বুধবার, ৬ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

বিএনপি ছাড়লেন মোরশেদ খান

পীর হাবিবুর রহমান

বিএনপি ছাড়লেন মোরশেদ খান
খালেদা জিয়ার পরিবার ও চাটুকারদের প্রতি দুর্বলতাই বিএনপির ব্যর্থতার কারণ, দলে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র নেই, দলে গণতন্ত্র না থাকলে দেশে গণতন্ত্র আসে কীভাবে?

সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম মোরশেদ খান বিএনপি থেকে পদত্যাগ করছেন। দীর্ঘদিন বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত চট্টগ্রামের এই জনপ্রিয় নেতা বর্তমানে দলের কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান পদে রয়েছেন। তিনি শুধু ভাইস চেয়ারম্যান থেকেই নয়, বিএনপির প্রাথমিক সদস্যপদ থেকেও তার নাম প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন। গতকাল রাতে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মাধ্যমে কারাবন্দী চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার কাছে তার পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন। এম মোরশেদ খান জানান, এক বছর ধরে চিন্তাভাবনা করে তিনি এই দলবাজির রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। সোমবার রাতে তার গুলশানের বাসভবনে বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী ও চট্টগ্রামের অভিজাত খান পরিবারের উচ্চশিক্ষিত ব্যবসায়ী, সজ্জন রুচিশীল বিনয়ী মানুষ মোরশেদ খান বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন। তখন তার পাশে কিছু সময় স্ত্রী নাসরীন খান ছিলেন। তিনিও বলেছেন, এক বছর আগেই তাকে এই রাজনীতি থেকে পদত্যাগ করার জন্য পরিবার থেকে সম্পূর্ণ সমর্থন দেওয়া হয়েছে। তিনি রাজনীতিতে এসে জনগণের কল্যাণে ও দেশসেবায় যতটা ভূমিকা রেখেছেন তার মূল্যায়ন কতটা হয়েছে, সেটা সময়ই বলে দেবে। কিন্তু এ রাজনীতির জন্য গোটা পরিবারকে চড়া মাশুল গুনতে হয়েছে। তিনি রাজনীতিতে আসায় তার পরিবারকে অসহনীয় দুর্ভোগ ও কষ্ট সইতে হয়েছে।

পদত্যাগ পত্রে মোরশেদ খান বিএনপি নেত্রীকে লিখেছেন, ‘আজ অনেকটা দুঃখ ও বেদনাক্লান্ত হৃদয়ে আমার এই পত্রের অবতারণা। মানুষের জীবনের কোনো না কোনো সময়ে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতেই হয়, যার প্রভাব সুদূরপ্রসারী। আমার বিবেচনায়, সে ক্ষণটি বর্তমানে উপস্থিত এবং উপযুক্তও বটে। তিনি রাজনীতির অঙ্গনে তার দীর্ঘকালের পদচারণা স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের সংগ্রাম এবং দেশের মানুষের কল্যাণে অবদান রাখার কথা উল্লেখ করেন।’ বলেন, বিএনপি এবং আপনার যোগ্য নেতৃত্বের কাছে কৃতজ্ঞ। তবে বর্তমানে দৃঢ় বিশ্বাস দেশের রাজনীতি এবং দলের অগ্রগতিতে নতুন কিছু সংযোজনের সঙ্গতি নেই। আমার উপলব্ধি সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর নেওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়। বহু বিচার-বিশ্লেষণে বিএনপির রাজনীতি থেকে অবসরের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। প্রাথমিক সদস্যসহ ভাইস চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করছি। অব্যাহতি দিয়ে বাধিত করবেন।

পদত্যাগ পত্রে তিনি বিএনপির সঙ্গে তার সম্পর্কের দীর্ঘ পথপরিক্রমায় অসংখ্য নেতা-কর্মীর সান্নিধ্য লাভের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, এটি তিনি উপভোগ করেছেন। এদের অনেকে প্রয়াত এবং অনেকে এখনো দলের হাল ধরে আছেন। তিনি মরহুমদের আত্মার মাগফিরাত জীবিতদের মঙ্গল কামনা করেন। সবার সহযোগিতা সখ্যতা তার স্মৃতিতে উল্লেখ থাকবে বলে তিনি বলেন, সরকারে প্রতিনিধিত্ব করতে দিয়ে দল তাকে বিরল সম্মানে ভূষিত করেছে। তিনি বেগম খালেদা জিয়ার বর্তমান কঠিনকাল অতিক্রম করে সুন্দর ভবিষ্যৎ পাড়ি দেওয়ার আশা করেন।

এম মোরশেদ খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে তিনি পশ্চিমা দুনিয়া থেকে পার্শ্ববর্তী বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ ভারত এবং পূর্বের চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও বিএনপির অভ্যন্তরীণ হস্তক্ষেপ, অনেকের নির্লজ্জ দলাদলি, কে কার চেয়ে কত বড় চাটুকার হতে পারবে এ অসুস্থ প্রতিযোগিতার জন্য যা করতে চেয়েছেন তা করতে পারেননি। তাকে হতাশ হতে হয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কন্ডোলিসা রাইসের সঙ্গে তার যেমন উষ্ণ সম্পর্ক ছিল, তেমনি ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রণব মুখার্জির সঙ্গে হৃদ্যতার সম্পর্ক ছিল গভীর। তিনি মনে করেন, ভারতকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের উন্নয়নের রাজনীতি চিন্তা করা যায় না। তেমনি বৃহত্তম দেশেরও উচিত, ছোট দেশ হিসেবে বন্ধু রাষ্ট্রকে টেনে উপরে তোলার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। আই কে গুজরাল ও শীলা গুজরাল এমনকি মনি শঙ্কর রায়ের সঙ্গেও তার সম্পর্ক ছিল গভীর। প্রণব মুখার্জি ঢাকায় এসে তার বাসবভনেও উঠেছেন। সম্পর্ক এতটাই গভীর ছিল যে, প্রণব মুখার্জির স্ত্রী তার গাড়িতে করে বাবার বাড়ি নড়াইলে বেড়াতে গেছেন।

মোরশেদ খান বলেন, বিএনপির রাজনীতি থেকে পদত্যাগের মাধ্যমে তিনি দলবাজির রাজনীতি থেকে বিদায় নিচ্ছেন, রাজনীতি থেকে নয়। কোনো মানুষই রাজনীতি থেকে দূরে নয়। দলীয় রাজনীতি না করেও দেশের জন্য কাজ করা যায়। দেশের অনেক ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ দলবাজির রাজনীতি না করে যেভাবে দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে বাকি জীবন তিনি সেভাবেই ভূমিকা রাখার চেষ্টা করবেন। তিনি বলেন, দিন দিন দেশের রাজনীতি অধঃপতনের দিকে যাচ্ছে। যোগ্য নেতৃত্ব, আইনের শাসনের প্রতি অনুগত ও নতুন প্রজন্মের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ নেতৃত্ব না এলে এ রাজনীতি অর্থহীন হয়ে পড়বে। মোরশেদ খান অভিযোগ করেছেন, বিএনপির অভ্যন্তরে গণতন্ত্র কখনো ছিল না এবং গণতন্ত্রের চর্চা কখনো করা হয়নি। দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র না থাকলে দেশে গণতন্ত্র আনা যায় না এবং দলে গণতন্ত্র চর্চার ন্যূনতম চেষ্টাও করা হয়নি। তাহলে বিএনপির ভবিষ্যৎ রাজনীতি কী? এ প্রশ্নের জবাবে মোরশেদ খান এক কথায় বলেন, যারা বিএনপিতে আছেন বা থাকবেন কেবল তারাই এর উত্তর দিতে পারবেন। আপনার কি কখনো বিএনপির নেতাদের সঙ্গে এসব নিয়ে আলোচনা হয়নি? এ প্রশ্নের উত্তরে মোরশেদ খানের সহজ সরল জবাব হচ্ছে- ক্ষমতায় থাকার সময় এবং ক্ষমতার বাইরে আসার পরও তার নেতাদের সঙ্গে অনেকবার এসব নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু তাদের অনেকেই তাদের পদ-পদবি নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। দল বা দেশের কথা ভাবেননি। তিনি বলেন, বিএনপি এখন কূটনৈতিক দুনিয়ায় একা হয়ে পড়েছে। কেবল রাষ্ট্রদূতদের দাওয়াত করে চা পান করালেই সম্পর্কের উন্নয়ন হয় না। তাদের সামনে জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেম থেকে ভারসাম্যমূলক কূটনৈতিক পলিসি উপস্থাপন করতে হবে। যেখানে তাদের স্বার্থ সুরক্ষিত হবে। বিএনপি সেটি দেখাতে পারেনি। বিএনপির ব্যর্থতার কারণ কী জানতে চাইলে মোরশেদ খান তার অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ থেকে বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার পরিবারের সদস্যদের ও চাটুকারদের প্রতি অতিমাত্রায় দুর্বলতাই দলের ব্যর্থতার অন্যতম কারণ।

ছাত্ররা হলো দেশের ভবিষ্যৎ, রাজনীতির শক্তি। সেই ছাত্রদলকে দেশ-বিদেশ দেখার সুযোগ দিয়ে তাদের এতটাই নিজেদের স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত করা হয়েছে যে, ছাত্রদলকে কার্যত শেষ করে দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে আত্মত্যাগী মনোভাব নেই। ক্ষমতার রাজনীতিতে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া যেখানে ব্যর্থ, সেখানে শেখ হাসিনার সাফল্যের কারণ কী মনে করেন? এ প্রশ্নের জবাবে মোরশেদ খান বলেন, তিনি তার পিতার একটি বড় গুণ পেয়েছেন। সেটি হচ্ছে, দেশকে যতটা দিয়েছেন, তার চেয়ে কম নিয়েছেন। তিনি সরকার পরিচালনায় ও দলে পরিবর্তন এনেছেন। বিএনপি যেখানে ১০ বছরে ক্যাবিনেটে পরিবর্তন আনতে পারেনি, শেখ হাসিনা সেখানে তার ক্যাবিনেট আমূল পাল্টে দিয়েছেন। মোরশেদ খান বলেন, আমাদের সবার সামনে প্রশ্ন এখন, রাজনীতির জন্য পলিটিকস করব নাকি পলিটিকসের জন্য রাজনীতি করব? আমার মনে হয়, আমরা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি। পৃথিবী যেখানে তীব্রগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, আমরা সেখানে দ্রুতিগতিতে বিপর্যয়ের দিকে যাচ্ছি। রাজনৈতিক সহিংসতা ও প্রতিহিংসার অবসান হওয়া দরকার। সুমহান মুক্তিযুদ্ধের আকাক্সক্ষায় যার যার অবস্থান থেকে দেশের জন্য কাজ করতে সবাইকে আন্তরিক হতে হবে। ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য অগ্রসর হতে হবে। সবাইকে রাজা-মন্ত্রী হওয়ার বাসনা ত্যাগ করতে হবে। রাজনীতি বলতে দলবাজি নয়। দলবাজির বাইরে সবার রাজনীতিতে অবদান রাখার সুযোগ আছে। আপনার কর্মী-সমর্থক ও ভোটারদের আপনি কী বলবেন? এ প্রশ্নের উত্তরে মোরশেদ খান বলেন, কোনো দল না করে মানুষের কল্যাণে কাজ করা যাবে না, এই চিন্তা তাদের বাদ দিতে বলব। তাদের ঐক্যবদ্ধভাবে একাগ্রতার সঙ্গে মানুষের জন্য কাজ করার পরামর্শ দেব।

মোরশেদ খান বলেন, মেধাকে ব্যবহার না করলে ক্ষমতার কার্যকারিতা হারিয়ে যায়। দেশের জন্য মেধাকে কাজে লাগাতে হবে। তিনি বলেন, বউকে তালাক দেওয়া যায়, প্রতিবেশীকে তালাক দেওয়া যায় না। ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব রেখেই চীনকে উন্নয়নের স্বার্থে ও রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আত্মবিশ্বাসে ফিরিয়ে আনতে হবে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ¯ন্ডেœহ-সান্নিধ্য লাভ করা মোরশেদ খান বলেন, তার মুখ থেকে কখনো এই মহান নেতার বিরুদ্ধে কোনো কটু মন্তব্য বা সমালোচনা আসেনি। এদেশে অনেক নেতা এসেছেন, অনেক নেতা আছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো প্যাট্রিয়ট নেতা কেউ হতে পারেননি। তিনি গোটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন এবং গোটা দেশের মানুষ যাতে সুখে থাকে, সবাই যাতে ভালোভাবে বেঁচে থাকে সেই চিন্তা করেছেন।

মোরশেদ খান বলেন, ’৭২ সালে তিনি যখন মিসরের সঙ্গে ব্যবসায়িকভাবে যুক্ত তখন বঙ্গবন্ধু তাকে একদিন ডাকলেন। ডেকে বললেন, আমার দেশ বৃহত্তম মুসলিম দেশ। কিন্তু সৌদি আরবে আমার দেশের মুসলমানরা হজ করতে যেতে পারবে না, এটা হয় না। তুই মিসরের প্রখ্যাত সাংবাদিক মোহাম্মাদ হাসনাইন হাইকলকে একটি চিঠি পৌঁছে দে। যাতে আমার দেশের মানুষকে হজে যাওয়ার ক্ষেত্রে তারা ব্যবস্থা করে দেয়। হাসনাইন হাইকাল বিখ্যাত মিসরীয় সাংবাদিক, লেখক ও রাজনীতিবিদ। কায়রোর সবচেয়ে বিখ্যাত দৈনিক পত্রিকা আল-আহরামের প্রধান সম্পাদক ছিলেন। ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি আরব জাতীয়তাবাদ এবং আরবের সঙ্গে বহির্বিশ্বের সম্পর্ক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তিনি মিসরের প্রেসিডেন্ট জামাল আবদুল নাসেরের মন্ত্রিসভায় প্রথমে তথ্যমন্ত্রী এবং পরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। মোরশেদ খান মিসরের ট্রেড কমিশনারকে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর চিঠি পাঠালেন। জবাবে তারা প্রটোকল অফিসারসহ একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিকে পাঠালে মেরশেদ খান তাদের নিয়ে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসভবনে বঙ্গবন্ধুর কাছে নিয়ে গেলেন। বঙ্গবন্ধু তখন মাওলানা তর্কবাগিশের সঙ্গে গল্প করছিলেন। তারপর আলাপ-আলোচনায় মিসরের সহযোগিতায় ১০ হাজার বাংলাদেশি সেবার হজে যায়।

বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শিতা সম্পর্কে আত্মমর্যাদাবোধ ও দৃঢ় ব্যক্তিত্ব নিয়ে বলতে গিয়ে তিনি বললেন, ’৭৪ সালে তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গেছেন, এর মধ্যে ভারতের ঢাকায় নিযুক্ত হাইকমিশনার সমর সেন এলেন।

বঙ্গবন্ধুকে খবর দেওয়া হলে তিনি তাকে সাদরে সঙ্গে সঙ্গে তার কক্ষে ডেকে নিলেন। আমাকে দেখিয়ে বললেন, ও আমার নিজের লোক। আলোচনায় কোনো অসুবিধা হবে না। আমাকে বললেন, তুই একটু দূরে গিয়ে বস। তখন দুই দেশের যৌথ পানি গবেষণার প্রতিনিধি দল কাজ করছিল। সমর সেন বঙ্গবন্ধুকে বললেন, আমাদের প্রতিনিধি দলের সদস্যরা বলছে, পানি নিয়ে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের সদস্যরা কিছু বোঝে না। বঙ্গবন্ধু সঙ্গে সঙ্গে বললেন, আরে ওরা বুঝকে কী করে? আমার কি একজন সমর সেন আছে? আমি শুধু তাদের বলে দিয়েছি, তোমরা চুক্তিটি কর এবং চুক্তিতে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা হয় সেগুলো মুখস্থ করে ফেল এবং তা আদায় করতে মিটিংয়ে কথা বল। সমর সেনের ফিরে যাওয়া ছাড়া জবাব দেওয়ার আর কিছু ছিল না।

এসএসসি পরীক্ষার সময় ’৫৪ সালে যুুক্তফ্রন্টের প্রার্থী অধ্যাপক সুলতানুল আলমের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় নামতে গিয়ে রাজনীতিতে জড়িয়ে যান মোরশেদ খান। তখন রাত জেগে হাতে পোস্টার লিখতেন। আর দিনের বেলায় সেটি লাগাতেন। তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র। নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসসহ তারা একসঙ্গে পড়তেন। সেই সময় ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে যাওয়ায় এসএসসি পাসের পর পার্টির নির্দেশে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে কয়েকজন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে গিয়ে ভর্তি হলেন। সেখানে তাহের উদ্দিন ঠাকুর, মোফাজ্জল করিমদের রাজনৈতিক সহকর্মী হিসেবে পেলেন। এর আগে ’৫৩ সালে ন্যাশনাল ব্যাংক পাকিস্তানের ম্যানেজার জামাল সাহেব হলুদ রঙের ভক্স ওয়াগন চালিয়ে তরুণ নেতা শেখ মুজিবকে নিয়ে তাদের গ্রামের বাড়িতে গেলেন। সেই প্রথম তিনি বঙ্গবন্ধুকে দেখলেন। তার ভগ্নিপতি শাহরিয়ার আহমেদের বাড়িতে তারা গিয়েছিলেন। ভাস্কর নভেরা আহমদ সৈয়দ শাহরিয়ার আহমেদের বোন ছিলেন। ’৫৬ সালে কুমিল্লায় একটি উপনির্বাচনে তারা মাঠে কাজ করলেন। আবু হোসেন সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে এতটাই বেপরোয়া হয়েছিলেন যে, তখন তার স্থানীয় অভিভাবক দারোগা বাড়ির আবাদ মিয়ার ওপর চেয়ার ছুড়ে মেরেছিলেন। ডিসি কেরামত আলীর বাসভবনে আগুন দিয়েছিলেন। কুমিল্লা আর্ট প্রেস ছিল বাম রাজনীতির আখড়া। ওই সময় পুলিশ সুপার ছিলেন জনাব দেলোয়ার। ডিসির বাড়িতে আগুন দেওয়ার কারণে তাদের কয়েকজনকে জেলে যেতে হয়। তখন সেন্ট্রাল আইজি ছিলেন তার চাচা ইদ্রিস খান। তিনি নির্দেশ দিলেন জেলে পুরতে। ১৭ দিন পর মুক্তি পাওয়ার পর পরিবার তাকে চট্টগ্রামে নিয়ে আসে। রাজনৈতিক হাঙ্গামায় জড়িয়ে যাওয়ায় তখন তাকে জাপান পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।

