রবিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

রহস্যেই থাকল আইএস টুপি কাহিনি

কারাগার থেকে যায়নি বলে তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ, পুলিশ বলছে কারাগার থেকেই এসেছে

সাখাওয়াত কাওসার

হোলি আর্টিজান হামলা মামলায় ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত দুই আসামির কাছে আইএসের পতাকা সংবলিত টুপি রহস্যের কোনো কিনারা হয়নি। পুলিশ বলছে, এই টুপি জঙ্গিদের কাছেই ছিল। কারাগার থেকেই তারা নিয়ে এসেছে। তবে কারা কর্তৃপক্ষ বলছে ভিন্ন কথা। তাদের বক্তব্য, কারাগার থেকে কোনো আসামিকে আদালতে পাঠানো হলে তাকে বিভিন্ন সংস্থার উপস্থিতিতে তল্লাশি করা হয়।   হোলি আর্টিজান মামলার আসামিদেরও একই নিয়মে কারাগার থেকে আদালতে পাঠানো হয়েছিল। কারাগার থেকে এই টুপি নিয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

গত ২৭ নভেম্বর হোলি আর্টিজান মামলার রায়ের দিনে আদালত চত্বরে জঙ্গি রাকিবুল হাসান রিগ্যানের মাথায় ওই টুপিটি দেখা যাওয়ার পর কারা অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক কর্নেল আবরার হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ৩১ জনের সাক্ষ্য সংবলিত ২০ পৃষ্ঠার এই তদন্ত প্রতিবেদন আজ জমা হচ্ছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। তদন্ত কমিটির অন্য সদস্যরা ছিলেন উপ-মহাপরিদর্শক (ঢাকা) টিপু সুলতান ও সহকারী মহাপরিদর্শক (প্রশাসন) আমীরুল ইসলাম। কর্নেল আবরার হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কারা অধিদফতর কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটির কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। সব তথ্য-উপাত্ত, ভিডিও ফুটেজ পর্যালোচনা করে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে মৃত্যুদ াদেশ প্রাপ্ত বন্দী রাকিবুল হাসান ওরফে রিগ্যান যে কথিত আইএস টুপি পরিধান করেছিল তা কারাগার থেকে সংগৃহীত হয়নি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কারা অধিদফতরের তদন্ত কমিটির বাইরেও কথিত আইএস টুপির রহস্য উদঘাটন নিয়ে মাঠে নামে বিভিন্ন সংস্থা। কোথা থেকে জঙ্গিদের কাছে এলো সেই টুপি? কে  পৌঁছে দিল টুপিটি? তবে এরই মধ্যে তারা জানতে পেরেছেন, আদালতের হাজতখানা থেকে শুনানি কক্ষে নেওয়ার সময়ই টুপি কাহিনির অবতারণা হয়। হাজতখানা থেকে বের হওয়ার সময় রিগ্যানের মাথায় প্রথমে কালো রঙের টুপি দেখা যায়। এজলাসে শুনানি শেষ হওয়ার পরপরই তার মাথায় দেখা যায় আইএসের মনোগ্রাম সংবলিত একটি টুপি। কারাগারে থাকা রিগ্যান এরই মধ্যে বিভিন্ন সংস্থার লোকজনের কাছে স্বীকার করেছে, রায় শেষ হওয়ার পর একজন অজ্ঞাত লোক তার কাছে টুপিটি পৌঁছে দেয়। প্রটেকশনে থাকা পুলিশ কর্মকর্তা এবং সদস্যদের সামনেই তারা ওই টুপিটি মাথায় পরে। এজলাস থেকে পুলিশ পাহারায় তাদের প্রিজন ভ্যানে ওঠানো পর্যন্ত জঙ্গি রাকিবুল হাসান রিগ্যানের মাথায় ওই টুপিটি ছিল। আদালত এলাকা থেকে কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারে পৌঁছার কিছু সময় আগে প্রিজন ভ্যানের ওপরের ছিদ্র দিয়ে টুপিটি বাইরে ফেলে দেয় জঙ্গিরা। একাধিক সূত্র বলছে, গত ২৭ নভেম্বর হোলি আর্টিজান মামলার রায়ের দিন কোর্ট পরিদর্শক রোকন উদ্দীন মোল্লার নেতৃত্বে একটি দল আট আসামিকে আনতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার কেরানীগঞ্জে যায়। কারাগারের সিসিটিভি ফুটেজ অনুযায়ী, সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে আট আসামিকে কারাগারের প্রধান ফটকে নিয়ে আসা হয়। বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধি, কারাগারের জেল সুপার, ডেপুটি জেল সুপারের উপস্থিতিতে ওই সময় থেকে সকাল ৮টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত আসামিদের মেটাল ডিটেক্টর এবং বডি স্ক্যানার দিয়ে তল্লাশি করেন কারা সদস্যরা। তল্লাশি ও আনুষ্ঠনিকতা শেষে পুলিশ তাদের প্রিজন ভ্যানে ওঠায়। অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি এড়াতে বিধি অনুযায়ী আসামিদের হ্যান্ডকাফ পরানো হয়। পুলিশের পক্ষ থেকে আসামিদের জন্য হ্যান্ডকাফ সরবরাহের কথা থাকলেও কারা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে চারটি হ্যান্ডকাফ ম্যানেজ করে আসামিদের প্রিজন ভ্যানে তুলে পুলিশ। কোনো ভয়ঙ্কর আসামিকে আদালতে নেওয়া হলে তাদের বিশেষ নিরাপত্তার পাশাপাশি বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট এবং হেলমেট পরিয়ে নেওয়া হয়। বহুল আলোচিত এই মামলার আসামিদের ক্ষেত্রে এর ব্যত্যয় হয়েছে। সর্বশেষ আদালতে রায় ঘোষণার পর ওই আসামিদের পুনরায় বেলা ১টা ২০ মিনিটে কারা পূর্ণপক্ষের কাছে বুঝিয়ে দেন পরিদর্শক রোকন উদ্দীন মোল্লা। পিআরবি ১৯৪৩ এর ৪৮২ নম্বর বিধিতে বলা হয়েছে, কোর্টে উপস্থিত বিচারাধীন বন্দীদের দেহ পুলিশ অফিসার নিজে তল্লাশি করবেন এবং ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে মহিলা দ্বারা মহিলা বন্দীদের দেহ তল্লাশি করে কিছু পাওয়া গেলে নিজ হেফাজতে নেবেন। তবে মহিলাদের নাকফুল, কাচ, ঝিনুক দেহ থেকে খুলে নেওয়া যাবে না। ৪৮৪ নম্বর বিধিতে বলা হয়েছে, বিচারাধীন বন্দীকে জেলখানায় প্রেরণের পূর্বে কোর্ট রেজিস্ট্রারে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা স্কর্ট দলের কর্মকর্তার সামনে বন্দীদের দেহ তল্লাশি করবেন এবং উভয় কর্মকর্তা হাজত রেজিস্টারে মন্তব্য লিখে স্বাক্ষর করবেন। পুলিশের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের যুগ্ম কমিশনার মাহবুবুল আলম বলেন, কারাগার প্রাঙ্গণে থাকা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ তারা দেখেছেন। জঙ্গি রাকিবুল আদালতের হাজতখানা থেকে মাথায় টুপি পরে বের হয়। সেই টুপিই পরে এজলাস থেকে বের হওয়ার সময় সে উল্টিয়ে পরে বলে তারা নিশ্চিত হয়েছেন। এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, রায় শেষে আবার কারাগারে  ঢোকানোর আগে জঙ্গিদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। রাকিবুল বলেছে, টুপিটি কারাগার থেকে সে এনেছিল। এ ঘটনায় পুলিশের কোনো সদস্যের গাফিলতি আছে কিনা তা তদন্ত করা হচ্ছে। গাফিলতি পেলে তা অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।  প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ১ জুলাই দেশের ইতিহাসের ভয়াবহ হোলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলা মামলায় গত ২৭ নভেম্বর আট আসামির ৭ জনকে মৃত্যুদে র রায় দেয় আদালত। রায়ের পর আদালত থেকে  বের করে আসামিদের প্রিজন ভ্যানে তোলার সময় কয়েকজনের মাথায় আইএসের মনোগ্রাম সংবলিত টুপি দেখা যায়। এ সময় আসামিরা ‘আল্লাহু আকবর’ বলে চিৎকার করে এবং এ রায় মানে না বলেও অকথ্য ভাষায় কথা বলতে থাকে। এ সময় জঙ্গিদের মাথায় আইএসের টুপি এবং তাদের ‘আস্ফালনে’ বিস্ময় প্রকাশ করে বিভিন্ন মহল। টুপি হয়ে উঠে ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’।

সর্বশেষ খবর