শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনার আসল কারণ

সংসদে মন্ত্রীর দুঃখ প্রকাশ, কাজ শুরু তদন্ত কমিটির, অপমৃত্যু মামলা

নিজস্ব প্রতিবেদক, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও হবিগঞ্জ প্রতিনিধি

ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনার আসল কারণ

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় মন্দবাগে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনার আসল কারণ কয়েকটি। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিনের পাশাপাশি ত্রুটিপূর্ণ সিগন্যালিং ব্যবস্থাসহ অন্তত ৭ থেকে ১০টি কারণে রেল দুর্ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে। তারাও ঘটনার মূল কারণগুলো বের করার চেষ্টা করছেন। এদিকে দুর্ঘটনায় ১৬ জনের মৃত্যুর ব্যাপারে আখাউড়া জিআরপি থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা হয়েছে।

গত মঙ্গলবার রাতে এ মামলাটি করেন মন্দবাগ রেলস্টেশন মাস্টার মো. জাকের হোসেন চৌধুরী। এতে চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা তূর্ণা নিশীথা হোম আউটার সিগন্যাল অমান্য করে চলায় দুর্ঘটনা ঘটে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

দুর্ঘটনার আসল কারণ : লোকো মাস্টার এবং রেলের গার্ডদের ভাষ্য অনুযায়ী, সোমবার গভীর রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মন্দবাগ রেল স্টেশনে ঘটে যাওয়া প্রাণঘাতী দুর্ঘটনাই শুরু কিংবা শেষ নয়। নানা ত্রুটি-বিচ্যুতির কারণে রেলপথে প্রায়ই ঘটছে নানা দুর্ঘটনা। অবৈধ লেভেল ক্রসিং দিয়ে রেল লাইনে অন্যান্য যানবাহন উঠে যাওয়ায় যেমন দুর্ঘটনা ঘটছে, তেমনি দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত রিপিটার সিগন্যাল লাগানো হয়নি। যে কারণে লোকো মাস্টার দূরবর্তী সিগন্যাল দেখতে না পেলে তার কিছু করার থাকে না। অথচ রিপিটার সিগন্যাল কার্যকর থাকলে দুর্ঘটনা অনেকাংশে এড়ানো সম্ভব। লোকো মাস্টার অ্যাসোসিয়েশন সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আলী গণমাধ্যমকে বলেন, অপরিকল্পিত বনায়ন দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। চট্টগ্রাম রেলওয়ে লোকো মাস্টার মোহাম্মদ হানিফ বলেন, অবৈধ লেভেল ক্রসিং মারাত্মক সমস্যা। লাইনে গাড়ি উঠে গেলে আসলে তখন কিছু করার থাকে না। রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে প্রতিদিন আড়াইশর বেশি ট্রেন চলাচল করছে। এর মধ্যে যাত্রীবাহী ট্রেন রয়েছে দেড়শর বেশি। কিন্তু মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন জোড়াতালি দিয়ে সচল রাখতে হচ্ছে রেল যোগাযোগ। সেই সঙ্গে ত্রুটিপূর্ণ সিগন্যাল ব্যবস্থাও রেল দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। চট্টগ্রাম রেলওয়ের লোকো মাস্টার জাহিদুল ইসলাম বলেন, গাড়িটি কন্ট্রোল করার জন্য যে অটোমেটিক ব্রেক সেগুলো অনেক সময় কাজ করে না। তবে চলতি পথে লোকো মাস্টারের ঘুমিয়ে পড়ার কারণেও দুর্ঘটনা ঘটছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

তদন্ত কমিটির কাজ শুরু : দুর্ঘটনায় গঠিত বিভিন্ন তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে। গতকাল বিকালে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের একটি তদন্ত কমিটি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। চার সদস্যবিশিষ্ট এই কমিটির প্রধান রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (আইন ও ভূমি) মো. রফিকুল ইসলাম। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- রেলওয়ের প্রধান সংকেত এবং টেলিযোগাযোগ কর্মকর্তা মু. আবুল কালাম, যুগ্ম মহাপরিচালক (অপারেশন) রশিদা সুলতানা গণি ও রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব আলমগীর হোসেন।

তদন্ত কমিটির প্রধান রফিকুল ইসলাম ঘটনার বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করেন এবং স্টেশন মাস্টার জাকের হোসেন চৌধুরীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন এবং তার কক্ষে বিভিন্ন রেজিস্টার দেখেন এবং তথ্য লিখে নেন। তারা আউটার ও হোম সিগন্যালে কোনো ত্রুটি ছিল কিনা সে বিষয়টি ভালোভাবে খতিয়ে দেখেন। রফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, তদন্ত করে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হবে। এই কমিটি আগামী পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে তাদের রিপোর্ট জমা দেবে। জানা গেছে, পূর্বাঞ্চলের সিআরবিতে প্রায় ৪০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। আরও কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

এদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসনের গঠিত তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি তাদের তদন্ত কাজ শুরু করেছে। ঘটনার পরপরই দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে এই কমিটি তাদের কাজ শুরু করে বলে জানিয়েছেন তদন্ত কমিটির সদস্যরা। প্রাথমিকভাবে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেছেন তারা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিতু মরিয়মকে প্রধান করে এ তদন্ত কমিটি হয়েছে। এ কমিটির অন্য দুই সদস্য হচ্ছেন কসবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও জেলা পুলিশের একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার। তবে এ তদন্ত কমিটির কোনো মেয়াদ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়নি।

চিহ্নিত কারণ : কসবার মন্দবাগে দুটি ট্রেনের মর্মান্তিক দুর্ঘটনার ১০টি কারণকে চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলিক জেনারেল ম্যানেজারের করা তদন্ত কমিটি। গতকাল বিকালে তদন্ত কমিটির প্রধান পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা মো. নাসির উদ্দিন বলেন, আমরা মঙ্গলবার দিনভর ঘটনাস্থলে থেকে যাবতীয় বিষয় নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করেছি। চালকের ভুলের পাশাপাশি, সিগন্যালের ত্রুটি, আবহাওয়া জনিত কারণ এসবের মধ্যে রয়েছে বলে তিনি স্বীকার করেন। আমাদের তদন্ত কাজ প্রায় শেষের পথে। আমরা বৃহস্পতিবারই আমাদের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারব। তিনি আরও বলেন, ট্রেন দুর্ঘটনার কারণে তূর্ণা নিশীথা ও উদয়ন ট্রেনের চালক, সহকারী চালক ও পরিচালকরা আহত হয়ে ঢাকায় চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাদের তলব করেছি।

আহতদের জন্য ১০ হাজার টাকা : মন্দবাগে ট্রেন দুর্ঘটনায় আহতদের চিকিৎসা সহায়তা হিসেবে ১০ হাজার টাকা করে দেওয়া হচ্ছে রেলওয়ের পক্ষ থেকে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদর হাসপাতালে ভর্তি একমাত্র চিকিৎসাধীন হবিগঞ্জের বানিয়াচং চৌধুরী পাড়ার সাধন চক্রবর্তীর ছেলে সুব্রত চক্রবর্তীকে (৪৫) দেখতে যান। এ সময় তারা সুব্রতকে ১০ হাজার টাকা সহায়তা প্রদান করেন। গতকাল দুপুরে এই টাকা তুলে দেন রেলওয়ের ঢাকা বিভাগের বাণিজ্যিক কর্মকর্তা শওকত হোসেন মহসীন। এ সময় তিনি জানান, আহত সবাই ১০ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ পাবেন। তিনি জানান, নিহতদের প্রতি পরিবারের জন্য রেলমন্ত্রীর ঘোষিত ১ লাখ টাকা অল্প সময়ের মধ্যেই তাদের হাতে তুলে দেওয়া হবে।