মোরশেদ খান জাপানে ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হন। ’৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময় সেখানে প্রতিবাদ সমাবেশেও অংশ নেন। ’৬৮ সালে করাচিতে ইলেকট্রনিক্স শিল্পপ্রতিষ্ঠান করলেও পরে তা বাজেয়াপ্ত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে তিনি ফিলিপিন যান সেখান থেকে ওয়াশিংটন গিয়ে বিএ সিদ্দিকী, আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গে স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করেন।

জেনারেল জিয়া প্রেসিডেন্ট হয়ে একবার জহির উদ্দিন খান, হাবিবুল্লাহ খান ও তাকে জাপান সফরে নিয়ে যান। ইআরডি সচিব আবুল মাল আবদুল মুহিতও ছিলেন। এক রবি তাদের তিনজনকে কর্নেল অলিকে দিয়ে ডাকেন এবং একজন একজন করে কথা বলেন। দেশ গড়তে তার সঙ্গে যুক্ত হতে প্রস্তাব দিলে বাকি দুজন রাজি হলেও মোরশেদ খান ছেলের বয়স ৭ হওয়ায় অপারগতা প্রকাশ করেন। ফিরে আসেন যা পরে খালকাটা ও চাষাবাদে কাজে লাগান।

সেনা শাসক এরশাদ তাকে ধরে নিয়ে ’৮৬ সালে এমপি বানালেও ’৮৭ সালেই ছেড়ে দেন। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আনোয়ার জাহিদেরও মন্ত্রিত্ব যায়। ’৮৯ সালে তিনি বি. চৌধুরী, শামসুল ইসলামসহ ধানমন্ডিতে আড্ডা দেন। কর্নেল মোস্তাফিজুর রহমানকে দিয়ে ডেকে খালেদা জিয়া তাকে বিএনপিতে যোগ দিতে বললে তিনি সাকা চৌধুরী ও আনোয়ার জাহিদের কথা বললেন, খালেদা জিয়া বলেন, তাদেরটা পরে দেখা যাবে। এভাবে তিনি বিএনপির সঙ্গে যুক্ত হন।

’৯১ সালের নির্বাচনে মোরশেদ খানকে বিএনপি মনোনয়ন দিতে চাইলে নেননি। এ জন্য বেগম খালেদা জিয়া চট্টগ্রামের মনোনয়ন ঘোষণা দুই দিন পর দেন। তবে সরকার গঠনের পর বেগম খালেদা জিয়া তাকে উপদেষ্টা করে তার কার্যালয়ে অফিস দিয়ে পররাষ্ট্রনীতি তৈরির জন্য পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান করেন। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা ছিলেন তার সদস্য। শাহ এ এম এস কিবরিয়া প্রথমে, সওদাগর নাকি ফরেন পলিসি তৈরি করেছেন বলে মন্তব্য করলেও পরে তা পাঠ করে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। ’৯৬ সালেও বিএনপি থেকে এমপি হন মোরশেদ খান। ২০০১ সালে বিজয়ী হয়ে আসার পর তাকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী করা হয়।

বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার আগে মোরশেদ খানের সঙ্গে তার শেষ কথা হয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে খালেদা জিয়া কখনো তার কোনো কাজে হস্তক্ষেপ করেননি। তবে একবার এক ঘটনায় তিনি আবেগপ্রবণ হয়ে বেগম খালেদা জিয়ার কাছে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন। এ বিষয়ে মোরশেদ খান বলেন, তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হলেও তখন তাকে না জানিয়ে তাইওয়ানে একটি প্রতিনিধি দল পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। সে বৈঠকটি করেছিলেন আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, রিয়াজ রহমান, মাহমুদুর রহমান, শমসের মবিন চৌধুরী ও হারিছ চৌধুরী। তারা তাইওয়ানে ১০ লাখ শ্রমিক পাঠানোর চুক্তি করেছিলেন, যা তাকে ব্যথিত করেছিল। মোরশেদ খানের ভাষায় কূটনীতিতে সেটি ছিল আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।

সর্বশেষ খবর