বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

পুঁজিবাজার ছেড়েছেন ৬ লাখ ২৪ হাজার বিনিয়োগকারী

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

গত পাঁচ বছরে পুঁজিবাজার ছেড়ে চলে গেছেন ৬ লাখ ২৪ হাজার ৩৩৩ জন শেয়ারধারী। আরও প্রায় ৪ লাখ বিনিয়োগকারী পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) অ্যাকাউন্ট খুললেও তারা কোনো ধরনের লেনদেনই করেননি।

সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি অব বাংলাদেশ লিমিটেড (সিডিবিএল) শেয়ারবাজারে বিও অ্যাকাউন্ট সম্পর্কে এসব তথ্য সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, পুঁজিবাজার থেকে বিনিয়োগকারী চলে যাওয়ার  এই ঘটনাটি এক দিনে ঘটেনি। পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ও হতাশা থেকে তারা ধীরে ধীরে সরে গেছেন। বিপুলসংখ্যক শেয়ারধারী পুঁজি হারিয়ে অনেকেই সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছেন। অনেকে দীর্ঘদিন ধরে লোকসান করতে করতে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন। অনেকে আবার বিও অ্যাকাউন্ট করার পর পুঁজিবাজারের মন্দাবস্থা দেখে আর বিনিয়োগে আসেননি।  সিডিবিএলের তথ্য বলছে, ২০১৫ সালে সিডিএস-এ সংরক্ষিত পরিচালনযোগ্য বিও অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ছিল ৩১ লাখ ৯৫ হাজার ৮৫২টি। ২০১৬ সালে এটি কমে ৩১ লাখ ৫৫ হাজার ৫৮৫টিতে,  ২০১৭ সালে ২৯ লাখ ২৮ হাজার, ২০১৮ সালে ২৭ লাখ ৬৬ হাজার এবং চলতি বছরের ৩ নভেম্বর পর্যন্ত কমে ২৫ লাখ ৭১ হাজার ৫১টিতে নেমে আসে।

তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, গত এক বছরে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগকারী পুঁজিবাজার ছেড়েছেন, যার সংখ্যা ১ লাখ ৯৪ হাজার ৮৬৪ জন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিটি অ্যাকাউন্টের সঙ্গে একজন বিনিয়োগকারীর স্বপ্ন আর প্রত্যাশা মিশে ছিল। কিন্তু তারা যখন বুঝতে পেরেছেন এই পুঁজিবাজার থেকে মুনাফার আশা নেই, তখন তারা পিছু হটেছেন। অনেকের এমন অবস্থা হয়েছে যে তারা আর পরবর্তী জীবনে স্বাভাবিক হতে পারেননি। অনেকে অতি মুনাফার আশায় আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ধারদেনা করে বিনিয়োগ করেছিলেন। তারা যখন শেয়ারের দরপতনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হন তখন আর সেই অর্থ পরিশোধ করতে পারেননি। অর্থ হারানোর দীর্ঘমেয়াদি এই মানসিক চাপ অনেকে নিতে পারেননি। শুধু যে বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজার ছাড়ছেন তা-ই নয়, বিনিয়োগে আসার জন্য আগ্রহী হয়ে বিও অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন এমন ৪ লাখের বেশি অ্যাকাউন্টধারী কখনই লেনদেন করেননি বলে জানিয়েছে সিডিবিএল। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী ৩ নভেম্বর শেষে ৪ লাখ ২৯ হাজার ৪৪৬টি বিও অ্যাকাউন্ট চিহ্নিত হয়েছে যারা কখনই লেনদেন করেননি। এ ছাড়া লেনদেন না করার কারণে এ বছর প্রায় ৩ লাখ বিও অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতিবছরই নবায়ন করতে হয় বিও অ্যাকাউন্ট বা হিসাব। সেই ধারাবাহিকতায় এ বছর নবায়ন না করায় প্রায় তিন লাখ বিও অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিয়েছে সিডিবিএল। বন্ধ হয়ে যাওয়া এসব বিও হিসাবের মাধ্যমে শেয়ারবাজারে আর লেনদেন করতে পারবেন না অ্যাকাউন্টধারীরা। প্রতি বছর নবায়ন ফি প্রদান না করায় বিও হিসাব বন্ধ করে দেয় সিডিবিএল। তবে এ বছরই সবচেয়ে বেশিসংখ্যক বিও অ্যাকাউন্ট বন্ধ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। শেয়ারবাজার বিশ্লেষকরা জানান, ২০১০ সালের শেয়ারবাজার ধসের পর এখনো বিপুলসংখ্যক বিনিয়োগকারী বাজার ছাড়ছেন। বাজারের ওপর আস্থা ও আগ্রহ হারিয়ে ফেলায় এসব বিনিয়োগকারী বিও অ্যাকাউন্ট নবায়ন করেননি।

২০১০ সালের শেয়ারবাজার ধসের পর এ বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদকে প্রধান করে। সেই কমিটি সরকারকে একটি প্রতিবেদন দিয়েছিল যেখানে বিএসইসি ঢেলে সাজানোসহ পুঁজিবাজার কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছিল। ইব্রাহীম খালেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শেয়ারবাজার থেকে বিনিয়োগকারী এক দিনে চলে যায়নি। ২০১০ সাল থেকেই এটি ঘটছে। এর প্রধান কারণ হলো বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতা। বাংলাদেশের দুটি পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে যারা বিনিয়োগ করেন তাদের বেশির ভাগই মধ্যবিত্ত ও স্বল্প আয়ের মানুষ। এরা পুঁজি হারানোর পর আর ফিরে আসার শক্তি রাখেন না। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এই ডেপুটি গভর্নর বলেন, বিনিয়াগকারীদের আস্থাহীনতার অন্যতম কারণ হচ্ছে এর নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এটির যারা নিয়ন্ত্রক তারা আইন অনুযায়ী কাজ করছেন না। আর দুই পুঁজিবাজারেই ছোট একটি চক্র আছে যারা শেয়ারের দাম হঠাৎ বাড়িয়ে দিয়ে বিনিয়াগকারীদের টেনে এনে মুনাফা তুলে নিয়ে সরে যায়।

সর্বশেষ খবর