বুধবার, ২৭ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

আজ হোলি আর্টিজানের রায়

সর্বোচ্চ সতর্ক আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, এখনো চাপা আতঙ্ক ‘ওরো’-তে

সাখাওয়াত কাওসার ও তুহিন হাওলাদার

আজ হোলি আর্টিজানের রায়

বহুল আলোচিত রাজধানীর গুলশানের হোলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলা মামলার রায় ঘোষণা হবে আজ। ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মজিবুর রহমান বেলা ১২টায় এ রায় ঘোষণা করবেন। এর আগে ১৭ নভেম্বর রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হলে রায় ঘোষণার জন্য ২৭ নভেম্বর দিন ধার্য করে আদালত। অন্যদিকে রায় ঘোষণা উপলক্ষে আদালতপাড়াসহ রাজধানীতে বিশেষ নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গতকাল বিকাল থেকেই রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা এবং এলাকাগুলোতে মোতায়েন করা হয়েছে আইন প্রয়োগকারী ও বিভিন্ন সংস্থার সদস্য। এ ছাড়া এখনো অজানা আতঙ্ক বিরাজ করছে নতুন নাম নেওয়া রেস্তোরাঁ ‘ওরো’-তে।

র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘আগামীকাল রায় ঘোষণা হবে। এটা আমাদের জন্য মাইলফলক। ন্যক্কারজনক ওই ঘটনায় যেসব নিরীহ মানুষ বিনা কারণে নিহত হয়েছেন, আমি আবারও তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। একই সঙ্গে তাদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি। হোলি আর্টিজান হামলার পর আমরা এখন পর্যন্ত ৮০৯ জন জঙ্গিকে গ্রেফতার করেছি। এমন কোনো সপ্তাহ নেই, যে সপ্তাহে জঙ্গি গ্রেফতার হয়নি। কোথাও না কোথাও র‌্যাব অভিযান চালিয়েছে। ২০১৬ থেকে এ পর্যন্ত ২৫ জন গোলাগুলিতে নিহত হয়েছে। বহুমুখী তৎপরতার কারণে আটজন জঙ্গি আত্মসমর্পণ করেছে। জঙ্গিদের অনেক পরিকল্পনা আমরা নস্যাৎ করে দিয়েছি।’

সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, গতকাল বিকাল থেকেই আদালত-সংলগ্ন বিভিন্ন সুউচ্চ ভবনে অবস্থান নিয়েছে সশস্ত্র পুলিশ। একই অবস্থা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা এলাকায়। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার সড়কে আগের চেয়ে বাড়ানো হয়েছে চেকপোস্টের সংখ্যা। সন্দেহজনক যানবাহনগুলোতে তল্লাশি করা হচ্ছে। এ ছাড়া আজ সকাল থেকেই বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন আদালত চত্বরে থাকবেন। আদালত এলাকায় সাধারণ মানুষের চলাচলও সীমিত করা হবে। প্রয়োজনে সন্দেহভাজনদের তল্লাশি করা হবে। পোশাকে ও সাদা পোশাকে আদালত চত্বরসহ বিভিন্ন জনসমাগমপূর্ণ এলাকায় থাকবেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা।

ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার মো. মনির হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আদালতপাড়া ঘিরে বিশেষ নিরাপত্তাব্যবস্থা সাজানো হয়েছে। তবে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) প্রতিটি ডিভিশনকে এ-সংক্রান্তে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সে মোতাবেক নিরাপত্তাব্যবস্থা ঢেলে সাজানো হয়েছে। প্রতিটি ডিভিশন আলাদাভাবে নিরাপত্তাব্যবস্থা নিলেও ডিএমপি সদর দফতর থেকে কেন্দ্রীয়ভাবে তা মনিটরিং করা হচ্ছে।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো কোনো নেতিবাচক তথ্য নেই। তবে রাজধানীবাসীর নিরাপত্তায় আমরা সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিয়েই মাঠে থাকব। আর দশজন নাগরিকের মতো আমারও প্রত্যাশা, দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি হোক।’ রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি গোলাম সারওয়ার খান জাকির বলেন, রায় ঘোষণার আগে কারাগার থেকে এ মামলার আট আসামিকে আদালতে হাজির করা হবে। আট আসামি হলেন- জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী, রাকিবুল হাসান রিগান, আসলাম হোসেন ওরফে রাশেদুল ইসলাম ওরফে র‌্যাশ, সোহেল মাহফুজ, মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান, হাদিসুর রহমান সাগর, শরিফুল ইসলাম ও মামুনুর রশিদ। এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে ২১১ জন সাক্ষীর মধ্যে ১১৩ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। সন্ত্রাসবিরোধী আইনের এ মামলায় আট আসামির সর্বোচ্চ শাস্তির আবেদন করা হয়েছে। এর আগে ২০১৮ সালে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) পরিদর্শক হুমায়ুন কবির ২৩ জুলাই হামলায় জড়িত ২১ জনকে চিহ্নিত করে তাদের মধ্যে জীবিত আটজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। পরে ওই বছরের ২৬ নভেম্বর আট আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন বিচারক। মামলা সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে রাজধানীর গুলশানের হোলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলা চালায় জঙ্গিরা। তারা অস্ত্রের মুখে দেশি-বিদেশি মানুষদের জিম্মি করে। ওই রাতে অভিযান চালাতে গিয়ে পুলিশের দুই কর্মকর্তা নিহত হন। পরদিন সকালে সেনা কমান্ডোদের অভিযানে পাঁচ জঙ্গিসহ ছয়জন নিহত হয়। পরে পুলিশ ১৮ বিদেশিসহ ২০ জনের মরদেহ উদ্ধার করে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান একজন রেস্তোরাঁকর্মী। অভিযোগপত্রে বলা হয়, হোলি আর্টিজানে হামলার আগে জঙ্গিরা বাংলাদেশে বড় ধরনের হামলার পরিকল্পনা করে। এর অংশ হিসেবে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে গাইবান্ধার বোনারপাড়া বাজার এলাকার কলেজ মোড়ে একটি বাসায় মিটিং করে প্রথমে তারা হোলি আর্টিজানে হামলার পরিকল্পনা করে। হোলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় কূটনৈতিক এলাকায় অবস্থিত থাকায় সেখানে হামলা করার পেছনে কারণ ছিল জঙ্গিদের নিজেদের সামর্থ্যরে জানান দেওয়া। এ ছাড়া বিদেশি নাগরিকদের হত্যা করে নৃশংসতার প্রকাশ ঘটানোর পাশাপাশি তারা এর মাধ্যমে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে প্রচার করে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করতে চেয়েছিল। এ ছাড়া নব্য জেএমবির জঙ্গিরা ছয় মাস ধরে পরিকল্পনা করে ওই হামলা চালিয়েছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল দেশকে ‘অস্থিতিশীল করা’ এবং বাংলাদেশকে একটি ‘জঙ্গিরাষ্ট্র’ বানানো। এই হামলার সঙ্গে জড়িত ২১ জনকে শনাক্ত করা হয়। এর মধ্যে ১৩ জন জঙ্গি পুলিশের বিভিন্ন জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নিহত হয়। বাকি আটজনকে এ মামলায় আসামি করা হয়েছে।

এখনো চাপা আতঙ্ক ‘ওরো’-তে : নারকীয় এ হামলার পর ‘ওরো’ নামে চালু হয়েছে হোলি আর্টিজান রেস্তোরাঁ। হয়েছে ঠিকানারও বদল। আগের গুলশান-২-এর ৭৯ নম্বর সড়কের ৫ নম্বর বাড়ির বদলে এখন ১৫৩/১ র‌্যাংগস আর্কেডিয়ায় এর ঠিকানা। আগের অনেক কর্মী এখনো কাজ করেন ‘ওরো’-তে। রবিবার নতুন ঠিকানায় গিয়ে সরেজমিনে দেখা যায়, কসমেটিকসহ বিভিন্ন পণ্যের মার্কেটের সিঁড়ি বেয়ে দ্বিতীয় তলায় উঠতেই হাতের ডান পাশের একটি অংশে ‘ওরো’ বেকারি। তবে পণ্যের গায়ে এখনো ‘হোলি’ লেখা। কিন্তু আগের তুলনায় কমে গেছে বেকারি আইটেম। নতুন আইটেমের পসরা সাজিয়ে চালানো হচ্ছে বেকারিটি। নজিরবিহীন জঙ্গি হামলায় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের শিরোনাম হওয়া হোলি আর্টিজান বেকারি দীর্ঘ ছয় মাস বন্ধ ছিল। সেখানে কথা বলে জানা গেল, আগেকার রেস্তোরাঁয় ২ হাজার বর্গফুটের জায়গা ছিল। একসঙ্গে সেখানে বসতে পারতেন ৫০ জন অতিথি। তবে ৫০০ বর্গফুটের নতুন ঠিকানায় এখন ২০ জন অতিথির একসঙ্গে বসার ব্যবস্থা রয়েছে। ওরো-তে কাজ করছেন হোলি আর্টিজানে কাজ করা পাঁচজন। নতুন জায়গায় শুধু বেকারি পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে। এখনো রেস্তোরাঁ করা হয়নি। বেকারিটির নতুন ঠিকানায়ও দেখা গেল দেশি ক্রেতার চেয়ে বিদেশি ক্রেতাই বেশি।

বেকারিতে আসা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক দেশি অতিথি বলেন, ‘একটা মর্মান্তিক ঘটনার পর তারা (মালিক) আরও শক্তি পেয়েছেন। তারা এ ধরনের চমৎকার ক্যাফে আবার চালু করেছেন।’ বেকারির কর্মচারী রকি বলেন, দেশি-বিদেশি কাস্টমার আসছেন। বিদেশি অতিথিদের মধ্যে অনেক পরিচিত মুখ দেখা যাচ্ছে। এখন স্বল্প পরিসরে একরকম চলছে। তবে এখনো তাদের মধ্যে কাজ করে চাপা আতঙ্ক। গুলশানের ৭৯ নম্বর সড়কের শেষ মাথায় আগের সেই হোলি আর্টিজান ক্যাফের ভবনে ঢোকার চেষ্টা করতেই বাধা এলো ভিতর থেকে। আক্তার নামে এক নিরাপত্তাকর্মী বললেন, ‘এখন এটি আর হোলি আর্টিজান রেস্তোরাঁ নয়। এই নামটি আমরা শুনলে এখনো আঁতকে উঠি। এখন এটি আবাসিক ভবন। এখানে স্যারের (মালিক) পরিবার থাকে।’ কিছু সময়ের মধ্যে সেখানে উপস্থিত হন মামলার অন্যতম সাক্ষী ও হামলা থেকে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া সঞ্জয় বড়ুয়া। সঞ্জয়সহ অন্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, হোলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার কারণে তাদের জীবন থেকে অনেক কিছু হারিয়ে গেছে।

বিদেশি প্রতিষ্ঠানে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গেলে যখন কেউ জানতে পারেন তারা হলি আর্টিজানে কাজ করতেন, তখন আর তাদের চাকরি হয় না। অথচ এ ঘটনার জন্য দায়ী দেশের কিছু কুলাঙ্গার, যারা জঙ্গি হিসেবে পরিচিত।

২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে গুলশান-২-এর ৭৯ নম্বর সড়কের ৫ নম্বর বাড়িটিতে হলি আর্টিজান বেকারি এবং ও চিকেন রেস্তোরাঁয় জঙ্গিরা হামলা চালায়। প্রতিরোধ গড়তে গিয়ে জঙ্গিদের গুলি ও বোমায় মারা যান দুই পুলিশ কর্মকর্তা। জঙ্গিরা রেস্তোরাঁর ভিতর নিষ্ঠুর কায়দায় ১৭ বিদেশিসহ ২০ জনকে হত্যা করে। এর মধ্যে জঙ্গিদের গ্রেনেড হামলায় নিহত হন পুলিশের দুই কর্মকর্তা। পরে সকালে সেনা কমান্ডোদের অভিযানে হামলাকারী পাঁচ জঙ্গিসহ ছয়জন নিহত হয়। জঙ্গি হামলা ও কমান্ডো অভিযানের কারণে বেকারির সীমানা-দেয়াল ও ভবনের বেশির ভাগ অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভিতরে থাকা মালামালও নষ্ট হয়। ওই হামলায় প্রায় বিধ্বস্ত হয় হলি আর্টিজান।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর