রবিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

টাকা কামানো একটি রোগ, অবৈধ অর্থে সুখ আসবে না : প্রধানমন্ত্রী

নিজস্ব প্রতিবেদক

টাকা কামানো একটি রোগ, অবৈধ অর্থে সুখ আসবে না : প্রধানমন্ত্রী

আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নীতি ও আদর্শ নিয়ে সৎভাবে জীবনযাপন ও মানুষের কল্যাণে কাজ করতে দলীয় নেতা-কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, টাকা কামানো একটা রোগ, অসুস্থতা। যতই টাকা কামাও সুখ আসবে না। এ রোগে একবার আক্রান্ত হলে শুধু বানাতেই ইচ্ছা করে। অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন করে বিরিয়ানি-পোলাও খাওয়া আর ব্র্যান্ডের জিনিস পরার চেয়ে সাদাসিধে জীবনযাপন করা অনেক সম্মানের। অন্তত, ‘এটা অবৈধ, চোরা টাকা’ এই কথাটা সারাক্ষণ মনে আসবে না। শান্তিতে ঘুমানোও যাবে। গতকাল দুপুরে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। বেলা ১১টার দিকে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, কবুতর ও বেলুন উড়িয়ে সম্মেলনের উদ্বোধন করেন শেখ হাসিনা।

আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, চুরির টাকা দিয়ে ভোগ-বিলাসে জীবন কাটানো সরকার সহ্য করবে না। কেউ অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন করে ভোগ-বিলাসী জীবনযাপন করবেন, আর কেউ সৎভাবে, সাদাসিধে জীবনযাপন করতে গিয়ে তার জীবনটাকে নিয়ে কষ্ট পাবেন, এটা হতে পারে না। তিনি বলেন, আসলে এই টাকা বানানোটা একটা রোগ। এটাও একটা অসুস্থতা। একবার টাকা বানাতে থাকলে তার শুধু বানাতেই ইচ্ছা করে। ‘এই ধরনের একটা সামাজিক অবস্থা আমরা চাই না’ উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা চাই সৎ পথে কামাই করে সম্মানের সঙ্গে চলবে। আর চোরা টাকা, দুর্নীতির টাকা, অবৈধ পথে অর্জিত টাকার বিলাসিতাকারীকে নিয়ে মানুষ মুখে যা-ই বলুক, পেছনে একটা গালি দেয়। এই গালিটা শোনা না গেলেও গালিটা কিন্তু খেতে হয় সে কথাটা মনে রাখতে হবে। টাকা কামানোর পেছনে ছুটলে ছেলে-মেয়ে বিপথে যাবে, ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা নষ্ট হবে, মাদকাসক্ত হবে, তা দেখারও সময় নেই। টাকার পেছনে ছুটছে তো ছুটছেই আর নিজের পরিবার ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে। এই ধরনের সামাজিক অবস্থা আমরা চাই না। আমরা চাই, সৎ পথে কামাই করে চলবে, সম্মানের সঙ্গে চলবে। সৎ পথে কামাই করে যে থাকবে, সে সমাজে সম্মান পাবে।’ ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি হাজী আবুল হাসনাতের সভাপতিত্বে স্বাগত বক্তব্য রাখেন ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি এ কে এম রহমতুল্লাহ, উত্তরের সাধারণ সম্পাদক সাদেক খান, দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ। এর আগে প্রধান অতিথি মঞ্চে আসন গ্রহণ করেন। শেখ হাসিনাকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান মহানগর আওয়ামী লীগের নেতারা। আলোচনার শুরুতে সাধারণ সম্পাদকের সাংগঠনিক রিপোর্ট পেশ করা হয়। মহানগর নেতা সালাহউদ্দিন বাদল মতিন ভূঁইয়ার পরিচালনায় সংক্ষিপ্ত সাংস্কৃতিক পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। ধর্মীয় গ্রন্থপাঠের মধ্য দিয়ে বক্তৃতা পর্ব শুরু হয়। শোক প্রস্তাব পাঠ করেন উত্তর ও দক্ষিণের দফতর সম্পাদক এম সাইফুল্লাহ সাইফুল এবং গোলাম রাব্বানী বাবলু। যৌথভাবে সভা পরিচালনা করেন ঢাকা মহানগর উত্তরের প্রচার সম্পাদক মিজানুর রহমান ও উপপ্রচার সম্পাদক আজিজুল হক রানা। এদিকে সম্মেলন উপলক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিশাল সম্মেলন মঞ্চ ও প্যান্ডেল নির্মাণ ছাড়াও সম্মেলনস্থল ও আশপাশের সড়কগুলোকে বর্ণাঢ্য সাজে সাজিয়ে তোলা হয়। এতে আওয়ামী লীগের ইতিহাস-ঐতিহ্যের পাশাপাশি বর্তমান সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকা- তুলে ধরা হয়। দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আর কখনো কোনো হায়েনার দল বাংলাদেশের মানুষের বুকে চেপে বসতে পারবে না। রক্ত চুষে খেতে পারবে না। যারা মানুষকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মেরেছে তারা আর কখনো এই দেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে পারবে না। তিনি বলেন, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। কোনো দুর্নীতিবাজ সন্ত্রাসী, আগুন দিয়ে যারা পুড়িয়ে মানুষ হত্যা করেছে তারা আর কখনো এ দেশের জনগণের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে পারবে না। জাতীয় পার্টি ও বিএনপির সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই দলগুলো সৃষ্টি হয়েছে অবৈধভাবে, ষড়যন্ত্র করে। ক্ষমতা দখলের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় বসে থেকে ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট বিলিয়ে এই দলগুলো গঠন করা হয়েছে। এই দলগুলো মাটি থেকে গড়ে ওঠেনি। কোনো বিরোধী দলে থেকেও গড়ে ওঠেনি। এ দলগুলো মানুষের কথা চিন্তা করে গড়ে ওঠেনি। মানুষের জন্য কাজ করা, মানুষের উপকার করা, এগুলো তারা বোঝে না। শেখ হাসিনা বলেন, মানুষের জন্য কতটুকু করতে পারলাম সেই চিন্তা করতে হবে। জনগণকে কী দিতে পারলাম সেই চিন্তা করতে হবে। জনগণের কল্যাণ কীসে হবে সেই চিন্তা করতে হবে। জনগণের অর্থ ভোগ-বিলাসে ব্যয় হবে না। জনগণের অর্থ জনগণের জন্য ব্যয় হবে। আজ আমরা সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রেখেছি, এটা অব্যাহত থাকবে। নির্বাচন নিয়ে বিএনপির তোলা প্রশ্নের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আজকে বিএনপি নেতারা নির্বাচন নিয়ে কথা বলেন, নির্বাচনে জনগণের অংশগ্রহণ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তাদের আমি জিয়াউর রহমানের হ্যাঁ-না ভোট ও ১৯৮১ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের কথা মনে করিয়ে দিতে চাই। কেমন নির্বাচন তারা করেছিল। সেখানে জনগণ স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারেনি। তাদের কথাই ছিল ১০টা হুন্ডা ২০টা গুন্ডা নির্বাচন ঠা া। তারই পদাঙ্ক অনুসরণ করেছিলেন জেনারেল এরশাদও। প্রধানমন্ত্রী বলেন, জিয়াউর রহমান যেমন স্বাধীনতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রী করেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী করেছিলেন, খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসেও সেই একই কা- ঘটালেন। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়া একটা নির্বাচন করেছিল। যে নির্বাচনে বাংলাদেশের কোনো দল অংশ নেয়নি। সেটা একটা সাজানো নির্বাচন ছিল।

 সারা দেশে সেনাবাহিনী মোতায়েন করে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনের সহযোগিতায় একটি নির্বাচন করল। যেখানে বোধ হয় দুই শতাংশ ভোটও পড়েনি। জনগণের ভোট চুরি করে নির্বাচন করে নিজেকে তৃতীয়বারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা দিল। তিনি বলেন, ভোট চুরি করে খুনি রশীদকে নির্বাচিত করল। কর্নেল রশীদ ও মেজর হুদাকে নির্বাচিত করে পার্লামেন্টে বসাল। খুনি রশীদকে খালেদা জিয়া পার্লামেন্টে বিরোধীদলীয় নেতার সিটে বসিয়ে দিল। কিন্তু খালেদা জিয়া সেই ক্ষমতায় বেশি দিন থাকতে পারেননি। ভোট চুরির কারণে মাত্র দেড় মাস ক্ষমতায় ছিলেন। ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন হয়ে, ৩০ মার্চ তাকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। শেখ হাসিনা বলেন, পঁচাত্তরের হত্যাকান্ডের বিচার রুখে দিতে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছিল। খুনিদের পুরস্কৃত করা হয়েছিল। তাদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। এরশাদও জিয়ার পথ অবলম্বন করে ক্ষমতা দখল করলেন। তার থেকেও একধাপ এগিয়ে খালেদা জিয়া। তিনি ’৯৬ সালে সাজানো নির্বাচন করলেন। ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে খুনি ও যুদ্ধাপরাধীদের এমপি-মন্ত্রী করলেন। যারা এভাবে খুনিদের মদদ দিতে পারে, তারা গণতন্ত্রের কথা কীভাবে বলে! আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তারা (বিএনপি-জামায়াত) ক্ষমতায় এসে দুর্নীতি, নির্যাতন করেছে। আওয়ামী লীগ নেতাদের ঘর ছাড়তে হয়েছে। আমরা গোপালগঞ্জে সে সময় অনেক নেতা-কর্মীকে আশ্রয় দিয়েছি। ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল তারা। আমাদের নেতা-কর্মীদের হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়েছে, হাত কেটে নিয়েছে, চোখ তুলে নিয়েছে। নেতা-কর্মীদের ভিটেবাড়িতে পুকুর কেটে কলাগাছ লাগিয়েছিল। হাজার হাজার মেয়েকে রেপ করা হয়েছে। খালেদা জিয়ার নির্দেশেই এগুলো করা হয়েছিল।’ তিনি বলেন, ‘বিএনপি-জামায়াতের কাজ ছিল আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করা। বাংলাদেশ যেন কখনো এগিয়ে যেতে না পারে এটাই ছিল তাদের লক্ষ্য। তাদের আমলে ঢাকা শহরে বিদ্যুৎ ও পানির হাহাকার দেখা দেয়। আজকে ঢাকা শহরের পানির চাহিদা আমরা পূরণ করছি। আমরা আরও পানি শোধনাগার করছি। এখন ঢাকা শহরে কেউ এলে দেখবে উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। শহরের চেহারা পাল্টে যাচ্ছে।’ এ সময় জাতির পিতার কন্যা নগরবাসীকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘পানি ও বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হতে হবে। আপনাদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। কলা খেয়ে রাস্তায় খোসা ছুড়ে ফেলা যাবে না। বাস থেকে খাবার খেয়ে বাইরে ফেলা যাবে না। প্রয়োজনে বাসে ডাস্টবিন রাখতে হবে। নিজেদের শহরকে নিজেদেরই পরিষ্কার রাখতে হবে। বিনোদনের জন্য শহরে খেলার মাঠ রাখতে আমরা কাজ করছি। মেয়েদের জন্য আলাদা বাসের ব্যবস্থা করেছি।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জাতির পিতা কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষের কথা বলেছেন। তাদের ভাগ্য কতটুকু গড়তে পারি, তাদের কতটুকু সুন্দর জীবন দিতে পারি, কীভাবে মানুষের ভাগ্য সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে পারি। প্রত্যেকটা মানুষ যেন সুন্দরভাবে বাঁচতে পারে, সেটিই আমাদের লক্ষ্য।’ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আর সেই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করেছি বলেই আজকের বাংলাদেশ। আজকের বাংলাদেশ বিশ্বে সম্মান পাচ্ছে। আজকের বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। আমরা যদি ওরকম বিলাস-বসনে গা ভাসাতাম, এই বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হতো না। এই বাংলাদেশ বিশ্বে সম্মান পেত না।’ তিনি বলেন, ‘এই সম্মানটা ধরে রাখতে হবে। আগামীতে যারা নতুন নেতা নির্বাচিত হবেন, নেতৃত্বে আসবেন তাদের সেই কথাটাই মনে রাখতে হবে যে, আদর্শ নিয়ে চলতে হবে। যে ত্যাগের মহিমা জাতির পিতা দেখিয়ে গেছেন সেই পথ ধরে চলতে হবে।’ দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে সরকার দেশকে এগিয়ে নিতে কাজ করছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ যেন আর কখনো পেছনে ফিরে না তাকায়, বাংলাদেশের অগ্রগতি যেন অব্যাহত থাকে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম যেন সুন্দর জীবন পায়, উন্নত জীবন পায়, সুশৃঙ্খল জীবন পায়, সমৃদ্ধিশালী জীবন পায় সেই লক্ষ্য নিয়েই আমরা পরিকল্পনা নিয়েছি, বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি।’

সর্বশেষ খবর