মৃত্যু আধিক্যে সিলেট ও চাঁদপুর : ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহত ১৬ জনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। তাদের মৃতদেহ মঙ্গলবার রাত ৯টা পর্যন্ত স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। নিহতদের বেশির ভাগই সিলেট এলাকার। তারপরই নিহতের হিসেবে চাঁদপুর জেলার আধিক্য। নিহতরা হলেন হবিগঞ্জ জেলার ভোল্লা সদরের ইয়াছিন আরাফাত (১২), সৈয়দাবাদ সদরের রিপন (৪৫), চুনারুঘাট তীরেরগাঁওয়ের সুজন আহম্মেদ (২৪), হবিগঞ্জ শহরের আনোয়ারপুরের আলী মোহাম্মদ ইউসুফ (৩২), চুনারুঘাটের আহম্মেদাবাদের পিয়ারা, বানিয়াচং বড়বাজারের আদিবা (২), মদনমুরকের মো. আল আমিন (৩০) এবং সিলেটের শ্রীমঙ্গলের গাজীপুরের জাহেদা খাতুন (৩০), চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জের পশ্চিম রাজাগাঁও গ্রামের মজিবুর রহমান (৫৫), তার স্ত্রী কুলসুম বেগম (৩০), হাইমচর দক্ষিণ তিরাশির কাকলি আক্তার (৩২), মরিয়ম (৪), চাঁদপুর সদরের উত্তর বালিয়ার ফরজানা (১৫), ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের ছোয়া মণি (৩), নোয়াখালী মাইজদির রবি হরিজন (২৩), শরীয়তপুর জেলার ভেদরগঞ্জ থানার দক্ষিণ তিরাশির আমাতুন বেগম (৪১)।

সংসদে রেলমন্ত্রীর দুঃখ প্রকাশ : ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কসবার মন্দবাগ রেলস্টেশনের ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনার জন্য সংসদে দুঃখ প্রকাশ করেছেন রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন। এ দুর্ঘটনার জন্য তূর্ণা নিশীথা ট্রেনটির লোকোমাস্টার, সহকারী লোকোমাস্টার ও গার্ড প্রাথমিকভাবে দায়ী বলে জানিয়েছেন রেলমন্ত্রী। গতকাল রেল দুর্ঘটনা নিয়ে সংসদে তিনি এক বিবৃতিতে এসব কথা বলেন। মন্ত্রী জানান, প্রতিটি দুর্ঘটনা দুঃখজনক। গত সোমবার গভীর রাতে সিলেট থেকে চট্টগ্রামমুখী উদয়ন এক্সপ্রেস ট্রেনটি মন্দভাগ স্টেশনের তিন নম্বর লুপ লাইনে যাচ্ছিল। ট্রেনটির ১৫টি বগির ১১টি লুপ লাইনে চলে যায়, বাকি ছিল ৪ বগি। এ সময় চট্টগাম থেকে ঢাকামুখী আন্তনগর তূর্ণা নিশীথা ট্রেনটি উদয়ন এক্সপ্রেসের পিছনের ৪টি বগিতে আঘাত করে। প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, তূর্ণার লোকোমাস্টার ও গার্ড সিগন্যাল অমান্য করে স্টেশনের দিকে ছুটে এসে এ দুর্ঘটনা ঘটায়।

মন্ত্রী জানান, এ দুর্ঘটনা ঘটানোর জন্য তূর্ণার লোকোমাস্টার নাসির উদ্দীন, সহকারী লোকোমাস্টার অপু দে এবং গার্ড আবদুর রহমানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। রেলওয়ের পক্ষ থেকে নিহত যাত্রীদের প্রত্যেকের পরিবারকে ১ লাখ টাকা এবং আহতদের ১০ হাজার টাকা সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। এ সময় রেলমন্ত্রী রেল দুর্ঘটনা আর যাতে না ঘটে এবং রেলকে নিরাপদ বাহন হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সর্বস্তরের কর্মীরা সজাগ থাকবেন বলে আশা প্রকাশ করেন।

সর্বশেষ খবর