রবিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

কৌশল বদলেও মামলাজট কমছে না ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালে

নতুন পরিপত্র জারি ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাবে না সরকার আসছে ট্রাইব্যুনাল বাতিলের সিদ্ধান্ত

নিজস্ব প্রতিবেদক

ভূমি জরিপে ভুল সংশোধনসংক্রান্ত মামলার জট বেড়েই চলেছে। বারবার কৌশল পাল্টেও দেশে ল্যান্ড সার্ভের মামলা ৩ লাখ ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে ৫০ হাজারের বেশি মামলা বিচারাধীন রয়েছে পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে। ফলে বিচার পেতে  দীর্ঘসূত্রতার মুখে পড়েছেন বিচারপ্রার্থীরা। পাশাপাশি ল্যান্ড সার্ভে আপিল ট্রাইব্যুনাল এখনো কার্যকর না হওয়ায় মামলার আপিল নিয়ে বিপাকে পড়তে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। ২০১২ সালে একটি আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠনের গেজেট জারি হওয়ার পর তা আর বাস্তব রূপ নেয়নি। ট্রাইব্যুন্যালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার জায়গা না পেয়ে বিচারপ্রার্থীদের হাই কোর্টে প্রতিকার চাইতে হচ্ছে।

এদিকে, ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষকে উচ্চ আদালতে আপিল না করার নির্দেশনা দিয়ে নতুন পরিপত্র জারি করেছে সরকার। আইন মন্ত্রণালয়সূত্র জানিয়েছেন, বিদ্যমান মামলাজট নিরসনে ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল বিলুপ্ত করে আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আইনটি সংশোধন হলে, প্রচলিত দেওয়ানি আদালতেই হবে ভূমি জরিপসংক্রান্ত আপত্তির নিষ্পত্তি। অন্যদিকে, প্রচলিত দেওয়ানি আদালতেও অন্যান্য মামলার চাপ রয়েছে। এ অবস্থায় এ কৌশল কতটা কাজে আসবে, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের পরিসংখ্যান অনুযায়ী (৩০ জুন পর্যন্ত), দেশের ৪৫টি ল্যান্ড সার্ভে আপিল ট্রাইব্যুনালে ৩ লাখ ৩ হাজার ৩৫টি ভূমি জরিপে ভুলসংক্রান্ত মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এর মধ্যে ৫৬ হাজার ১৪৫টি মামলা ঝুলে আছে পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে। আর উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত রয়েছে ১৬৮টি মামলা। বিচারাধীন মামলার মধ্যে ঢাকা বিভাগে ৮৮ হাজার ৫০৯, চট্টগ্রাম বিভাগে ৪০ হাজার ১৩৫, রাজশাহী বিভাগে ১০ হাজার ৯১১, খুলনা বিভাগে ৪৯ হাজার ২, বরিশাল বিভাগে ১৫ হাজার ৪৪, সিলেট বিভাগে ১৫ হাজার ৪০৬, রংপুর বিভাগে ১১ হাজার ৫৪০ ও ময়মনসিংহ বিভাগে রয়েছে ৭২ হাজার ৪৮৮টি। জেলা হিসেবে কিশোরগঞ্জে সবচেয়ে বেশি ভূমি জরিপের মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এ জেলায় ৪৩ হাজার ৩১টি মামলা রয়েছে। অন্যদিকে সবচেয়ে কম ৪৮০টি মামলা রয়েছে সিরাজগঞ্জ জেলায়। এদিকে ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালে থাকা বিদ্যমান মামলাজট নিরসনে আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সাধারণ মানুষের ভোগান্তি দূর করতে আমরা আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছি। এত দিন ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালগুলোয় একজন যুগ্ম-জেলা জজ পদমর্যাদার বিচারক মামলা শুনতেন। সংশোধিত আইনে যুগ্ম-জেলা জজের পাশাপাশি সহকারী জজ ও সিনিয়র সহকারী জজরাও ল্যান্ড সার্ভের মামলাগুলো শুনানি করতে পারবেন।’ এতে এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হবে বলে জানান তিনি। সারা দেশে বিআরএস জরিপ শুরু হয় ১৯৮৪ সালে। এ জরিপ এখনো শেষ হয়নি। যেসব এলাকায় শেষ হয়েছে, সেসব এলাকায় দেখা দিয়েছে নানা ধরনের ত্রুটি-বিচ্যুতি। অদক্ষ মাঠ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতি ও অবহেলায় ভুলে ভরা এসব ভূমি জরিপের খেসারত গুনতে হচ্ছে জমির মালিকদের। জরিপের পর্চা আর ম্যাপে হাজার হাজার ভুল। কারও জমি পর্চায় আছে তো ম্যাপে নেই, ম্যাপে আছে তো পর্চায় নেই। আবার ম্যাপে থাকলেও শত বছর ধরে যে চৌহদ্দিতে মালিক সম্পত্তি ভোগদখল করে আসছেন সেভাবে নেই। এ কারণে সৃষ্টি হয়েছে নানা রকমের বিরোধ। প্রথমে এসব বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য বিভিন্ন দেওয়ানি আদালতে মামলা হতো। এরপর সরকার স্টেট অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড টেন্যান্সি অ্যাক্ট, ১৯৫০-এর ১৪৫(এ) ধারা অনুযায়ী ২০১২ সালের ২৯ নভেম্বর সারা দেশে ৪২টি ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করে। পরে আরও তিনটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। আইনটির ১৪৫ (বি) ধারায় ল্যান্ড সার্ভে আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠনের কথা বলা হয়েছে। ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালের যে কোনো রায়, আদেশ বা ডিক্রির বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিদের আপিল ট্রাইব্যুনালে আপিল করার সুযোগ রাখা হয়েছে। বাস্তবে ওই আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠনের একটি গেজেট জারি হলেও এখনো এর কার্যক্রম শুরু হয়নি। সব ধরনের খতিয়ানে ব্যক্তির নাম থাকার পরও কোনো জমি যদি সরকারের নামে রেকর্ডভুক্ত হয় এবং ট্রাইব্যুনাল সরকারের বিরুদ্ধে রায় দেয়, তাহলে তা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নামে নামজারি করে দিতে হবে। কিন্তু এ পর্যন্ত ট্রাইব্যুনালের কোনো রায়ের পর নামজারি করে দিতে দেখা যায়নি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইনজীবী ইমতিয়াজ আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আপিল ট্রাইব্যুনাল না হওয়ায় মামলায় জটিলতা বেড়ে যাচ্ছে। হাই কোর্টে রিট করে প্রতিকার চাইতে হচ্ছে। এতে মামলার ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। সরকারের উচিত বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ লাঘবে দ্রুত আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠনের পাশাপাশি আইনে যে বিধি তৈরির করার কথা আছে সেটাও তৈরি করা।’

ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল না করতে পরিপত্র জারি : ১৯৮৪ সালে সরকার একটি পরিপত্র জারি করে, সরকারের বিরুদ্ধে কোনো রায় গেলে তা সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত চ্যালেঞ্জ করে তারপর রায় অনুযায়ী কাজ করা হবে। পুরনো এ আদেশ গত ১৫ সেপ্টেম্বর বাতিল করে নতুন পরিপত্র জারি করা হয়। নতুন পরিপত্রে ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালের রায় বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পরিপত্রে বলা হয়েছে, ট্রাইব্যুনালের রায় পরীক্ষা করে যদি দেখা যায় কোনো ব্যক্তির পক্ষে রায়টি সঠিক, তাহলে আর উচ্চ আদালতে যাওয়ার দরকার নেই। নতুন এ পরিপত্রের কারণে ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালে মামলার সংখ্যা কমবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের সুপারিশের বাস্তবায়ন নেই : ২০১৬ সালে জাতীয় বিচার বিভাগীয় সম্মেলনে বিচারকরা ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালের বেশ কিছু সমস্যা চিহ্নিত করেন। কিন্তু ওইসব সমস্যা সমাধানে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী বিচারকরা মতামত দেন, মাত্র ৪৩ জন বিচারক নিয়ে বিশাল মামলাজট নিষ্পত্তি করা অসম্ভব। প্রতি ১ হাজার ৫০০ মামলার জন্য একজন বিচারক প্রয়োজন। মামলা পরিচালনায় ট্রাইব্যুনালে যে পরিমাণ লোকবল প্রয়োজন, তা-ও নেই। প্রতি ট্রাইব্যুনালে যে পরিমাণ মামলা, তাতে পাঁচ থেকে সাতজন জারিকারক প্রয়োজন। নেই সেরেস্তাদার।

ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালনা করতে সরকার এ পর্যন্ত কোনো বিধিমালাও তৈরি করেনি।

ঢাকা মহানগর ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনাল : ঢাকার ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালে সাড়ে ৫ হাজারের বেশি মামলা বিচারাধীন। একটি ট্রাইব্যুনালের পক্ষে এত মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব নয়। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, একটি মামলার শুনানির জন্য তিন থেকে পাঁচ মাস পরপর তারিখ ধার্য করা হয়। ফলে দীর্ঘ সময়েও মামলা নিষ্পত্তি হয় না। বিচারকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একজন বিচারকের পক্ষে মাসে ১৫টি মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব। বছরজুড়ে ১৬৫টি মামলা নিষ্পত্তি করতে পারেন। এভাবে বিচার চললে ঢাকার ট্রাইব্যুনালের মামলা নিষ্পত্তি হতে ৩৩ বছর প্রয়োজন।

সর্বশেষ খবর