রবিবার, ৩ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

ভয়ঙ্কর জেলহত্যার সেই দিন

তোফায়েল আহমেদ

ভয়ঙ্কর জেলহত্যার সেই দিন

যেদিন কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়, সেদিন আমি ময়মনসিংহ কারাগারে বন্দী। ভয়ঙ্কর-বিভীষিকাময় দুঃসহ জীবন তখন আমাদের! ময়মনসিংহ কারাগারের কনডেম সেলে-ফাঁসির আসামিকে যেখানে রাখা হয়-সেখানেই আমাকে রাখা হয়েছিল। সহ-কারাবন্দী ছিলেন ‘দি পিপল’ পত্রিকার এডিটর জনাব আবিদুর রহমান। যিনি ইতিমধ্যে এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেছেন। আমরা দুজন দুটি কক্ষে ফাঁসির আসামির মতো জীবন কাটিয়েছি। হঠাৎ খবর এলো, কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। কারাগারের সবাইকে সতর্ক করা হয়েছে। কারারক্ষীরা সতর্ক। ময়মনসিংহ কারাগারের জেল সুপার ছিলেন নির্মলেন্দু রায়। চমৎকার মানুষ ছিলেন তিনি। কারাগারে আমরা যারা বন্দী ছিলাম তাদের প্রতি তিনি ছিলেন সহানুভূতিশীল। বঙ্গবন্ধুও তাকে খুব স্নেহ করতেন। বঙ্গবন্ধু যখন বারবার কারাগারে বন্দী ছিলেন, নির্মলেন্দু রায় তখন কাছ থেকে বঙ্গবন্ধুকে দেখেছেন। বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী হয়ে নির্মলেন্দু রায়কে কাছে টেনে সব সময় আদর করতেন। সেদিন গভীর রাতে হঠাৎ নির্মলেন্দু রায় আমার সেলে এসে বলেন, ‘ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার মিস্টার ফারুক-যিনি এখন প্রয়াত-আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এত রাতে কেন? তিনি বললেন, ‘ঢাকা কারাগারে আপনাদের প্রিয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। আমরা কারাগারের চতুর্দিক পুলিশ দ্বারা বেষ্টন করে রেখেছি, জেল পুলিশ ঘিরে রেখেছে। এসপি সাহেব এসেছেন আপনাকে নিয়ে যেতে।’ আমি বললাম, না, এভাবে তো যাওয়ার নিয়ম নেই। আমাকে যদি হত্যাও করা হয়, আমি এখান থেকে এভাবে যাব না। পরবর্তীকালে শুনেছি সেনাবাহিনীর একজন মেজর নাম আরিফ, সেই জেলখানার সামনে এসে কারাগারে প্রবেশের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু নির্মলেন্দু রায় বলেছিলেন, ‘আমি অস্ত্র নিয়ে কাউকে কারাগারে প্রবেশ করতে দেব না।’ কারাগারের চতুর্পার্শ্বে সেদিন যারা আমাকে রক্ষার জন্য ডিউটি করছিলেন তাদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগে আমার সহপাঠী জনাব ওদুদ-আমরা একসঙ্গে এমএসসি পাস করেছি এবং দেশ স্বাধীনের পর ৭৩-এ যিনি সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেছিলেন-নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কারাগারকে রক্ষা করার জন্য। আমি নির্মলেন্দু রায় এবং ওদুদের কাছে ঋণী।

