন্টে প্রতিটি মালবাহী নৌযান থেকে ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকা করে চাঁদা তুলছে। সুনামগঞ্জ-ঢাকা নৌপথের ১০-১২টি স্থানে চাঁদাবাজরা নৌশ্রমিকদের নির্যাতন চালিয়ে টাকা হাতিয়ে নেয়। চাঁদাবাজির মূল পয়েন্টগুলো হচ্ছে সুনামগঞ্জের ছাতক, তাহিরপুরের আনোয়ারপুর, জামালগঞ্জের লালপুর, খালিয়াজুড়ির (নেত্রকোনা) লিপসা, ইটনার (কিশোরগঞ্জ) এলংজুড়ি, নিকলীর ছাতিরচর, গজারিয়ার (মুন্সীগঞ্জ) মেঘনাঘাট, নারায়ণগঞ্জের ধর্মগঞ্জ, পাগলা ও কাঁচপুর। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে মেঘনা নদীতে পুলিশের নামে ৬০০ টাকা, সোনারগাঁর বৈদ্যেরবাজারে বিআইডব্লিউটিএর নামে ২ থেকে ৩ হাজার, গজারিয়ায় মেঘনা সেতু থেকে ত্রিমোহনা পর্যন্ত ২ থেকে ৩ হাজার, মুক্তারপুর সেতুর আশপাশে ৫০০ থেকে ১ হাজার, কামরাঙ্গীরচরে রাসেল গ্রুপের নামে ২ থেকে ৩ হাজার টাকা করে চাঁদা নেওয়া হচ্ছে। 

৩০ খাতের চাঁদায় ধনাঢ্য অনেকে : ঢাকা মহানগরসহ সারা দেশের জেলা-উপজেলা পর্যায়েও একশ্রেণির নেতা চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, লুটপাটসহ অপরাধ-অপকর্মের অপ্রতিরোধ্য গডফাদার হয়ে উঠেছে। তারা এলজিইডি, গ্যাস, বিদ্যুৎ বিভাগসহ বিভিন্ন সরকারি দফতরের টেন্ডারবাজি, মাদক বাণিজ্য পরিচালনা ও পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান, ছিনতাইকারী-ডাকাত গ্রুপগুলোকে শেল্টার, জায়গাজমি দখল-বেদখল, গার্মেন্টসহ মিল-কারখানার চাঁদাবাজি, অস্ত্র ভাড়া প্রদান, ভাড়াটে কিলিং, পাওনা টাকা আদায়সহ নানা বিরোধ মেটানোর নামে অন্তত ৩০টি খাত থেকে চাঁদাবাজি চালিয়ে থাকে। গুলশান এলাকায় জমির মালিকের সঙ্গে ডেভেলপার কোম্পানির বিরোধ মিটিয়ে দেওয়ার এক ঘটনাতেই যুবলীগের বিতর্কিত এক নেতা ৭ কোটি টাকা চাঁদা হাতিয়ে নিয়েছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সামান্য ফুটপাথ দোকানিও যুবলীগ, শ্রমিক লীগ কিংবা স্বেচ্ছাসেবক লীগের নাম লিখিয়ে বড় বড় বালুমহাল দখল করে নিয়েছেন। প্রতিদিন তাদের আয়ের পরিমাণ ২ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত উঠছে। বালুমহাল দখলের বাণিজ্য চলছে রাজধানীসহ জেলায় জেলায়। যুবলীগের সাইনবোর্ড ব্যবহার করে মাত্র পাঁচ-সাত বছরে রাজধানীর উত্তরা এলাকাতেই দুই ডজন ভবঘুরে যুবক এখন শত কোটি টাকার মালিক বনে গেছে। ফুটপাথ বরাদ্দ, জায়গাজমি জবরদখল, নিষিদ্ধ অটোরিকশাসহ পরিবহনে চাঁদাবাজি, অবৈধ কোচ টার্মিনাল স্থাপনসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকা-কে পুঁজি করে তারা রাতারাতি শত শত কোটি টাকার মালিক হয়ে উঠেছে।

সর্বশেষ খবর