সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা
মতামত

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংকট ক্ষমতাকেন্দ্রিক দলীয় রাজনীতিতে

রোবায়েত ফেরদৌস

প্রায় এক ডজন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন বিভিন্ন ইস্যুতে অস্থিরতা চলছে। আবরার হত্যার প্রতিবাদে বুয়েটে অলিখিত ধর্মঘট চলছে। বড় ও ভয়ঙ্কর জটটি লেগেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। জট খোলার কোনো ইঙ্গিতও আর পাওয়া যাচ্ছে না। উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিসহ কয়েকটি দাবিতে জাহাঙ্গীরনগরে কয়েক মাস ধরে আন্দোলন চলছে। আন্দোলনরত শিক্ষকরা ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ করে ধর্মঘটও করেছেন। ক্যাম্পাসে কিছুদিন চলেছে বেশ যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব। আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জোর লড়াই চলছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে পুলিশের পাহারাও চলেছে। পরিচয়পত্র ছাড়া ক্যাম্পাসে প্রবেশ তখন ছিল নিষিদ্ধ। একপর্যায়ে প্রশাসন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে- চলছে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট। বলতে দ্বিধা নেই, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বশাসনের অধিকার-বোধটি প্রায় হারিয়ে গেছে জ্ঞানের অচর্চায়, ক্ষমতার আকর্ষণে। স্বাধীন জ্ঞানচর্চার সঙ্গে কর্তৃত্বপরায়ণ রাষ্ট্র ক্ষমতার যে একটি বিরোধ রয়েছে, আমরা তা বেমালুম ভুলে গেছি। নীতিহীন ব্যক্তিস্বার্থকেন্দ্রিক অন্ধ দলীয় রাজনীতির জন্য মুক্তচিন্তা আর বিবেকের স্বচ্ছতাকে বিসর্জন দিতে আমাদের একবিন্দুও বাধে না। দলীয় রাজনীতিতে ব্যক্তিগত বিশ্বাস আর অন্ধভাবে দলীয় স্বার্থের অনুসরণ যে এক নয়, এ বোধটিও আমরা ভুলে গেছি। অন্ধ দলীয় আনুগত্য, পদ-পদবি বা ক্ষুদ্র লাভের আশায় শিক্ষকদের কি নিজেদের বিবেক বেচে দেওয়া সাজে? অথচ দেখি জাতীয় রাজনীতির গতিধর্মের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আর এক শ্রেণির শিক্ষক নিজেদের অন্তর্লীন করে ফেলেছে। ফলে নিজের স্বতন্ত্র পরিচয় ও স্বাধীন অস্তিত্ব তৈরি করতে ব্যর্থ হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। জাতীয় পর্যায়ে চর্চিত অগণতান্ত্রিক রাজনীতির নীতিহীন ভয়াবহতা যেমন গ্রাস করছে শিক্ষার্থীদের তেমনি শিক্ষকদেরও। ক্ষমতায় থাকা কিংবা ক্ষমতার সিঁড়ির ওপরের ধাপে যেতে তারা দলকানা হয়ে যে কোনো কিছু করতে প্রস্তুত। সেখানে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মকানুন তো দূরে থাক কোনো ধরনের নৈতিকতারও তোয়াক্কা করেন না । এখানে নিয়ম-কানুন ব্যক্তি ও সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থনির্ভর। ক্ষমতাসীন হলে বা নিদেন পক্ষে ক্ষমতাসীন দলের সেবক হতে পারলে ‘অনিয়মও নিয়ম’ আবার ‘নিয়মও অনিয়ম’। এ যেন জর্জ অরওয়েলের ‘অ্যানিমেল ফার্মের’ কথা মনে করিয়ে দেয়- “অল আর ইকুয়াল বাট সাম অর মোর ইকুয়াল দেন আদারস”। তাই জবাবদিহিতাবিহীন সর্বোচ্চ পদে আসীন ব্যক্তি কখনো কখনো নিজেই আইনে পরিণত হয়ে পড়ছেন বা দুর্জন হয়ে উঠছেন, নিজের আকাক্সক্ষা চরিতার্থ করবার জন্য। কী নির্মমভাবেই না আমরা জেনে গেছি ক্ষমতার সেবা করতে গিয়ে এই সেবকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক পরিবেশকে, নিয়ম-কানুন নৈতিকতাকে গুঁড়িয়ে দিচ্ছেন প্রতিদিন প্রতিনিয়ত। অনৈতিকতার আশ্রয় নিচ্ছেন ক্ষমতাসীনদের তুষ্ট করবার জন্য। আর বিশ্ববিদ্যালয়কে অন্ধকার গলিতে দাঁড় করিয়ে পরিয়ে দিচ্ছেন অনৈতিক প্রতিযোগিতা আর অনিয়মের জামা।

আসলে বিবেকের সদর দরজা বন্ধ রেখে ভবনের খিড়কি খুলে রাখলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃত উদ্দেশ্য পূরণ হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যমান পরিস্থিতি একদিনে তৈরি হয়নি, এ এক দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ফল। ধীরে ধীরে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হারিয়ে গেছে সুস্থ প্রতিযোগিতার সংস্কৃতি। উপাচার্যসহ সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পদের বণ্টন হয় রাষ্ট্রক্ষমতা তথা রাজনীতির সঙ্গে নৈকট্য আর ব্যক্তিগত আনুগত্যের ভিত্তিতে। শিক্ষক রাজনীতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিল, আছে, থাকবে। কিন্তু অতীতের সঙ্গে বর্তমানের পার্থক্য হলো নব্বুইয়ের দশকের পর থেকে শিক্ষক রাজনীতি মোটা দাগে জাতীয় পর্যায়ের অপরাজনীতির অনুসারী ও চর্চাকারী হয়ে পড়েছে। সিভিল সমাজের প্রাগ্রসর অংশটি অজ আত্মসাৎ হয়ে গেছে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের দ্বারা। ফলে পেশাগত সততা, প্রাতিষ্ঠানিক স্বকীয়তার বদলে প্রায় প্রতিদিন দেখা যায় শিক্ষকদের একাংশের বিবৃতি কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষ অবলম্বন করে, যা ক্রমশ আমাদের দেউলায়িত্বকেই মূর্ত করে তুলছে। দুঃখজনক যে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান পদকে সব সময় ব্যবহার করা হচ্ছে ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠন আর দলীয় রাজনীতির আধিপত্য বিস্তারের জন্য। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ক্রীড়ানকে পরিণত হয়ে গেছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। অথচ আমরা দাবি করি, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন আছে। বিশ্ববিদ্যালয় চলছে ’৭৩-এর আদেশ বলে। যে উদ্দেশ্যে ’৭৩-এর আদেশ প্রণয়ন করা হয়েছিল তাকে মিথ্যে প্রতিপন্ন করে দেখি ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছে অনুযায়ীই বিশ্ববিদ্যালয় চলছে। অনেক সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ অতি তুচ্ছ বিষয়েও সিদ্ধান্ত আসে রাষ্ট্রের ওপর মহল থেকে। তাই বাস্তবিক পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘স্বায়ত্তশাসনে’র পরিবর্তে বিভিন্ন চেহারায় বিরাজ করছে সরকারি দলের ‘আয়ত্তশাসন’। জাতীয় রাজনীতির অপছায়া মূলধারার ছাত্ররাজনীতিতেও প্রকট। রাজনীতির চর্চায় আদর্শ পুরোপুরি লোপ পেয়েছে। ছাত্ররাজনীতি এখন নেহায়তই পেশা বা বিনা পুঁজির ব্যবসা। এর সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছে অনিয়ম, জালিয়াতি, কালো টাকা, সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক আর ঠিকাদারি ব্যবসা। কোনো কোনো ছাত্রনেতা হেলিকপ্টারে চড়েন, ৬০ লাখ টাকার গাড়িতে চলাফেরা করেন। যে রাজনীতি এমন জৌলুসে ভরা, ধনী আর সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ার সহজ সিঁড়ি, সেখানে নৈতিকতার স্থান কোথায়? সেই জৌলুসপূর্ণ রাজনীতির জন্য জাল-জালয়াতি, মরিয়া আর সহিংস হয়ে ওঠা তাই স্বাভাবিক বৈকি। শিক্ষাঙ্গনের যে নিয়ন্ত্রণ কারও নিশ্চিত অর্থের নিশ্চয়তা দেয়, সেই নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সংঘাত থাকাটা স্বাভাবিক। অছাত্ররা তাই চিরকুটে ভর্তি হয়ে ডাকসুর নেতাও বনে যাচ্ছেন। দুষ্ট রাজনীতির গ্রহণকালে তাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় চিন্তার জট লেগেছে, বিবেকের বৈকল্য দেখা দিয়েছে। তবু আমরা আশাবাদী। আমরা মনে করি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংকটের মূল কারণ কাঠামোগত। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার এত বছর পরেও আমরা এখনো কোনো দায়বদ্ধতার কাঠামো তৈরি করতে পারিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন বা শিক্ষকদের ‘জবাবদিহিতার’ কোনো কাঠামো এখানে নেই। ফলে সমাজ, রাষ্ট্র কিংবা জনগণের প্রতি দায়িত্ব পালনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ব্যর্থ হচ্ছে, যদিও বিশ্ববিদ্যালয় চলে জনগণের টাকায়। অনেক দেরি হয়ে গেছে, তবু এখনো যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি পর্যায়ে কার্যকর জবাবদিহিতার সংস্কৃতি গড়ে তোলা যায় তবেই বিশ্ববিদ্যালয় তার হৃতগৌরব ফিরে পাবে। একই যুক্তি বর্তায় ছাত্ররাজনীতির ক্ষেত্রেও। তাদেরও দায়িত্ব হবে নিজেদের বিবেকের আয়নায় চোখ রাখা। এরকম আদর্শহীন দেউলিয়া সর্বস্ব রাজনীতি তাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে সেটা ভাবা। যে রাজনীতির প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাবোধ নেই কী হবে সেই রাজনীতি করে? জাতীয় রাজনীতির নোংরামিতে আটকে না থেকে তাদেরও উচিত হবে বিবেকের সালতামামি করা। নতুন শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নতুন রাজনীতির জন্য নিজেদের প্রস্তুত করা। প্রাচীন, অচল, বাতিল, দুষ্ট আর ঘুণে ধরা রাজনীতি দিয়ে নতুন প্রজন্মকে যে আর আকৃষ্ট করা যাবে না তা বেশ স্পষ্ট। যে কারণে নতুন প্রজন্ম রাজনীতি বিমুখ হয়ে পড়েছে।

শেষে বলছি বিশ্ববিদ্যালয় যেভাবে চলছে সেভাবে আর চলতে পারে না, কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবন আর ফটকের দরজা হয়তো খোলা আছে বা খুলবে একদিন ঠিকই কিন্তু চিন্তা, নিয়ম-নীতি, জ্ঞানের অন্বেষণ, গবেষণা আর সৃজনশীল চর্চায় বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন যে স্থায়ী ধর্মঘট চলছে- সেই ধর্মঘট ভাঙা আজ সময়ের দাবি।

লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক।

[email protected]

সর্বশেষ খবর