ছাত্র জীবন থেকে আমি জাতীয় চার নেতাকে নিবিড়ভাবে দেখেছি। তাঁদের আদরে-স্নেহে আর রাজনৈতিক শিক্ষায় সমৃদ্ধ হয়ে জীবন আমার ধন্য। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট যেদিন জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করা হয়, আমরা সেদিন নিঃস্ব হয়ে গিয়েছি। যাঁর নেতৃত্বে আমরা দেশ স্বাধীন করেছি, যাঁর জন্ম না হলে এ দেশ স্বাধীন হতো না, তাঁকে বাংলার মাটিতে এভাবে জীবন দিতে হবে এটা আমরা কখনোই ভাবিনি। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর জাতীয় চার নেতাসহ আমরা ছিলাম গৃহবন্দী। ১৫ আগস্টের পরদিন আমার বাসভবনে খুনিরা এসে আমাকে তুলে রেডিও স্টেশনে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে আমার ওপর অকথ্য নির্যাতন করা হয়। পরবর্তীতে জেনারেল সফিউল্যাহ এবং প্রয়াত ব্রিগেডিয়ার শাফায়াত জামিল-তিনি তখন ঢাকার ব্রিগেড কমান্ডার তাদের প্রচেষ্টায় রেডিও স্টেশন থেকে আমাকে বাড়িতে আমার মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। মায়ের কথা খুব মনে পড়ে। আমাকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার সময় মা বেহুঁশ হয়ে পড়ে গিয়েছিলেন। মায়ের শরীরের ওপর দিয়েই আমায় টেনে নিয়েছিল ঘাতকের দল। পরদিন শাফায়াত জামিল এবং মেজর সাখাওয়াত হোসেন (পরবর্তীতে নির্বাচন কমিশনার, অব.) আমার গৃহবন্দী অবস্থায় বাসায় এসে আমার সঙ্গে অনেক কথা বলেন। আমার ওপর যে অমানুষিক নির্যাতন হয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধা শাফায়াত জামিল নিজের লেখা বইতে সে সব উল্লেখ করেছেন। পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডিআইজি ই এ চৌধুরীর মাধ্যমে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি শ্রদ্ধেয় নেতা জিল্লুর রহমান এবং আমাকে বঙ্গভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে খুনি খোন্দকার মোশতাক আমাদের ভয়-ভীতি দেখান এবং বলেন, যদি তাকে সহযোগিতা না করি তাহলে তিনি আমাদের রক্ষা করতে পারবেন না। আমি উত্তর দিয়েছিলাম, আমাদের আপনার রক্ষা করতে হবে না। আমাদের ওপর যে চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল তা উপেক্ষা করে আমরা খুনি মোশতাকের সব প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিলাম। আগস্টের ২২ তারিখ জাতীয় চার নেতাসহ আমাদের অনেক বরেণ্য নেতাকে গ্রেফতার করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়েছিল হত্যা করার জন্য। যে কোনো কারণেই হোক ঘাতকের দল শেষ পর্যন্ত হত্যা করেনি। পরে নেতৃবৃন্দকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। গৃহবন্দী অবস্থা থেকে একদিনে আমাকে, জিল্লুর রহমান, ও আবদুর রাজ্জাককে গ্রেফতার করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কোণে অবস্থিত পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ছয় দিন বন্দী রেখে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছিল। পুলিশ কন্ট্রোল রুম থেকে খুনিচক্র আমাকে রেডিও স্টেশনে নিয়ে চোখ ও হাত-পা চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে নির্মম নির্যাতন করে অর্ধমৃত অবস্থায় পুনরায় পুলিশ কন্ট্রোল রুমে রেখে আসে। পরদিন সিটি এসপি আবদুস সালাম ডাক্তার এনে আমার চিকিৎসা করান। পরে আমাকে ও আবিদুর রহমানকে ময়মনসিংহ কারাগারে এবং জিল্লুর রহমান ও প্রিয়নেতা রাজ্জাক ভাইকে কুমিল্লা কারাগারে প্রেরণ করা হয়।

ময়মনসিংহে কারারুদ্ধকালে জেলখানার জাতীয় চার নেতা হত্যাকান্ডের নিষ্ঠুর দুঃসংবাদটি শুনে মন ভারাক্রান্ত হয় ও অতীতের অনেক কথাই মানসপটে ভেসে ওঠে।  জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান জাতীয় চার নেতার কত অবদান। স্মৃতির পাতায় তার কত কিছুই আজ ভেসে ওঠে। দল পুনরুজ্জীবনের পর ’৬৪তে আওয়ামী লীগের সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু পুনরায় সাধারণ সম্পাদক এবং তাজউদ্দীন আহমেদ সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। ’৬৬-এর ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে যে সর্বদলীয় নেতৃসম্মেলনে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেন, সেই সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাজউদ্দীন ভাই যোগদান করেন। বঙ্গবন্ধু ছয় দফা দেওয়ার পর ফেব্রুয়ারির ১৮, ১৯ ও ২০ তারিখ হোটেল ইডেনে আওয়ামী লীগের সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু মুজিব সভাপতি, তাজউদ্দীন আহমদ সাধারণ সম্পাদক, সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রথম সহসভাপতি, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী অন্যতম সহসভাপতি এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামান নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। বঙ্গবন্ধু যোগ্য লোককে যোগ্যস্থানে বসাতেন। সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তাজউদ্দীন আহমদ পরম নিষ্ঠার সঙ্গে অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেন। আমরা ’৬৬-এর ৭ জুন হরতাল পালন করেছিলাম। সফল হরতাল পালন শেষে এক বিশাল জনসভায় সৈয়দ নজরুল ইসলাম যে ঐতিহাসিক বক্তৃতা দিয়েছিলেন, তা আজো আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বাঙালির ছয়দফা তথা স্বাধিকার কর্মসূচি বাস্তবায়নে বঙ্গবন্ধুর ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে অপূর্ব সুন্দর বক্তৃতা করেছিলেন। তিনি ছিলেন অনলবর্ষী বক্তা, তাজউদ্দীন আহমেদ দক্ষ সংগঠক এবং কামারুজ্জামান সাহেব পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের এমএনএ হিসেবে পার্লামেন্টে প্রদত্ত ঐতিহাসিক ভাষণে বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণের তথা স্বাধিকারের দাবি তুলে ধরতেন। ’৬৮তে কারাগারে থাকা অবস্থাতেই তাজউদ্দীন ভাই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে পুনর্নির্বাচিত হন। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের ফলশ্রুতিতে তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান।

’৬৯-এর গণআন্দোলনের সময় দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ কারাগারে বন্দী ছিলেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাইরে ছিলেন। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে মরহুম আহমেদুল কবীরের বাসভবনে Democratic Action Committee সংক্ষেপে DAC-এর সভা চলছিল। সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ১১ দফা দাবি নিয়ে জাতীয় নেতৃবৃন্দের কাছে গিয়েছিলাম। আমি যখন ১১ দফা কর্মসূচি ব্যাখ্যা করছি তখন ন্যাপ নেতা মাহমুদুল হক কাসুরি ১১ দফা কর্মসূচি সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে বলেছিলেন, ‘তোমরা ১১ দফা কর্মসূচিতে শেখ মুজিবের ছয়দফা হুবহু যুক্ত করেছ। সুতরাং, তোমাদের ১১ দফা সমর্থনে প্রশ্ন আসবে।’ তার এই বক্তব্যের পর বলেছিলাম, আমরা বাঙালিরা কিভাবে অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হয় তা জানি। আপনারা সমর্থন না করলেও এই ১১ দফা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমরা বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে প্রিয়নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে কারাগার থেকে মুক্ত করব। আমার এই দৃপ্ত উচ্চারণের পর সৈয়দ নজরুল ইসলাম আমায় বুকে টেনে পরম আদরে বলেছিলেন, ‘তোমার বক্তব্যে আমি আনন্দিত ও গর্বিত।’ ’৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচনে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ এবং কামারুজ্জামান সাহেব পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে কে কোন পদে পদায়িত হবেন বঙ্গবন্ধু তা নির্ধারণ করে রেখেছিলেন। ’৭০-এর নির্বাচনে আমিও মাত্র ২৭ বছর বয়সে এমএনএ নির্বাচিত হয়েছিলাম। ’৭১-এর ২৩ ফেব্রুয়ারি পার্লামেন্টারি পার্টির মিটিংয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জাতীয় পরিষদ নেতা, সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপনেতা, তাজউদ্দীন আহমদ পার্লামেন্টারি পার্টির নেতা এবং কামারুজ্জামান সাহেব সচিব, চিফ হুইপ পদে জনাব ইউসুফ আলী এবং হুইপ পদে যথাক্রমে আবদুল মান্নান এবং ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম নির্বাচিত হন। আর প্রাদেশিক পরিষদে নেতা নির্বাচিত হন ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হলে মনসুর আলী হবেন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী। এজন্য মনসুর আলী সাহেবকে বঙ্গবন্ধু প্রাদেশিক পরিষদে মনোনয়ন দিয়েছিলেন। এভাবেই বঙ্গবন্ধুর সেটআপ করা ছিল। কিন্তু ’৭১-এর ১ মার্চে পূর্বঘোষিত জাতীয় পরিষদ অধিবেশন জেনারেল ইয়াহিয়া খান কর্তৃক একতরফাভাবে স্থগিত হলে বঙ্গবন্ধুর ডাকে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলনের প্রথম পর্ব। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে সর্বাত্মক স্বাধীনতা ঘোষণার পর শুরু হয় অসহযোগের দ্বিতীয় পর্ব। বিশ্বে এমন অসহযোগ কখনো দেখেনি কেউ! বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার নেতৃত্বে গঠিত আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড সূচারুরূপে পরিচালনা করেছেন অসহযোগের প্রতিটি দিন। আমাদের প্রয়াত নেতা খুলনার মোহসীন সাহেবের লালমাটিয়াস্থ বাসভবনে বসে আমরা কত পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। অসহযোগ আন্দোলন চলাকালেই বঙ্গবন্ধু ঠিক করে রেখেছিলেন আমরা কে কোথায় গেলে কি সাহায্য পাব। ’৭১-এর ১৮ ফেব্রুয়ারি আমাদের চারজনকে বঙ্গবন্ধু ডেকে পাঠালেন ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে। সেখানে জাতীয় চার নেতাও ছিলেন। বঙ্গবন্ধু আমাদের বললেন, ‘পড়ো, মুখস্থ কর।’ আমরা মুখস্থ করলাম একটি ঠিকানা, ‘সানি ভিলা, ২১, রাজেন্দ্র্র রোড, নর্দার্ন পার্ক, ভবানীপুর, কলকাতা।’ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এখানেই হবে তোমাদের জায়গা। ভুট্টো-ইয়াহিয়া ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। পাকিস্তানিরা বাঙালিদের ক্ষমতা দেবে না। আমি নিশ্চিত ওরা আক্রমণ করবে। আক্রান্ত হলে এটাই হবে তোমাদের ঠিকানা। এখান থেকেই মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করবে।’ বঙ্গবন্ধু সব ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। সদ্য নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য চিত্তরঞ্জন সুতারকে তিনি আগেই কলকাতায় প্রেরণ করেছিলেন। ডাক্তার আবু হেনা প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য। বঙ্গবন্ধু তাকে আগেই পাঠিয়েছিলেন অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে। সেই পথেই ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, কামারুজ্জামান সাহেব, মণি ভাই এবং আমাকে আবু হেনা সাহেব নিয়ে গিয়েছিলেন। কলকাতার এই রাজেন্দ্র রোডেই আমরা অবস্থান করতাম। আর ৮ নং থিয়েটার রোডে অবস্থান করতেন আমাদের জাতীয় চার নেতা। নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আমার নিয়মিত যোগাযোগ হতো। মুক্তিযুদ্ধের এক পর্যায়ে মুজিব বাহিনীর সঙ্গে স্বাধীন বাংলার প্রথম সরকারের ভুল বোঝাবুঝির চেষ্টা করা হয়েছিল। জাতীয় নেতৃবৃন্দের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সব ভুল বোঝাবুঝি দূর করে সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে প্রিয় মাতৃভূমিকে আমরা স্বাধীন করেছি।

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখব, স্বাধীনতা ঘোষণার পর যখন বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়, তখন এই জাতীয় চার নেতাই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দল-মত নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে অপূর্ব দক্ষতার সঙ্গে স্বাধীন বাংলার প্রথম সরকার পরিচালনা করেন ও বিজয় ছিনিয়ে আনেন। ’৭১-এর ১০ এপ্রিল মুজিবনগরে ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ’ গঠন করে, সেই পরিষদে ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ অনুমোদন করে তারই ভিত্তিতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ গঠন করেন। প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচিত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং উপ-রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম। সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী অর্থমন্ত্রী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামান স্বরাষ্ট্র ও পুনর্বাসন বিষয়ক মন্ত্রী হিসেবে ১৭ এপ্রিল শপথ গ্রহণ করেন এবং পরম নিষ্ঠার সঙ্গে অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর প্রিয় মাতৃভূমিকে হানাদার মুক্ত করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদ দূরদর্শিতার সঙ্গে সুন্দর-সূচারুরূপে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি আমাদের সঙ্গে পরামর্শ করতেন। আমাদের চারজনকে মুজিব বাহিনীর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল-শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও আমাকে। আমাদের চার জনের কাজ ছিল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বসে পরিকল্পনা গ্রহণ করা। আজ আমার সেসব কথা মনে পড়ে। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে আমি বর্ডারে বর্ডারে ঘুরেছি, রণাঙ্গনে ও মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে গিয়েছি। একসঙ্গে কাজ করেছি। আমি থাকতাম কলকাতায় মুজিব বাহিনীর হেড কোয়ার্টার ব্যারাকপুরে, মণিভাই আগরতলায়, সিরাজ ভাই বালুর ঘাটে আর রাজ্জাক ভাই মেঘালয়ে। মেজর জেনারেল ওবানের নেতৃত্বে দেরাদুনে ছিল আমাদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। মুজিব বাহিনীর জন্য ভারত সরকারের যত সাহায্য-সহযোগিতা সে-সব আমার কাছে আসত। আমি আবার সেগুলো এই তিন নেতার কাছে পাঠিয়ে দিতাম।

দেশ স্বাধীনের পর ’৭১-এর ১৮ ডিসেম্বর কলকাতা থেকে একটি বিশেষ হেলিকপ্টারে আমি এবং রাজ্জাক ভাই বিজয়ীর বেশে প্রিয় মাতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তন করি। ২২ ডিসেম্বর জাতীয় চার নেতা ফিরে এলেন। আর নয় মাস ১৪ দিন কারারুদ্ধ থাকার পর পাকিস্তানের জিন্দানখানা থেকে মুক্ত হয়ে বিজয়ের পরিপূর্ণতায় জাতির পিতা স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন ’৭২-এর ১০ জানুয়ারি। ’৭১-এর ডিসেম্বরের ২২ তারিখ শত্রুমুক্ত স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচিত সরকারের নেতৃবৃন্দকে তথা জাতীয় চার নেতাকে আমরা বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানাই। ’৭২-এর ১১ জানুয়ারি তাজউদ্দীন আহমদের বাসভবনে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনা বিষয়ে সমস্ত পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরে যাবেন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হবেন বঙ্গবন্ধু স্বয়ং; সৈয়দ নজরুল ইসলাম শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী; তাজউদ্দীন আহমদ অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী; ক্যাপ্টেন মনসুর আলী যোগাযোগ মন্ত্রী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামান সাহেব ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল ১৪ জানুয়ারি প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব হওয়ার। মাত্র ২৮ বছর বয়সে আমি মন্ত্রীর পদমর্যাদা পেলাম। সেই থেকে বঙ্গবন্ধুর কাছে থেকেছি শেষ দিন পর্যন্ত।

