বুধবার, ৬ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

শিক্ষকদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা

জাবি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ। হল ত্যাগের নির্দেশ। দুর্ভোগে শিক্ষার্থীরা। ভিসি বললেন, ছাত্রলীগের প্রতি কৃতজ্ঞ, আনন্দের দিন

শরিফুল ইসলাম সীমান্ত, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

শিক্ষকদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলামের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এবং তার অপসারণের আন্দোলনকে ঘিরে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। গতকাল আন্দোলনরত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর জাবি ভিসির হয়ে হামলা চালিয়েছে শাখা ছাত্রলীগ। এতে ৮ শিক্ষকসহ অন্তত ৩৫ জন আহত হয়েছেন। এ ছাড়া দায়িত্ব পালন করার সময় চার সাংবাদিককেও মারধর করে আহত করেছে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। ছাত্রলীগের এ হামলার ঘটনায় উত্তপ্ত পরিস্থিতি সামাল দিতে ক্যাম্পাস অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। গতকাল বেলা আড়াইটার দিকে এক জরুরি সিন্ডিকেট সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়। ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার রহিমা কানিজ স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বিকাল সাড়ে ৫টার মধ্যে সব শিক্ষার্থীকে হল ত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। উত্তপ্ত ও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। হঠাৎ হল ছাড়ার নির্দেশে বিক্ষুব্ধ মনোভাব প্রকাশ করেছেন বেশির ভাগ শিক্ষার্থী। অতর্কিত সিদ্ধান্তে ভোগান্তিতে পড়েছেন দূর-দূরান্ত থেকে পড়তে আসা শিক্ষার্থীরা। বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থীরা বেশি ভোগান্তিতে পড়েছেন। ফলে আন্দোলনকারী শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা এবং হল ত্যাগের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। বেলা ৩টার দিকে সহস্রাধিক সাধারণ শিক্ষার্থী বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে ভিসির বাসভবনের সামনে অবস্থান নেন। মারধর করে আন্দোলনকারীদের হটিয়ে দেওয়ার পর উপাচার্যের বাসভবনের সামনেই অবস্থান করে শাখা ছাত্রলীগ। সহস্রাধিক শিক্ষার্থী ও শাখা ছাত্রলীগ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে স্লোগান দেন। গতকাল বেলা সোয়া ১১টায় উপাচার্যপন্থি শিক্ষক-কর্মকর্তারা অবরুদ্ধ উপাচার্যকে বাসভবন থেকে বের করে তার কার্যালয়ে নিয়ে যেতে আসেন। এ সময় উপাচার্য সমর্থক শিক্ষক ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে উত্তপ্ত বাক-বিত া হয়। এর মধ্যেই দুপুর পৌনে ১২টার দিকে শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. জুয়েল রানা আন্দোলনকারীদের ‘শিবির’ আখ্যা দিয়ে তাদের বিতাড়নের দাবিতে একটি মিছিল নিয়ে সেখানে উপস্থিত হন। ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়েই আন্দোলনকারীদের এলোপাতাড়ি মারধর শুরু করে শাখা ছাত্রলীগ। তাদের লাথি-কিল-ঘুষিতে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন আন্দোলনকারীরা। মারধরের সময় আন্দোলনকারী একাধিক শিক্ষক-শিক্ষার্থীকে চ্যাংদোলা করে উঠিয়ে নিয়ে দূরে ফেলে দেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। এ সময় উপাচার্য সমর্থক শিক্ষক সোহেল আহমেদ, নাসির উদ্দিন, আতিকুর রহমান, আবদুল মান্নান চৌধুরী, নজরুল ইসলাম, আশরাফুল ইসলাম, মাহমুদুর রহমান জনিসহ কয়েকজনকে ‘ধর ধর’, ‘জবাই কর’ ও ‘মার মার’ বলে চিৎকার করতে দেখা যায়। ছাত্রলীগের এই মারধরে ৮ শিক্ষকসহ অন্তত ৩৫ জন আহত হন। এ ছাড়া দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় চার সাংবাদিককেও মারধর করেন তারা। আহত শিক্ষকরা হলেন- নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাঈদ ফেরদৌস, মির্জা তাসলিমা সুলতানা, দর্শন বিভাগের অধ্যাপক রায়হান রাইন, প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক খন্দকার হাসান মাহমুদ, বাংলা বিভাগের অধ্যাপক শামীমা সুলতানা প্রমুখ।  মারধরে আহত শিক্ষার্থীদের মধ্যে রয়েছেন- ৪৪তম ব্যাচের মারুফ মোজাম্মেল (দর্শন), মাহাথির মুহাম্মদ (ভূগোল ও পরিবেশ), সাইমুম ইসলাম (পরিবেশ বিজ্ঞান), রাকিবুল ইসলাম রনি (নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা), মারিয়াম ছন্দা (সরকার ও রাজনীতি), ৪৫তম ব্যাচের রুদ্রনীল (দর্শন), সৌমিক বাগচী (প্রত্নতত্ত্ব), ৪৭তম ব্যাচের সাউদা (সরকার ও রাজনীতি), ৪৮তম ব্যাচের আলিফ মাহমুদ (ইংরেজি) ও উল্লাস (অর্থনীতি)। এ ছাড়া, সংবাদ সংগ্রহকালে হামলায় আহত সাংবাদিকরা হলেন- প্রথম আলোর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি মাইদুল ইসলাম, বার্তা টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিনিধি আজাদ, বার্তাবাজারের প্রতিনিধি ইমরান হোসাইন হিমু, বাংলা লাইভ টোয়েন্টিফোরের প্রতিনিধি আরিফুজ্জামান উজ্জ্বল। আহতদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। অবস্থা গুরুতর হওয়ায় ৮ জনকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয় বলে জানান জাবি চিকিৎসা কেন্দ্রের চিকিৎসক ডা. রেজওয়ানুর রহমান। ছাত্রলীগের মারধরের বিষয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষক পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক খবির উদ্দিন তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এ রকম ন্যক্কারজনক হামলার ঘটনা এর আগে দেখা যায়নি। উপাচার্যপন্থি শিক্ষকদের উপস্থিতি ও প্রত্যক্ষ উসকানিতে ছাত্রলীগ আমাদের ওপর হামলা চালিয়েছে। ছাত্রলীগ যখন আমাদের ওপর হামলা চালিয়েছে তখন ভিসিপন্থি শিক্ষকরা তাদের স্বাগত জানিয়ে হাততালিও দিয়েছেন। হামলার বিষয়ে শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. জুয়েল রানা বলেন, ‘আমরা শিবিরমুক্ত ক্যাম্পাস চাই। আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে শিবির সংশ্লিষ্টতার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল। তবে শিবির সম্পৃক্ততার ছাত্রলীগের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন আন্দোলনকারীদের মুখপাত্র দর্শন বিভাগের অধ্যাপক রায়হান রাইন। তিনি বলেন, যে কোনো শক্তিকে প্রতিহত করার জন্য শিবির ব্লেইম দেওয়া পুরনো অপকৌশল। বুয়েটের আবরারকে এভাবেই হত্যা করা হয়েছে, এখানেও একইভাবে অভিযোগ তুলে হামলা চালানো হয়েছে। হামলার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর (ভারপ্রাপ্ত) আ স ম  ফিরোজ-উল-হাসান বলেন, ঘটনাস্থলে মব তৈরি হয়েছিল। চেষ্টা করেও আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। বড় ঘটনা এড়াতে আমরা তৎপর আছি।

উপাচার্য বললেন, এটা তার জন্য আনন্দের দিন : মারধরের ঘটনার আধা ঘণ্টা পর বেলা ১টার দিকে উপাচার্য তার সমর্থক শিক্ষকদের নিয়ে নতুন প্রশাসনিক ভবনের নিজ কার্যালয়ে যান। সেখানে তিনি একটি সংবাদ সম্মেলন করেন। আন্দোলনরত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়ে তাকে মুক্ত করার এই ঘটনাকে ‘গণঅভ্যুত্থান’ আখ্যা দিয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার জন্য এটা অত্যন্ত আনন্দের একটি দিন। এ কারণে যে... মিথ্যা অভিযোগের ভিত্তিতে যারপরনাই আমাকে অপদস্থ করা হয়েছে। অসম্মান করা হয়েছে। কিন্তু কোনো প্রমাণ ছাড়াই। যদি প্রমাণ পায় তাহলে যা বিচার হবে আমি মেনে নেব। তিনি আরও বলেন, আমি মনে করি দেশে একটা জাগরণের সময় এসেছে। আমরা সত্য কথা বলার জায়গা তখনই পাব যখন মানুষ জেগে উঠবে। আজকে সেই মানুষের জেগে ওঠা আমরা দেখেছি। আমি কৃতজ্ঞ আমার সহকর্মীদের কাছে, আমি কৃতজ্ঞ আমার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছে। আমি কৃতজ্ঞ সব ছাত্র-ছাত্রীর কাছে, বিশেষ করে ছাত্রলীগের কাছে। তারা দায়িত্ব নিয়ে এ কাজটি করেছে।’ আন্দোলনকারী শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা বিষয়ক এক প্রশ্নের উত্তরে উপাচার্য বলেন, এটি গণঅভ্যুত্থান, আমি বলেছি। আমার কোনো নির্দেশে তারা করেনি। হামলা সেখানে হয়েছে, হামলা এখানেও হতে পারে। যদি হামলা হয়ে থাকে, সেটি প্রক্টর দেখবে।

উত্তপ্ত পরিস্থিতির সূত্রপাত যেখান থেকে : গত বছরের ২৩ অক্টোবর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় জাবির অধিকতর উন্নয়নের জন্য ১ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকার বাজেট বরাদ্দ করা হয়। প্রকল্পের শুরু থেকেই অপরিকল্পিত উন্নয়ন পরিকল্পনা, সহস্রাধিক গাছ কাটা এবং শাখা ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে টেন্ডার ছিনতাইয়ের অভিযোগে সমালোচনার মুখে পড়ে এই বিশাল প্রকল্প। এরপর ঈদুল আজহার ঈদ সেলামি হিসেবে শাখা ছাত্রলীগকে দুই কোটি টাকা দেওয়ার অভিযোগ ওঠে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে। পরে উপাচার্যকে ‘দুর্নীতিবাজ’ আখ্যা দিয়ে তার অপসারণের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একটি অংশের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা সংগঠন ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’। তিন মাসের লাগাতার আন্দোলনের পর গত সোমবার (৪ নভেম্বর) সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় উপাচার্যের অপসারণের দাবিতে সংগঠনটির ব্যানারে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের বাসভবন ঘেরাও করে।

শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদকসহ ৪ জনের পদত্যাগ : জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের অপসারণের দাবিতে চলমান আন্দোলনে ছাত্রলীগের হামলায় শিক্ষক সমিতির নীরব ভূমিকার কারণে সাধারণ সম্পাদক, কোষাধ্যক্ষসহ চারজন পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। পদত্যাগকারীরা হলেন- শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক সোহেল রানা, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মনোয়ার হোসেন তুহিন, সদস্য অধ্যাপক মাহবুব কবির ও অধ্যাপক সাঈদ ফেরদৌস। গতকাল সন্ধ্যায় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক সোহেল রানা এ তথ্য নিশ্চিত করেন। সোহেল রানা বলেন, ‘আমরা চারজন পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যেহেতু শিক্ষক সমিতি এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ, তাই এ কমিটি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আস্থা হারিয়েছে। তাই আমরা এই কমিটিতে থাকছি না।’ এ বিষয়ে অধ্যাপক সাঈদ ফেরদৌস বলেন, ‘আন্দোলনকারী শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছাত্রলীগের সহায়তায় হামলা চালিয়েছে। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করেছি, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি নির্লিপ্তভাবে উপাচার্যের পক্ষ অবলম্বন করে যাচ্ছে। এ অবস্থায় আমরা শিক্ষক সমিতি থেকে পদত্যাগ করছি।’ রাতে হল গেটের তালা ভেঙে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে আন্দোলন করেন শিক্ষার্থীরা। রাত ৯টা থেকে পালাক্রমে মেয়েদের হলগুলোর  গেটের তালা ভাঙা শুরু হয়। ১০টায় উপাচার্যের বাসভবনের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন শিক্ষার্থীরা। রাত পৌনে ১টায় বিক্ষোভ শেষ হয়। আজ সকাল ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আন্দোলনকারীদের সংহতি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে।

সর্বশেষ খবর