বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

আহতদের আহাজারি পঙ্গু হাসপাতালে

মাহবুব মমতাজী

আহতদের আহাজারি পঙ্গু হাসপাতালে

মেয়েকে হারিয়ে পাগল প্রায় মা : রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে অনবরত কাঁদছেন নাজমা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় রেল দুর্ঘটনায় ছোট মেয়ে ছোঁয়া মণিকে হারিয়ে পাগলপ্রায়। দুর্ঘটনায় তিনি, ছেলে ও স্বামীসহ পরিবারের ৪ জন আহত হয়েছেন -রোহেত রাজীব

স্বজন হারানোর বেদনা আর আহতদের বেঁচে ফেরার ভয়াবহ অভিজ্ঞতায় ভারী হয়ে উঠেছে রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের (পঙ্গু হাসপাতাল) পরিবেশ। আপন মানুষের নিথর দেহের ছবি যেন বারবারই তাদের চোখের সামনে ভেসে উঠছে। স্বজনরা বেদনায় কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। থামছে না তাদের আহাজারি। একদিকে স্বজনকে হারিয়েছেন ট্রেনে থাকা যাত্রী, অন্যদিকে নিজেই ক্ষত-বিক্ষত শরীর নিয়ে কাতরাচ্ছেন হাসপাতালের বিছানায়। সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষাও হারিয়ে ফেলেছেন উপস্থিত সবাই। ব্রাহ্মণবাড়িয়া কসবার ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনায় আহত একই পরিবারের ছয়জন পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি আছেন। দুর্ঘটনার ভয়াবহতা থেকে নিজেদের বাঁচতে পারলেও হারিয়েছেন শরীরের কোনো না কোনো অঙ্গ। হারিয়েছেন পরিবারের সদস্য প্রিয় ফারজানাকে। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে ছোট মেয়ে ফারজানার জন্য বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন আহত মা রোজিনা বেগম। কোলের কাছে আগলে রেখেও তাকে ধরে রাখতে পারেননি তিনি। কিছুতেই মনকে বুঝ দিতে পারছেন না রোজিনা। বাবা বেলাল হোসেন বেপারী মেয়ে হারানোর খবরে ছুটে এসেছেন সেই কুয়েত থেকে। তবু বাবা-মা কেউই আদরের মেয়েকে অন্তত একবার শেষবিদায়ও জানাতে পারেননি। তখন বাবা ছিলেন কুয়েত বিমানবন্দরে, আর মা গুরুতর আহতাবস্থায় কাতরাচ্ছিলেন রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে। একমাত্র ভাই হাসানও দেখতে পারেননি ফারজানাকে শেষ দেখা। ততক্ষণে দাফন হয়ে যায় ফারজানার লাশ। ফারজানার (১৬) মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষার ফরম পূরণের শেষ দিন ছিল আজ বৃহস্পতিবার। তাই মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে খালাতো বোনের বিয়ের অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে সোমবার রাতে বাড়ি ফিরছিল তারা। তাদের বাড়ি চাঁদপুর সদরের বালিয়া গ্রামে। ফেরার পথে ট্রেন দুর্ঘটনায় নিভে যায় বাগাদি গণি উচ্চবিদ্যালয়ের মেধাবী এই ছাত্রীর জীবনপ্রদীপ। উদয়ন ট্রেনের ৫ নম্বর ‘ঝ’ বগিতে ছিলেন ফারজানা। মা রোজিনা বেগম, নানী ফিরোজা বেগম, ভাই হাসান বেপারী, মামি সাহিদা, মামাতো বোন মিতুও ছিলেন একই বগিতে। কসবার মন্দবাগ স্টেশন এলাকায় সোমবার দিবাগত রাত ৩টা ১০ মিনিটে চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী তূর্ণা নিশীথা ও সিলেট থেকে ছেড়ে আসা চট্টগ্রামগামী উদয়ন এক্সপ্রেস ট্রেনের মধ্যকার সংঘর্ষে নিহত হন ১৬ জন। মর্মান্তিক ওই দুর্ঘটনায় লাশের সারিতে স্থান হয় কুয়েত প্রবাসী বিল্লাল হোসেন বেপারীর মেয়ে ফারজানার। এ দুর্ঘটনায় ফারজানার সঙ্গে থাকা তার মা বেবী বেগম, ভাই হাসান বেপারী, নানী ফিরোজা বেগম, মামাতো বোন মিতু, মামি সাহিদাসহ আট স্বজন গুরুতর আহত হন। মঙ্গলবার বিকালে ফারজানার লাশ বাড়িতে নেওয়ার পর সহপাঠীসহ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসী ছুটে আসেন। ওই দিন বাদ মাগরিব তার দাফন সম্পন্ন হয়। গতকাল হাসপাতালে ফারজানার খালাতো ভাই রাসেল এ প্রতিবেদককে জানান, গত বৃহস্পতিবার তার বোনের বিয়ের অনুষ্ঠানে যায় ফারজানা। ফেরার পথে এ দুর্ঘটনার শিকার হয় সে। এ সময় তার দুই পা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এতে তার প্রচ- রক্তক্ষরণ হতে থাকে। ওই বগিতে থাকা তার ভাই হাসান আহতাবস্থায় দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া বগি থেকে পরিবারের অন্যদের উদ্ধার করেন। এরপর হাসান নিজের মুঠোফোন থেকে বিভিন্ন স্থানে থাকা স্বজনদের খবর দেন। খবর পেয়ে তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থলের দিকে ছোটেন স্বজনরা। কসবা স্টেশন থেকে পরিবারের সবাইকে উদ্ধার করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালে নেওয়ার পথে মায়ের কোলে চোখ খোলা অবস্থায় মারা যায় ফারজানা। পরে অন্যদের ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতাল থেকে কুমিল্লা সদর, সেখান থেকে বারডেম হাসপাতালে আনা হয়। এরপর পঙ্গু হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। ফারজানা ক্লাসে ভালো ছাত্রী ছিল। এদিকে মেয়ের মৃত্যুর সংবাদে মঙ্গলবার দিবাগত রাত ৩টায় ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছান বেলাল হোসেন বেপারী। সেখান থেকে সরাসরি হাসপাতালে আসেন তিনি। মেয়ে হারানোর বেদনা আর হাসপাতালের বিছানায় আহত স্বজনদের কাতরানোর দৃশ্য দেখে তিনিও ধরে রাখতে পারেননি চাপা কান্না। মঙ্গলবার সন্ধ্যা থেকে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে মেয়ের জন্য অনবরত কাঁদছেন নাজমা আক্তার নামে আহত আরেক নারী। একই দুর্ঘটনায় কেড়ে নিয়েছে তার দুই বছর দুই মাস বয়সী মেয়ে আদিবা আক্তার সোহাকে। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলছিলেন, ‘মেয়েটা আমার কোলেই ছিল। হঠাৎ যখন জোরে শব্দ পাই, তখন মেয়েটাকে আরও জোরে জড়িয়ে ধরি। কিন্তু মেয়েটাকে বাঁচাতে পারলাম না।’ ওই দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন নাজমার পরিবারের আরও তিন সদস্য। এর মধ্যে স্বামী মহিন আহমেদ সোহেল ও চার বছর বয়সী ছেলে নাফিজুল হক নাফিজ চিকিৎসাধীন রয়েছেন পঙ্গু হাসপাতালেই। নাজমার খালা রেণুও (৪৫) আহত হয়েছেন একই দুর্ঘটনায়।

সর্বশেষ খবর