মানুষের জীবন যে কত কঠিন হয় আমি তা হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করি। ’৭৫-এর ১১ জুলাই আমার বড়ো ভাইয়ের মৃত্যু হয়। বঙ্গবন্ধু এসেছিলেন, জানাজা পড়ে তার মরদেহ হেলিকপ্টারে করে ভোলায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি নিজে বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন। কত মহান নেতা তিনি। এসব ঘটনাগুলোতে উপলব্ধি করা যায়। আমি যখন ’৭৪-এ চাঁপাইনবাবগঞ্জে গাড়ি দুর্ঘটনায় নিপতিত হই, তখন আমার শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ। বঙ্গবন্ধু হেলিকপ্টার পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। রাতের বেলায়-সেই মাঠের চারপাশে কোনো বিদ্যুৎ ছিল না, হ্যাজাক বাতি জ্বালিয়ে চতুর্দিক আলোকিত করার ব্যবস্থা করে আমাকে হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। বিমানবন্দরে উপস্থিত থেকে বঙ্গবন্ধু আমাকে নিয়ে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে গিয়েছিলেন এবং পঙ্গু হাসপাতালের বিখ্যাত ডা. গ্রাসকে ডেকে আমার চিকিৎসা করিয়েছিলেন। আমার ভাইয়ের মৃত্যুর পর, ১৫ আগস্টের পর আমার ওপর অমানুষিক নির্যাতন নেমে এসেছিল। আমাকে তখন ময়মনসিংহ কারাগারের কনডেম সেলে ফাঁসির আসামির মতো রাখা হয়েছে। একদিন হঠাৎ আমার পরিবার, আমার স্ত্রী ও সাত বছর বয়সী মেয়ে তখন দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিল। ওই দিনই আমি খবর পাই, আমাদের বাড়ির কাছে একটা বাজার আছে, সেই বাজারেই আমার সেজো ভাইকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর খুনি ক্যাপ্টেন মাজেদ এখন পলাতক। সে-ই ভোলায় গিয়ে তাকে হত্যা করার ব্যবস্থা করেছিল। ভাবতে কেমন লেগেছিল! আমার মা তখন জীবিত। দুই ছেলে মৃত, আরেক ছেলে কারাগারে। তখনকার দিনগুলোর কথা মনে হলে এখনো আবেগাপ্লুত হই-খুব খারাপ লাগে। তিন ছেলের একজন জেলে আর দুই ছেলে বেঁচে নেই। মায়ের সেই করুণ দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। আমি যখন জেলে। কি অপরিসীম কষ্ট করেছে আমার স্ত্রী। আমার স্ত্রীর নামে কেউ বাড়িভাড়া দিতে চায়নি। যখনই শুনেছে তোফায়েল আহমেদের স্ত্রী, তখনই বলেছে, ‘না, বাড়ি ভাড়া দেওয়া সম্ভবপর হবে না।’ কলাবাগানে আমার ভাগ্নি জামাইয়ের নামে গোপনে একটি বাড়ি ভাড়া করে আমার স্ত্রী সেখানে দেড় বছর কাটিয়েছেন। কোনো ফ্যান, ফার্নিচার, খাট কিছুই ছিল না। কারণ, আমি ছিলাম সরকারি বাসভবনে। সবই দেওয়া ছিল সরকারের। তিনি ফ্যান ছাড়াই এক বছর কাটিয়েছেন। আমার বাসায় তখন আত্মীয়স্বজন মিলে আটজন। তারা কলেজে স্কুলে পড়াশোনা করে। করুণ দিন অতিক্রম করেছেন আমার স্ত্রী। তবে ব্যতিক্রম ছিলেন ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুর রব। তাঁর আজিমপুরের বাড়িটি তিনি আমার স্ত্রীকে ভাড়া দিতে সম্মত হয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, তাঁর টেলিফোনটিও তিনি ব্যবহারের সদয় অনুমতি দিয়েছিলেন। কারামুক্তির পর আমি এই বাসাটিতেই উঠেছিলাম। উল্লেখ্য, তিনি ছিলেন বরিশাল জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক। পৃথিবীতে ওনার মতো ভালো লোকও ছিল। ভালো-মন্দ নিয়েই জগৎ। তিনি এখন প্রয়াত। আমি তাঁর জন্য দোয়া করি। যখন জেলহত্যা দিবস আমার জীবনে ফিরে আসে তখন এই ঘটনাগুলো তীব্রভাবে আমাকে নাড়া দেয়।

আমার মা যখন আমার সঙ্গে দেখা করতে যেতেন তখন তিনি শুধু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। কি কষ্ট করেই না আমার বৃদ্ধা মা, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, কুষ্টিয়াসহ অন্যান্য কারাগারে আমাকে দেখতে যেতেন। মায়ের কথা খুব বেশি মনে পড়ে। খুব কষ্ট করেছেন। আমাকে কখনো কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়নি। ’৭৫-এ গ্রেফতার করে পুলিশ কন্ট্রোল রুমে অমানুষিক নির্যাতন করে জেল গেটে আমার নাম এন্ট্রি করে আমাকে ময়মনসিংহ কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এখানে একটা কথা আছে। ভাগ্যগুণে আমি বেঁচে আছি। ৩ নভেম্বরের হত্যাকা- যখন ঘটে, তখন জেলখানার এক হাবিলদার, নাম সামাদ, শরীয়তপুরে বাড়ি। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আমাকে এবং রাজ্জাক ভাই এ দুজনকেই জেলহত্যাকারী খুনি রশীদ, ফারুক, ডালিম জেলখানায় যারা গিয়েছিল তারা আমাদের খুঁজেছে। রাজ্জাক ভাই আর জিল্লুর রহমান সাহেবকে পাঠিয়েছিল কুমিল্লা কারাগারে। আমাকে আর আবিদুর রহমানকে ময়মনসিংহ কারাগারে। ময়মনসিংহ কারাগারেও জেলের মধ্যে মেজর আরিফ নামে এক সেনাকর্মকর্তা আমাকে হত্যা করার জন্য জেলের মধ্যে প্রবেশ করতে চেয়েছিল। কিন্তু ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামান ও কর্নেল শাফায়াত জামিল তারা ময়মনসিংহ পুলিশকে খবর দেওয়ার পর কারা কর্তৃপক্ষ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করে কারাগার প্রটেক্ট করেছিল। আগেই উল্লেখ করেছি, আমারই ক্লাসফ্রেন্ড জনাব ওদুদ, আমরা একসঙ্গে এমএসসি পাস করেছি, যিনি ’৭৩-এ পুলিশ অফিসার হয়েছিলেন। তিনি রাত-দিন পাহারা দিয়েছেন এবং সার্বিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছেন। সেদিন কারাগারের নিরাপত্তার ব্যবস্থা যারা করেছিলেন পরে তাদের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে বদলি করেছিল খুনিচক্র। ময়মনসিংহ ছিল বড় জেল সেখান থেকে ছোট জেল ফরিদপুরে বদলি করা হয়। অর্থাৎ আমাকে সাহায্য করার জন্য তারা সাজা পেয়েছিলেন। তাদের জন্য দুঃখ হয়।

আমি যখন ময়মনসিংহ জেলখানায় আমার ছোট্ট মেয়েটি যখন আমাকে দেখতে যেত, তখন সে বারবার জিজ্ঞেস করত, ‘আব্বু তুমি কবে বাড়ি যাবে।’ আমি তার উত্তর দিতে পারতাম না। এবং আমার সঙ্গে থাকতে চাইত। কারণ সে তো বুঝত না। এই কারাগারে বসেই খবর পাই, আমার বড়ো ভাবি, ১ জানুয়ারি ’৭৬-এ এক পুত্রসন্তানের জন্ম দিয়েছেন এবং আমার স্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে তাকে কোলে তুলে নিয়ে আপন সন্তানের মতো লালন-পালন করেন। এখন সে আমারই ছেলে। আমার মেয়ের এক ছেলে আর তার দুই মেয়ে। তাদের সঙ্গে আমি ভালো সময় কাটাই। জীবনে অনেক কষ্ট করেছি। সাতবার কারাগারে গিয়েছি। সেই ময়মনসিংহ, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, কুমিল্লা, সিলেট, বরিশাল, কাশিমপুর আবার কুষ্টিয়া। কিন্তু দুঃখ নেই। তবুও ভাবি, আমি তো বেঁচে আছি। আমি তো নিজের চোখে মৃত্যু দেখেছি। কারণ আমাকে যখন খুনিচক্র টর্চার করে, তখন তারা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগেছে। আজকেই আমাকে হত্যা করবে, নাকি পরে হত্যা করবে। পরে তারা সিদ্ধান্ত নেয়, তাদের প্রশ্নের উত্তর আমাকে দিতে হবে। যদি না দেই, আমাকে তারা হত্যা করবে। আমি তাদের কোনো প্রশ্নের উত্তর দেইনি। যেসব প্রশ্ন আমাকে করেছে, অবান্তর প্রশ্ন। বঙ্গবন্ধুর ফান্ড থাকত আমার কাছে। এই টাকা কোত্থেকে আসত? আমি কাকে কাকে দিতাম? তারপর রক্ষীবাহিনী সম্পর্কে বারবার আমাকে প্রশ্ন করেছে। আমি ময়মনসিংহ কারাগারে থাকতে থাকতেই হঠাৎ দেখি একটা ঘোষণা হচ্ছে জেলখানার মধ্যে শফিকুল ইসলাম মিন্টু নামে কেউ আছেন জেলখানায়? আমি নামটা শুনে অবাক হয়ে গেলাম। শফিকুল ইসলাম মিন্টু তো আমার এপিএস। ’৭৩ ব্যাচের ম্যাজিস্ট্রেট। জিজ্ঞেস করলাম, কেন তাকে খোঁজা হচ্ছে? কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আসল ঘটনা হলো, আমাকে গ্রেফতারের পর মিন্টুকেও গ্রেফতার করে এবং আমার বিরুদ্ধে বলার জন্য তাকে প্রচ- চাপ দেয়। তখন সে কিছুই বলেনি। বুড়িগঙ্গা নদীতে নামিয়ে তাকে গুলি করে হত্যা করে তার লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়। তার লাশ কোনো দিন পাওয়া যায়নি। আমাকে যখন টর্চার করে তখন খুনিরা এ কথাটিই বলেছিল যে, ‘আপনার এপিএস আমাদের হাতে বন্দী। তিনি ৬০ পৃষ্ঠার স্টেটমেন্ট দিয়েছেন। সেগুলোর উত্তর দেন।’ কিন্তু আমি কোনো উত্তর দেইনি। আমাকে যখন তারা টর্চার করে, তখন শুধু একটি কথাই বলেছিলাম, ‘বঙ্গবন্ধু যা ভালো কাজ করেছেন, আমি তার সেসবের ভাগীদার, যদি কোনো ভুল হয়ে থাকে, আমি তারও ভাগীদার। এখন আপনাদের দায়িত্ব হলো আমার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া।’ তারপর রেডিও স্টেশন থেকে যখন আমাকে পুলিশ কন্ট্রোল রুমে নিয়ে যায় তখন আমার আর্তনাদে চতুর্দিক কেঁপে উঠেছিল। ডাক্তার এসে আমার চিকিৎসা করায় এবং সন্ধ্যার সময় কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে নাম এন্ট্রি করে ময়মনসিংহ কারাগারে প্রেরণ করে।

জীবন সায়াহ্নে এসে ৭৬ পেরিয়ে ৭৭ বছরে পদার্পণ করেছি। আমার এই ক্ষুদ্র জীবন বিশ্লেষণ করে দেখি যে, জীবন আমার ধন্য। আমি, ইতিহাসের মহামানব জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর, স্নেহ, ভালোবাসা পেয়েছি। মায়ের দোয়া পেয়েছি। বাংলাদেশের মানুষের স্নেহ-ভালোবাসা পেয়েছি। আমার জীবন তৃপ্ত, কানায় কানায় পরিপূর্ণ। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে আমি যা চেয়েছি, তাই পেয়েছি। এখন আমার একটিই কামনা-যা আমার মা বলেছিলেন মৃত্যুর আগে আমি যখন মাকে নিজ হাতে খাওয়াচ্ছিলাম, বলেছিলেন, ‘তুমি কী আমাকে মরতে দিবে না।’ আমি বলেছিলাম ‘মা, আপনি যদি চলে যান, আমাকে দোয়া করবে কে?’ তখন তিনি বলেছিলেন, ‘আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে রেখে গেলাম। তিনিই তোমাকে দেখবেন।’ এটিই ছিল মায়ের সঙ্গে আমার শেষ কথা। সেই মায়ের দোয়ায় খুব ভালো আছি। মাত্র ২৮ বছর বয়সে প্রতিমন্ত্রী হয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছি; ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী; আবার ২০১৩ সালে শিল্প ও গৃহায়ণ মন্ত্রী; এরপর ২০১৪ সালে বাণিজ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। এখন সুন্দর সময় কাটাচ্ছি। আমার মনে কোনো দুঃখ নেই। এখন লেখাপড়া করছি, আত্মজীবনী লেখার কাজ শুরু করেছি। প্রচুর লোক সকালে আসে। সাধ্যমতো তাদের সাহায্য করার চেষ্টা করি। শুধু পরম করুণাময় আল্লাহর কাছে আমার শেষ কামনা, আমি যেন ইজ্জত, মানসম্মান আর আত্মসম্মান নিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারি। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যুদ্ধ করে আমরা এই দেশ স্বাধীন করেছি। বঙ্গবন্ধুর দুটি স্বপ্ন ছিল, একটি স্বাধীনতা, তিনি পূরণ করেছেন। আরেকটি অর্থনৈতিক মুক্তি। ৭ মার্চের বক্তৃতার শেষে তিনি বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ স্বাধীনতা অর্জন করেছি। আজ তার স্বপ্নের বাংলাদেশকে যে তিনি সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশে পরিণত করতে চেয়েছিলেন সেই কাজটি বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আজ এগিয়ে চলেছে। এই জেলহত্যা দিবসে আমার দৃঢ়বিশ্বাস, সে দিন বেশি দূরে নয়, যেদিন বাংলাদেশ হবে একটা দারিদ্র্যমুক্ত শস্য-শ্যামলা সোনার বাংলা। জাতির পিতা ও জাতীয় চার নেতার আরাধ্য স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করে প্রিয় বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করা। মহান নেতাদের সেই চেতনা ও স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারলেই নেতৃবৃন্দের আত্মা চির শান্তি লাভ করবে এবং আমরা সেই লক্ষ্যেই নিয়োজিত। 

লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা; সংসদ সদস্য; সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি, জাতীয় সংসদ।

ই-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর