শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

উইঘুর মুসলিম নিপীড়নের প্রশ্নে অদ্ভুত নীরবতা পাকিস্তানের

প্রতিদিন ডেস্ক

উইঘুর মুসলিম নিপীড়নের প্রশ্নে অদ্ভুত নীরবতা পাকিস্তানের

উইঘুর মুসলিমদের ওপর চীনা কর্তৃপক্ষের নির্মম অত্যাচার প্রশ্নে পাকিস্তানের নীরবতাকে ‘অদ্ভুত’ বলে অভিহিত করেছে মানবাধিকার রক্ষায় আন্দোলনরত আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠন। কূটনৈতিক অঙ্গন ও বিশ্ব মিডিয়াও এতে বিস্ময় প্রকাশ করে।

উইঘুর মুসলিম সম্প্রদায়ের আবাসস্থল হচ্ছে জিনজিয়াং প্রদেশ। এই এলাকাটি চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত। সমালোচকরা বলছেন, কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা প্রত্যাহার করার পর ‘ওখানে মুসলিমদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার গেল গেল’ বলে পাকিস্তান যেভাবে অনর্থক শোরগোল করেছিল, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ‘ভারতের বিজেপি সরকার কাশ্মীরে জঘন্য কাজ করেছে’ বলে অভিযোগ তুলেছিলেন, সেই তিনিই উইঘুর মুসলিমদের ওপর অত্যাচার-নিপীড়ন দেখতে পাচ্ছেন না!

জিনজিয়াং প্রদেশে সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর নির্মম অত্যাচার ইসলাম ধর্মকে একটা হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। প্রদেশটির কাশগড় ও উরুমকি শহরের মসজিদগুলো জনশূন্য হয়ে পড়েছে। সেখানে ইসলাম প্রচারের কাজে আজকাল আর কাউকে দেখা যায় না। পুরো এলাকা একটা জেলখানায় পরিণত। মুসলিমদের আল্লাহ ছেড়ে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ভজন-পূজন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মোনাজাত, ইসলাম শিক্ষা ও রোজা পালনের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এমনকি চীনের অন্যান্য প্রদেশেও আরবিতে কোনো লেখা প্রচার ও প্রকাশ করার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। এটা হলো জনমনে ইসলাম সম্পর্কে এক ধরনের ভীতি সৃষ্টির পুরো আয়োজন। ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজি) সম্প্রতি ফাঁস হওয়া একটি দলিল হাতে পায়। এতে দেখা যায়, চীনা কর্তৃপক্ষ সন্ত্রাসবিরোধী ‘শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’ চালানোর নামে সংখ্যালঘু উইঘুর জনগোষ্ঠীকে কমিউনিস্ট পার্টির দীক্ষায় দীক্ষিত করার প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে। যারা এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে দিন অতিবাহিত করেছেন তাদের কেউ কেউ বর্ণনা দিয়েছেন তাদের ওপর চৈনিক অত্যাচারের। প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ অনুযায়ী কিছু উইঘুর এ অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু মুসলিম উইঘুরদের অমানবিক পরিস্থিতিতে মুসলিম বিশ্বের কোনো নেতাকে কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে দেখা যায়নি। যে মুসলিম বিশ্ব ফিলিস্তিনিদের ওপর অত্যাচারের নিন্দা-প্রতিবাদ করেছে, রোহিঙ্গা মুসলিম নিধনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে, তারা কিন্তু উইঘুরদের ওপর অকথ্য অত্যাচার দেখেও মুখ খুলছে না। কোনো রাষ্ট্রপ্রধানকেও এ ব্যাপারে কোনো উচ্চবাচ্য করতে আজ পর্যন্ত শোনা যায়নি। তার কারণ, চীনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দাপটের প্রভাব।

উইঘুর অধ্যুষিত জিনজিয়াং প্রদেশের সীমান্তবর্তী প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাকিস্তান এখন পর্যন্ত উইঘুর অত্যাচার প্রশ্নে নিশ্চুপ। অভিজ্ঞ মহল বলেছে, এ নীরবতা হচ্ছে প্রভাবশালী চীনের সামনে দুর্বলতার পরিচায়ক। তাদের মতে, পাকিস্তানের মধ্য দিয়ে যাওয়া চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড ইনিশিয়েটিভ’ প্রকল্পে বেইজিং বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করেছে। চীনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালে তা পাকিস্তানের জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে। উপরন্তু চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (সিপিইসি) প্রকল্পে ৬২০ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগও বিঘিœত হতে পারে।

