শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

এমপি লিটন হত্যায় সাবেক এমপি কাদের খানসহ সাতজনের ফাঁসি

গাইবান্ধা প্রতিনিধি

এমপি লিটন হত্যায় সাবেক এমপি কাদের খানসহ সাতজনের ফাঁসি

এমপি লিটন (বাঁয়ে)। আদালত প্রাঙ্গণে গতকাল সাবেক এমপি কাদের খান -বাংলাদেশ প্রতিদিন

গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন হত্যা মামলার রায়ে একই আসনের জাতীয় পার্টির সাবেক এমপি অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল ডা. আবদুল কাদের খানসহ সাতজনের ফাঁসির আদেশ দিয়েছে আদালত। গাইবান্ধা জেলা ও দায়রা জজ দিলীপ কুমার ভৌমিক গতকাল বেলা ১১টা ৪৫ মিনিটে জনাকীর্ণ আদালতে বহুল আলোচিত ও চাঞ্চল্যকর এ মামলার রায় ঘোষণা করেন।

২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় সুন্দরগঞ্জ উপজেলার সর্বানন্দ ইউনিয়নের শাহবাজ গ্রামের মাস্টারপাড়ার নিজ বাড়িতে এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। দন্ডপ্রাপ্ত অন্যরা হলেন কাদের খানের একান্ত সহকারী মো. শামছুজ্জোহা, তার গাড়িচালক আবদুল হান্নান, মেহেদি হাসান, শাহীন মিয়া, চন্দন কুমার রায় ও আনোয়ারুল ইসলাম রানা। রায় পাঠের সময় চন্দন কুমার রায় ছাড়া সবাই কাঠগড়ায় ছিলেন। চন্দন ভারতে পলাতক রয়েছেন। মামলার অপর আসামি কসাই সুবল চন্দ্র রায় ইতিপূর্বে কারাগারে অসুস্থ হয়ে মারা যান। তবে আসামি চন্দনকে দ্রুত গ্রেফতার করে দেশে আনার প্রক্রিয়া চলছে বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা। এ ছাড়া এ সময় মামলার সাক্ষী ও নিহতের স্বজনরাও আদালতে উপস্থিত ছিলেন।

সাজাপ্রাপ্ত শাহীন মিয়া (২৫) সুন্দরগঞ্জ উপজেলার উত্তর সমস কবিরাজটারী গ্রামের ওসমান গনি ভুট্টুর ছেলে। মেহেদী হাসান (২৬) একই গ্রামের আবদুল করিমের ছেলে। গাড়িচালক আবদুল হান্নান (৩০) বগুড়ার শাহজাহানপুর উপজেলার কামারপাড়ার আবদুর রহমান প্রামাণিকের ছেলে। আনোয়ারুল ইসলাম ওরফে রানা (২৯) সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ভেলারায় কাজীরভিটা গ্রামের তমশের আলীর ছেলে।

বিচারক রায়ে মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আসামিদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার আদেশ দেন। এর আগে বেলা ১১টা ২০ মিনিটে গাইবান্ধা জেলা কারাগার থেকে কঠোর নিরাপত্তায় হত্যা ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী ও অর্থের জোগানদাতা হিসেবে অভিযুক্ত জাতীয় পার্টির সাবেক এমপি ডা. আবদুল কাদের খান এবং অভিযুক্ত অন্য পাঁচ আসামিকে আদালতে হাজির করে পুলিশ। পরে রায় ঘোষণা শেষে দুপুর ১২টার দিকে আবার তাদের কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে আদালত থেকে জেলা কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। লিটন হত্যাকান্ডের পর ক্লু উদ্ধারে মাঠে নামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কিন্তু ঘটনার আড়াই মাসেও কোনো কূলকিনারা পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে হত্যায় ব্যবহৃত একটি পিস্তলের ফেলে যাওয়া গুলির সূত্র ধরেই হত্যারহস্য উন্মোচিত হয়। এরপর ২০১৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বগুড়ার বাসা থেকে হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী সন্দেহে আবদুল কাদের খানকে গ্রেফতার করে পুলিশ। কাদের খানের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে হত্যায় অংশ নেওয়া কিলারদের শনাক্ত ও গ্রেফতার করা হয়।

রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে ওই আদালতের পিপি শফিকুল ইসলাম বলেন, এর আগে তদন্ত শেষে এই হত্যা মামলায় কাদের খানসহ আটজনের বিরুদ্ধে ২০১৭ সালের ৩০ এপ্রিল আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। ২০১৮ সালের ৮ এপ্রিল থেকে এ পর্যন্ত বাদী, নিহতের স্ত্রী ও তদন্ত কর্মকর্তাসহ ৫৯ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করে আদালত। ২২ কার্যদিবস চলার পর ৩১ অক্টোবর মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ কার্যক্রম শেষ হয়। এ ছাড়া ২০১৮ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। পরে পর্যায়ক্রমে কারাগারে থাকা আসামিদের আত্মপক্ষ সমর্থন শুনানি হয়। এ ছাড়া রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের আইনজীবীদের দীর্ঘ ১৮ মাস যুক্তিতর্ক শেষ হয় ১৯ নভেম্বর। তিনি বলেন, এই হত্যাকা- যে পরিকল্পিত ছিল তা মামলার সাক্ষ্যপ্রমাণ, আসামিদের স্বীকারোক্তি ও যুক্তিতর্কে প্রমাণিত হয়েছে।

পিপি বলেন, প্রধান আসামি আবদুল কাদের খানকে একই ঘটনায় অস্ত্র মামলার রায়ে ১১ জুন যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেন এই আদালতের বিচারক। এ ছাড়া তখন অস্ত্র মামলায় পৃথক এক ধারায় তাকে ১৫ বছর কারাদন্ড দেওয়া হয়। লিটন হত্যায় ব্যবহৃত তিনটি অস্ত্রের মধ্যে একটি কাদের খান নিজে সুন্দরগঞ্জ থানায় জমা দেন। একটি অস্ত্র ছয় রাউন্ড গুলিসহ কাদের খানের স্বীকারোক্তি মোতাবেক তার নিজ বাড়ির উঠান থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। তবে অপর অস্ত্রটির সন্ধান এখনো পাওয়া যায়নি।

আসামি আবদুল কাদের খানের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মঞ্জুর মোর্শেদ বাবু এই মামলার রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, ন্যায়বিচারের আশা করা হয়েছিল। কিন্তু এই রায়ে তারা ন্যায়বিচার পাননি। তাই এই রায়ের বিরুদ্ধে তারা উচ্চ আদালতে যাবেন।

এই মামলার রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে মামলার বাদী লিটনের বড় বোন ফাহমিদা কাকলী বুলবুল ও স্ত্রী খুরশিদ জাহান স্মৃতি দ্রুত রায় কার্যকর করার দাবি জানান। গাইবান্ধা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, ‘আমরা রায়ে দলীয়ভাবে সন্তুষ্ট। আমরা ন্যায়বিচার পেয়েছি। এখন রায় কার্যকর হলে সবাই স্বস্তি পাবে।’ রায় ঘোষণার পরপরই আদালতে প্রাঙ্গণে আওয়ামী লীগ কর্মীরা আনন্দ মিছিল বের করেন।

প্রসঙ্গত, দুর্বৃত্তদের গুলিতে গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় সুন্দরগঞ্জ উপজেলার সর্বানন্দ ইউনিয়নের সাহাবাজ গ্রামের নিজ বাড়িতে অজ্ঞাত দুর্বৃত্তদের দ্বারা গুলিবিদ্ধ হন। তাকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওই দিন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে তিনি মারা যান।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর