রবিবার, ১০ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

বিতর্কিত জায়গায় হবে মন্দির মসজিদ অন্য স্থানে

বাবরি মসজিদ নিয়ে ভারতের উচ্চ আদালতের রায়

নয়াদিল্লি প্রতিনিধি

প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈর নেতৃত্বে গঠিত ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চ বাবরি মসজিদ-রাম জন্মভূমি নিয়ে করা ঐতিহাসিক অযোধ্যা মামলার রায়ে গতকাল ঘোষণা করেছে, বিতর্কিত ভূমিতে মন্দির করবে একটি ট্রাস্ট, আর মসজিদ বানানোর জন্য সরকার দেবে বিকল্প একটি জায়গা। সকাল ১০টায় রায় পড়তে শুরু করেন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ। বেলা ১১টায় রায় ঘোষণা শেষ হয়। রায়ে সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডের আর্জি এবং নির্মোহী আখড়ার বিতর্কিত জমির ওপর দাবি দুটোই খারিজ করে দেয় সুপ্রিম কোর্ট। এর ফলে বিতর্কিত জমির ওপর বিশ্ব হিন্দু পরিষদের কর্তৃত্বও খর্ব হলো, যারা মন্দির নির্মাণের উদ্দেশ্যে ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। জমিটি এখন ট্রাস্টের অধীনে চলে যাবে এবং ট্রাস্টি বোর্ড মন্দির নির্মাণসহ সেটির দেখভালের দায়িত্বে থাকবে। প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ বলেন, ‘আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার (এএসআই) তথ্যনুযায়ী ফাঁকা জায়গায় বাবরি মসজিদ নির্মাণ হয়নি। তবে মাটির নিচে থাকা স্থাপনাটি মসজিদ ছিল নাকি মন্দির, তা এএসআই সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারেনি। তিনি বলেন, হিন্দু বিশ্বাস করেন এখানে রামের জন্মভূমি ছিল। তবে কারও বিশ্বাস যেন অন্যের অধিকার হরণ না করে। যেহেতু বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে জমির মালিকানা ঠিক করা সম্ভব নয়, তাই আইনের ভিত্তিতেই জমির মালিকানা ঠিক করা উচিত। আপাতত কেন্দ্রীয় সরকার ওই জমির মালিকানা পাবে। কেন্দ্রকে তিন মাসের মধ্যে বোর্ড অব ট্রাস্ট গঠন করে তাদের হাতে বিতর্কিত জমি তুলে দিতে হবে। ট্রাস্টের তত্ত্বাবধানেই বিতর্কিত ২.৭৭ একর জমিতে মন্দির নির্মাণ হবে। সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড ওই জমিতে অধিকার দাবি করতে পারবে না। তবে তারা মসজিদ নির্মাণের জন্য বিকল্প জমি পাবে। অযোধ্যার মধ্যস্থলে কোথাও তাদের ৫ একর জমি দেওয়া হবে মসিজদ নির্মাণ করার জন্য।” অযোধ্যা মামলার রায় ঘিরে বিশৃঙ্খলা এড়াতে শনিবার সকাল থেকেই উত্তরপ্রদেশ জুড়ে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। এ ছাড়া আগামীকাল পর্যন্ত রাজ্যের সব স্কুল-কলেজ বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। প্রতিবেশী কর্নাটক ও মধ্যপ্রদেশ রাজ্যেও একই নির্দেশ জারি হয়েছে। অযোধ্যার রায়ের পর আবারও ১৯৯২ সালের মতো দাঙ্গা পরিস্থিতির সৃষ্টি যেন না হয় সেজন্য সব রাজনৈতিক দল ও সম্প্রদায়ের নেতারা নিজ নিজ দলের কর্মী ও সমর্থকদের প্রতি শান্তি বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। ষোড়শ শতকে নির্মিত বাবরি মসজিদটি উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা ১৯৯২ সালে গুঁড়িয়ে দেয়। মসজিদটি ভাঙা নিয়ে ওই বছর হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গায় ভারতজুড়ে তিন হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারায়। অর্ধ শতাব্দীর বেশি সময় ধরে বাবরি মসজিদ ও রাম জন্মভূমি নিয়ে বিরোধীয় মামলা চলছিল। ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বরে বিতর্কিত জমিতে রামের মূর্তি স্থাপনের পরে ফৈজাবাদ আদালতে বাবরি মসজিদের পক্ষে প্রথম মামলা দায়ের করেন হাসিম আনসারি। ২০১৬ সালে তিনি মারা গেলে তার ছেলে ইকবাল আনসারি মামলার বাদী হন। এই রাম মন্দির ও বাবরি মসজিদের বিষয়টি ১৯৮০’র দশকে ভারতে অন্যতম রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছিল।

স্পর্শকাতর এ মামলাটি নিয়ে নানা টানাপড়েনের পর চলতি বছরের শুরুতে মধ্যস্থতার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টায় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট একটি কমিটি গঠন করে দেয়। ওই কমিটি সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলে নানাভাবে সমাধানে পৌঁছানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে গত ৬ আগস্ট থেকে কোনো বিরতি ছাড়া মামলার টানা শুনানি হয়। গত ১৬ অক্টোবর চূড়ান্ত শুনানি হলেও রায় প্রদান অপেক্ষমাণ রাখে শীর্ষ আদালত। অবশেষে শুক্রবার সুপ্রিম কোর্ট আকস্মিক এক ঘোষণায় জানায়, ৯ নভেম্বর রায় দেওয়া হবে।

পত্র-পত্রিকার খবর : রায়ের তারিখ ঘোষণার আগে প্রধান বিচারপতি গগৈ নিজের চেম্বারে ডেকে নিয়ে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী এবং পুলিশ বাহিনীর ডিজির সঙ্গে পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন। আগামী ১৭ নভেম্বর দেশের প্রধান বিচারপতির পদ থেকে অবসর নিচ্ছেন রঞ্জন গগৈ। তিনি আগেই জানিয়েছিলেন, অবসর নেওয়ার আগেই তিনি অযোধ্যার বিতর্কিত জমি মামলার রায় দিয়ে যেতে চান। সেই অনুযায়ী তার নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ গঠন করা হয়।

মোদির টুইট : রায় ঘোষণার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এক টুইট বার্তায় বলেন, ‘এই রায়ে কারও জয়-পরাজয় হয়নি। রামভক্তি হোক কিংবা রহিম ভক্তি, অত্যাবশ্যক বিষয় হলো আমরা রাষ্ট্রভক্তির চেতনায় আরও বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠব। শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় থাকুক।’

কংগ্রেসের প্রতিক্রিয়া : কংগ্রেস বলেছে, তারা এই রায়কে সম্মান করে। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আমরা আমাদের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধ ও ভ্রাতৃত্বের চেতনা মেনে চলতে এবং শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য সব পক্ষ ও সব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানাই। যুগে যুগে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও ঐক্য আমাদের সমাজকে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে, তা আবার নিশ্চিত করার দায়িত্ব আমাদের প্রত্যেকের।’

ওয়াকফ বোর্ডের অসন্তোষ : ভারতের সুপ্রিম কোর্ট অযোধ্যার বিতর্কিত ভূমিতে মন্দির নির্মাণের পক্ষে রায় দেওয়ায় উত্তর প্রদেশের সুন্নি সেন্ট্রাল ওয়াকফ বোর্ড অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। বোর্ডের আইনজীবী জাফরিয়াব জিলানি সাংবাদিকদের বলেন, এটা অবিচার হয়েছে...আমরা এই রায় মেনে নেব না। তবে আমরা রায়ের পুরো অংশের সমালোচনা করছি না। তিনি বলেন, ‘আমরা এই রায়কে সম্মান করি এবং জনগণের কাছে শান্তি বজায় রাখার অনুরোধ করছি। কোনো পক্ষের তরফ থেকেই এই রায়ের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে নামা উচিত হবে না। এখানে কারও জয় বা পরাজয়ের কিছু নেই। আমি শুধু এটা বলতে পারি, এই রায় সন্তোষজনক নয় এবং আমরা এমনটা আশা করিনি।’ রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ পিটিশন করা হবে কিনা সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য ওয়াকফ বোর্ড বৈঠক ডেকেছে।

সর্বশেষ খবর