গেল সেপ্টেম্বরে মার্কিন রাষ্ট্রপতি ট্রাম্পের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান দেখা করেন। এর কিছুদিনের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের সমালোচনা করে এবং জম্মু-কাশ্মীরে তথাকথিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে পাকিস্তানের প্রচারের বিরোধিতা করে। যুক্তরাষ্ট্র চীনের মুসলিমদের দুরবস্থার প্রতিকারে পাকিস্তানকে আরও মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দেয়। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের ভারপ্রাপ্ত সহকারী সচিব (দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া) এলিস ওয়েলস পাকিস্তানকে কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বাতিলের ইস্যুতে উত্তেজনা ছড়ানো থেকে বিরত থাকতে বলেন। তিনি আরও বলেন, কাশ্মীরের ব্যাপারে পাকিস্তানের যে উদ্বেগ, তার সমপরিমাণ উদ্বেগ তিনি পাকিস্তান থেকে আশা করেন উইঘুর মুসলিমদের ব্যাপারে, যারা চীনে ‘কনসেনট্রেশন চেম্বারে’ বসবাসের মতো অবস্থায় দিনাতিপাত করছেন। জেনেভাভিত্তিক ‘ওয়ার্ল্ড উইঘুর কংগ্রেস’ গত সেপ্টেম্বরে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের কঠোর সমালোচনা করে বলেছে, এটি অত্যন্ত লজ্জাজনক যে, উইঘুরদের ওপর চীনা অত্যাচার প্রসঙ্গে ইসলামাবাদ নীরবতা পালন করে চলেছে এবং বেইজিংকে এ ব্যাপারে সমর্থন করছে। উইঘুর নেতারা বলেন, ইমরান খান একদিকে উইঘুর প্রসঙ্গে চোখ বন্ধ করে আছেন, অন্যদিকে কাশ্মীর ইস্যুতে সব সময় উচ্চকণ্ঠ। এটা তার দ্বিচারিতার পরিচয় বহন করছে। আগস্টে আলজাজিরাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ইমরান খান নিজস্ব মত অনুযায়ী কাশ্মীরের মানুষের দুর্দশার বর্ণনা দেন এবং বিজেপি সরকার যে কত বর্ণবাদী ও ফ্যাসিস্ট তারও সুদীর্ঘ বর্ণনা দেন; অথচ আশ্চর্যজনকভাবে উইঘুর মুসলিমদের ব্যাপারে তার অজ্ঞতা প্রকাশ করেন। এ বছরের শুরুতে পাকিস্তানের অনেক সাংবাদিক এবং বিশিষ্টজন রোজা পালনের ওপর চীনা নিষেধাজ্ঞার নীতির সমালোচনা করেন। তখন ইসলামাবাদে চীনা দূতাবাসের ডেপুটি চিফ লিজিয়ান ফাও বাধ্য হন তার দেশের হয়ে সাফাই দিতে। তিনি বলেন, এ নিষেধাজ্ঞা কেবল চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য, ছাত্র ও সরকারি কর্মচারীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কিন্তু অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, এ নিষেধাজ্ঞা জিনজিয়াং প্রদেশে বসবাসরত মুসলিমদের জন্য প্রযোজ্য। বিগত মাসগুলোয় পাকিস্তানের জনগণের কাছে চীনের ইমেজ মলিন হয়েছে। তাদের মধ্যে ক্রোধের সঞ্চার হয়েছে কারণ তারা জানতে পেরেছে যে, অল্পবয়সী পাকিস্তানি মেয়েদের চীনে বিয়ের নামে নিয়ে যৌন ব্যবসায় নিয়োজিত করা হয় এবং সেখানে মানব-অঙ্গের ব্যবসাও ঢালাওভাবে চালানো হয়। চীন অবশ্য এসব অভিযোগ অস্বীকার করে। উইঘুর মুসলিমদের ওপর অত্যাচার, নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদির দ্বারা পাকিস্তানি জনগণের মধ্যে যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে তা পুঞ্জীভূত হয়ে ভবিষ্যতে ক্রোধের আকার ধারণ করে পাকিস্তান সরকারকে চীনের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করে কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর