শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

২৫ ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীর নামে চার্জশিট

♦ উচ্ছৃঙ্খল ছিল ওরা, সরাসরি অংশ নেয় ১১ ♦ ফুটেজ, রক্তমাখা জামাসহ ২১ আলামত ♦ ২১ আসামি জেলে, পলাতক ৪ ♦ নির্ভুল চার্জশিট : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

নিজস্ব ও আদালত প্রতিবেদক

২৫ ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীর নামে চার্জশিট

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যা মামলায় ছাত্রলীগের ২৫ নেতা-কর্মীকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করেছে পুলিশ। গতকাল ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে পুলিশের সাধারণ নিবন্ধন শাখায় এ অভিযোগপত্র জমা দেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক ওয়াহিদুজ্জামান। পরে অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম মো. কায়সারুল ইসলাম অভিযোগপত্রে স্বাক্ষর করে মামলার পরবর্তী শুনানির জন্য ১৮ নভেম্বর দিন ধার্য করেছেন। অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, গত ৬ অক্টোবর রাত ১০টা থেকে ২টা পর্যন্ত আবরারকে পেটানো হয়। ২টা ৫০ মিনিটের দিকে ডাক্তার তাকে দেখে মৃত ঘোষণা করেন। অভিযুক্ত ২৫ আসামির মধ্যে ১১ জন আবরার হত্যায় সরাসরি অংশ নেয়। আর সেখানে উপস্থিতি এবং অন্যভাবে সম্পৃক্ততার কারণে বাকি ১৪ জনকে আসামি করা হয়েছে। অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, ছাত্রশিবিরের সদস্য বলে সন্দেহের বিষয়টি আবরারের ওপর নির্যাতনের একমাত্র কারণ নয়, বরং একটি কারণ। আসলে বুয়েট ছাত্রলীগের ওই নেতা-কর্মীরা অন্যদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য উচ্ছৃঙ্খল আচরণে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। চার্জশিটে ২৫ আসামির প্রত্যেকের ছাত্রলীগের পদ উল্লেখসহ রাজনৈতিক পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এ চার্জশিটকে ‘নির্ভুল’ বলে মন্তব্য করেছেন। অভিযোগপত্রে মোট ৬০ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩১ জন ১৬১ ধারায় পুলিশের কাছে জবানবন্দি দিয়েছেন। তারা হলেন বাদীপক্ষের ছয়জন, বুয়েট শিক্ষক সাতজন, বুয়েট ছাত্র ১৩ জন এবং পাঁচজন বুয়েটের কর্মচারী। চার্জশিটের বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের অপরাধ তথ্য ও প্রসিকিউশন বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. জসিম উদ্দীন সাংবাদিকদের বলেন, অভিযোগপত্রে মোট ২১টি আলামত, আটটি জব্দ তালিকা যুক্ত করা হয়েছে। আলামত হিসেবে আবরার ফাহাদের রক্তমাখা জামাকাপড়, আসামিদের মেসেঞ্জারের কথোপকথন ও বুয়েটের শেরেবাংলা হলের ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ জব্দ দেখানো হয়েছে। তিনি বলেন, ২৫ আসামির মধ্যে চারজন পলাতক আছেন, তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন করা হয়েছে। বাকি ২১ আসামি গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন। এ ঘটনার দায় স্বীকার করে আট আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

গতকাল মামলার অভিযোগপত্র আদালতে পাঠানোর আগে বেলা ১২টার দিকে রাজধারীর মিন্টো রোডে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদকে কোনো একক কারণে হত্যা করা হয়নি। আবরার শিবির করেন কিনা, হত্যার পেছনে এটি একটি (অন্যতম) কারণ। কিন্তু যারা তাকে হত্যা করেছেন, তারা এমন উচ্ছৃঙ্খল আচরণে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন। কেউ আসামিদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করলে, সালাম না দিলে, তাদের সামনে হেসে দিলে ইত্যাদি কারণে তারা নির্যাতন করতেন। এ ছাড়া আসামিরা র‌্যাগিংয়ের নামে নতুনদের আতঙ্কিত রাখতে এসব কাজ করেন। র‌্যাগিংয়ের নামে উচ্ছৃঙ্খল কর্মকান্ডের অভ্যস্ততার অংশ হিসেবেই আবরার হত্যাকা টি সংঘটিত হয়েছে। হল প্রশাসন ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আগে থেকে মনিটরিং করলে এমন ঘটনা না-ও ঘটতে পারত। এটা তাদেরই মনিটর করার কথা। মনিরুল জানান, এ মামলায় গ্রেফতার ২১ জনের মধ্যে আটজন ইতিমধ্যে আদালতে দায় স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। আবরারকে কীভাবে ক্রিকেট স্টাম্প আর স্কিপিং রোপ দিয়ে কয়েক ঘণ্টা ধরে বেধড়ক পেটানো হয়েছিল, সেই ভয়ঙ্কর বিবরণ উঠে এসেছে তাদের জবানবন্দিতে।

আবরার হত্যার আসামি যারা : বহুল আলোচিত আবরার হত্যা মামলায় মোট ২৫ আসামির মধ্যে ১৯ জন এজাহারভুক্ত। পুলিশের তদন্তে আরও ছয়জনের নাম যুক্ত হয়েছে আসামি তালিকায়। আসামিদের মধ্যে ২১ জন গ্রেফতার হয়ে কারাগারে এবং বাকি চারজন পলাতক। গ্রেফতার আসামিদের মধ্যে আটজন ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।

এজাহারভুক্ত ১৯ আসামি : বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল, সহসভাপতি মুহতাসিম ফুয়াদ, সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান রবিন (সরাসরি মারপিটে অংশ নেয়), তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অনীক সরকার (সরাসরি মারপিটে অংশ নেয়), সাহিত্য সম্পাদক মনিরুজ্জামান মনির (সরাসরি মারপিটে অংশ নেয়), ক্রীড়া সম্পাদক মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন (সরাসরি মারপিটে অংশ নেয়), উপসমাজসেবা সম্পাদক ইফতি মোশাররফ সকাল (সরাসরি মারপিটে অংশ নেয়), সদস্য মুনতাসির আল জেমি (সরাসরি মারপিটে অংশ নেয়), সদস্য মুজাহিদুর রহমান (সরাসরি মারপিটে অংশ নেয়), সদস্য হোসেন মোহাম্মদ তোহা, এহতেশামুল রাব্বি তানিম (সরাসরি মারপিটে অংশ নেয়), শামীম বিল্লাহ (সরাসরি মারপিটে অংশ নেয়), মাজেদুল রহমান, আকাশ হোসেন, খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম তানভীর (সরাসরি মারপিটে অংশ নেয়), মুহাম্মদ মোর্শেদ-উজ-জামান ম ল জিসান, মোয়াজ আবু হোরায়রা, এ এস এম নাজমুস সাদাত (সরাসরি মারপিটে অংশ নেয়), মোর্শেদ অমর্ত্য ইসলাম (এমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ)।

এজাহারের বাইরের ছয় আসামি : বুয়েট ছাত্রলীগের গ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক ইসতিয়াক আহমেদ মুন্না, আইনবিষয়ক উপসম্পাদক অমিত সাহা, সদস্য মিজানুর রহমান, শামসুল আরেফিন রাফাত, উপদফতর সম্পাদক মুজতবা রাফিদ ও সাবেক সহসভাপতি এস এম মাহমুদ সেতু।

পলাতক চার আসামি : এহতেশামুল রাব্বি তানিম (এজাহারভুক্ত), মাহমুদুল জিসান (এজাহারভুক্ত), মোর্শেদ অমর্ত্য ইসলাম (এজাহারভুক্ত) ও মুজতবা রাফিদ (এজাহারের বাইরে)।

শিবির সন্দেহে শায়েস্তার পরিকল্পনা : গোয়েন্দা পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, আবরার ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন- এ সন্দেহেই তাকে শায়েস্তা করার সিদ্ধান্ত নেন বুয়েট ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করেই তাকে সন্দেহের চোখে দেখা হয়। তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ঘটনার আগে এ হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িতরা পরিকল্পনা করেন আবরারকে শায়েস্তা করার। ঘটনার আগে তারা একটি মিটিংও করেন। এর আগে বুয়েট ছাত্রলীগের এক নেতা ফেসবুক গ্রুপে আবরারকে শায়েস্তা করার ঘোষণা দেন। এতে অনেকেই সায় দেন। তারপর আবরারকে ৬ অক্টোবর শেরেবাংলা হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে ডেকে এনে মারধর করা হয়। তাকে কিল-ঘুষি মেরে, স্কিপিং দড়ি ও ক্রিকেট স্টাম্প দিয়ে বেধড়ক পেটান হত্যাকারীরা। তার মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত তাকে পেটানো হয়। পানি পানি বলে চিৎকার করলেও তাকে পানি খেতে দেওয়া হয়নি। আবরারকে পেটানোর একপর্যায়ে তিনি কয়েকবার বমি করেন। কিন্তু তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেননি কেউ। একপর্যায়ে গভীর রাতে আবরার মারা যাওয়ার পর তাকে ধরাধরি করে দোতলার সিঁড়ির ওপর ফেলে রাখেন হত্যাকারীরা।

ফিরে দেখা : গত ৬ অক্টোবর দিবাগত রাতে বুয়েটের শেরেবাংলা হল থেকে তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের লাশ উদ্ধার করা হয়। পরে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা তাকে পিটিয়ে হত্যা করেছেন। ওই ঘটনায় আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ বাদী হয়ে চকবাজার থানায় ১৯ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন।

আবরার ফাহাদ নিহত হওয়ার পর আন্দোলনে নেমে ১০ দফা দাবি তোলেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে বুয়েট শিক্ষক সমিতি ও সাবেক শিক্ষার্থীরাও সমর্থন প্রকাশ করেন। তাদের দাবির মুখে বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ, আবরার হত্যার আসামিদের সাময়িক বহিষ্কার এবং হলগুলোয় নির্যাতন বন্ধে নানা পদক্ষেপ নেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। আন্দোলন শিথিল করে ১৪ অক্টোবর ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার সুযোগ দিয়ে মাঠের আন্দোলনে ইতি টানলেও হত্যাকারীদের স্থায়ী বহিষ্কারের দাবিতে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের কর্মসূচি চালিয়ে যান শিক্ষার্থীরা। ১৯ অক্টোবর বুয়েটের টার্ম ফাইনাল পরীক্ষা শুরুর কথা থাকলেও আন্দোলনের কারণে তা এখনো হয়নি।

নির্ভুল চার্জশিট হয়েছে : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী : বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যায় তদন্ত সংস্থা যে চার্জশিট দিয়েছে তা নির্ভুল হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। গতকাল দুপুরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে বিজয় দিবস উপলক্ষে আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত বৈঠক শেষে সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে তিনি এ মন্তব্য করেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘বিচারের বিষয়টি পুলিশের হাতে নেই, সেটা আদালত করবে। আমরা আশা করি পুলিশের মাধ্যমে যে চার্জশিটটি গিয়েছে, তা নির্ভুল গিয়েছে।

সর্বশেষ খবর