শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভয়ঙ্কর যত বাধা

বন্ধ হচ্ছে না হুন্ডি-অর্থ পাচার, রিট-মামলায় আটকা ট্যাক্স, ব্যাংকের লক্ষাধিক কোটি টাকা

আলী রিয়াজ

ব্যাংক ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে না আসাসহ ভয়ঙ্কর সব বিষয় দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে ঋণখেলাপি, ঋণের সুদ ও ট্যাক্স না দিয়ে আদালতে রিট মামলা করে আটকে দেওয়া ও বিদেশে অর্থ পাচার সবচেয়ে বড় ঘটনা। সেই সঙ্গে উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থের লুটপাট তো রয়েছেই। বর্তমানে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপিদের দায়ের করা রিট ও মামলায় আটকে আছে প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা। ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করে করখেলাপিরা আটকে রেখেছেন প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। রিট, মামলায় এসব টাকা আটকে রেখে নিজেদের পাচার অব্যাহত রেখেছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। বৈধ পথে না পাঠিয়ে হুন্ডির মাধ্যমে তারা বিপুল পরিমাণ ডলার দেশের বাইরে পাঠাচ্ছেন। ভুয়া কোম্পানি খুলে আমদানি-রপ্তানির মাধ্যমে অর্থ পাচার ছাড়াও প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স অবৈধ হুন্ডির মাধ্যমে দেশে আনা হচ্ছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অর্থনীতি, ব্যাহত হচ্ছে অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা। ব্যাংকিং ও রাজস্ব খাতের নৈরাজ্য বন্ধ করতে হলে খেলাপিদের রিট বা মামলা করার ক্ষমতা কমানোর পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্লেষকরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, সারা দেশে অর্থ ঋণ আদালতে ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে মোট মামলার সংখ্যা প্রায় ৬০ হাজার। এসব মামলায় প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা পাওনা রয়েছে ব্যাংকগুলোর। এর মধ্যে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ছয় বাণিজ্যিক ব্যাংকের মামলার সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার। এতে পাওনা অর্থের পরিমাণ প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো অর্থঋণ আদালতে ৮ হাজার মামলার বিপরীতে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা পাওনা। নিয়মিত মামলার বাইরে উচ্চ আদালতে ব্যাংকের ঋণ বিষয়ে ৫ হাজারের বেশি রিট আবেদন রয়েছে; যার বিপরীতে ৫২ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা আটকে আছে। এসব রিটের মাধ্যমে আবেদনকারীরা আদালত থেকে স্থগিতাদেশ পেয়েছেন। ফলে এসব ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে ব্যাংক টাকাও পাচ্ছে না, আবার তাদের ঋণখেলাপি হিসেবে উল্লেখও করতে পারছে না। শীর্ষ ব্যাংকাররা এই রিট আবেদন খেলাপি ঋণ আদায়ে সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে দেখছেন। অন্যদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) বিরুদ্ধে করখেলাপিদের মামলায় আটকে আছে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা সরকারকে প্রদেয় কর দিচ্ছেন না। এরা বিভিন্ন মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে পণ্য আমদানি, ব্যাক টু ব্যাক এলসির পণ্য স্থানীয় বাজারে বিক্রি এমনকি ভুয়া কোম্পানির নামে পণ্য আমদানি-রপ্তানি দেখিয়ে শত শত কোটি টাকা পাচার করছেন। নিজেদের পণ্য নিজেরাই আমদানি করে অর্থ পাচার করছেন। হুন্ডির মাধ্যমে আনা হচ্ছে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ। একাধিক মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাপ ব্যবহার করে, নগদ অর্থ ও ভুয়া আমদানি-রপ্তানির মাধ্যমে অবৈধ হুন্ডি বাণিজ্য চলছে। এসব অসাধু ব্যবসায়ীর কারণে সরকার রাজস্ব পাচ্ছে না। রাজস্ব ঘাটতির একটি বড় কারণ হিসেবে মামলাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ ছাড়া দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও ব্যাহত হচ্ছে এসব কারণে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির একটি অন্যতম কারণ রিট ও মামলা। সারা দেশে অর্থ ঋণ আদালতের পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় কম। এও একটি সংকট। তবে ঢালাও রিট করার ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়, আদালতের সঙ্গে বসে একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে যারা ফেরত দিতে চান না তাদের আটকাতে হবে।’ বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ বলেন, ‘অসাধু ব্যবসায়ীরা সব সময় সুযোগ খোঁজেন। ঋণ ফেরত না দেওয়া, কর না দেওয়া এসব চক্র উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মামলা করে আটকে দেয়। এভাবে ঢালাও মামলা করা ঠেকাতে কর্তৃপক্ষের কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। খেলাপি ঋণের অর্থ ব্যাংকগুলো আদায় করতে পারলে ব্যাংকিং খাতে কোনো সংকট থাকবে না।’ এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, ‘কর ফাঁকিবাজরা সব সময় সুযোগে থাকেন। তারা মামলা করেন কর না দেওয়ার উদ্দেশ্যে। এদের কারণে কর আদায় কম হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবে সব কর আদায় করতে পারলে সরকারের কর্মকা- আরও গতিশীল হতো।’

সর্বশেষ খবর