সোমবার, ২ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

দুই চালক এক হেলপারের যাবজ্জীবন

জাবালে নূরের বাসচাপায় রমিজ উদ্দিন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহতের চাঞ্চল্যকর মামলার রায়

নিজস্ব ও আদালত প্রতিবেদক

দুই চালক এক হেলপারের যাবজ্জীবন

রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী মৃত্যুর ঘটনায় দায়ের করা চাঞ্চল্যকর মামলায় জাবালে নূর পরিবহনের দুই চালক এবং একজন সহকারীকে (হেলপার) যাবজ্জীবন কারাদন্ড  দিয়েছে আদালত। পাশাপাশি ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ছয় মাসের কারাদন্ড  দেওয়া হয়। এ ছাড়া অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় দুজনকে খালাস দিয়েছেন বিচারক। গতকাল ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক কে এম ইমরুল কায়েশ এ রায় ঘোষণা করেন। দন্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন- জাবালে নূর পরিবহনের দুই বাসচালক মাসুম বিল্লাহ ও জুবায়ের সুমন এবং হেলপার কাজী আসাদ।

রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছে, পরিবহন সেক্টরে চালক-হেলপারদের খামখেয়ালিপনায় সারা দেশেই ছাত্র-ছাত্রী, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, চাকরিজীবী ও সাধারণ মানুষ দুর্ঘটনায় বাসের নিচে চাপা পড়ে নিহত হচ্ছে। এ খামখেয়ালিপনা যেন মানুষ হত্যার নেশায় পরিণত হয়েছে। এদিকে এ রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে নিহত দিয়ার পরিবার আসামিদের মৃত্যুদন্ড দাবি করেছে। আসামি পক্ষের আইনজীবীরাও রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন।

রায়ের বিষয়ে রাষ্ট্র পক্ষের আইনজীবী আবদুল্লাহ আবু সাংবাদিকদের বলেন, রায় ঘোষণার পর দুই চালক মাসুম বিল্লাহ ও জুবায়ের সুমনকে সাজা পরোয়ানা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া হেলপার কাজী আসাদ পলাতক থাকায় তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। এ ছাড়া জাবালে নূর বাসের এক মালিক জাহাঙ্গীর আলম ও হেলপার এনায়েত হোসেনকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়েছে। এর আগে জাবালে নূরের আরেক বাসের মালিক শাহাদাত হোসেন আকন্দের অংশের কার্যক্রম উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত রয়েছে। মামলার কার্যক্রম স্থগিত থাকা শাহাদাত হোসেনের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য উচ্চ আদালতে যাওয়া হবে।  খালাস পাওয়া দুই আসামির বিষয়ে তিনি বলেন, চালকের সহকারী মো. এনায়েত হোসেন চালককে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেছে। তার কথা না শুনে চালক জোরে গাড়ি চালিয়েছে। আর বাসের মালিক জাহাঙ্গীর আলমের দোষ প্রমাণিত হয়নি। আরেক বাসের মালিক শাহাদত হোসেন ড্রাইভারের হালকা লাইসেন্স থাকার পরও তিনি তার হাতে গাড়ি তুলে দিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, অবৈধ লাইসেন্স দিয়ে অন্যায় করে কেউ পার পাবে না। নিরাপদ সড়ক আমরা সবাই চাই। প্রত্যেকের সুন্দরভাবে এবং সঠিক লাইসেন্স নিয়ে গাড়ি চালানো উচিত। মামলা সূত্রে জানা গেছে, রাষ্ট্র পক্ষ থেকে এ মামলায় ৩৭ জনকে আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছে। বাসচালক মাসুম বিল্লাহসহ তিনজন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। জবানবন্দিতে বলেছে, বাসচালক মাসুম বিল্লাহ ও অপর বাসচালক জুবায়ের সুমন জানতেন যে, জিল্লুুর রহমান উড়ালসড়ক ঝুঁকিপূর্ণ। তারপরও তারা সেদিন আগেভাগে যাত্রী তোলার জন্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছিলেন। আগে যাত্রী তোলার জন্য জোবায়ের সুমন তার বাসটি সামনে নিয়ে গিয়ে উড়ালসড়কের ঢালে জায়গা ব্লক করে রেখেছিলেন। পেছনে থাকা বাসচালক মাসুম বিল্লাহ তখন আগে যাত্রী তোলার জন্য বাম পাশ দিয়ে গিয়ে যেখানে যাত্রীরা দাঁড়িয়ে থাকেন, সেখানে বাসটি তুলে দেন। এতে রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শিক্ষার্থী রাজিব, দিয়া খানমসহ কয়েকজন ছাত্রী গুরুতর আহত হন। চালকের সহকারী এনায়েত হোসেনের জবানবন্দি থেকে জানা যায়, বারবারই তিনি মাসুম বিল্লাহকে দ্রুত গাড়ি না চালানোর জন্য অনুরোধ করেছিলেন। তারপরও মাসুম বিল্লাহ দ্রুতগতিতে ঘটনাস্থলে গিয়ে বাস তুলে দেন।

আদালতের পর্যবেক্ষণ : পরিবহন সেক্টরে চালক-হেলপারদের খামখেয়ালিপনায় সারা দেশেই ছাত্র-ছাত্রী, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, চাকরিজীবী ও সাধারণ মানুষ দুর্ঘটনায় বাসের নিচে চাপা পড়ে নিহত হচ্ছে। এ খামখেয়ালিপনা যেন মানুষ হত্যার নেশায় পরিণত হয়েছে। রাজধানীর শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শিক্ষার্থী রাজীব-মিমকে বাস চাপা দিয়ে হত্যার মামলার রায়ে গতকাল ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক কে এম ইমরুল কায়েশ এ পর্যবেক্ষণ দেন। আদালত রায়ে বলেন, রাজীব-মিমকে বাস চাপা দিয়ে মারার ঘটনায় দায়ের করা এ মামলা সাধারণ মানুষের বিবেককে নাড়া দেয়। সেদিন রাজীব-মিমের আত্মীয়স্বজন, সারা দেশের শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। ঘটনায় জড়িত বাসের চালক-হেলপারদের বিচার চাইতে মাঠে নামে সবাই। সেই বিচার সম্পন্ন হলো। পর্যবেক্ষণে আদালত বলে, পরিবহন সেক্টরের মালিক, চালক-হেলপাররা অধিক ভাড়া উপার্জনের জন্য মানুষের জীবনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন না করে ভারি গাড়ি চালানোর লাইসেন্স না থাকা সত্ত্বেও বিআরটিএর অনুমোদন ছাড়া ভারি গাড়ি চালিয়ে যত্রতত্র মানুষের গায়ের ওপর তুলে দিচ্ছে। এটা বন্ধ হওয়া আবশ্যক। এ জন্য চালকরা দায়ী উল্লেখ করে আদালত রায়ে বলে, চালক-হেলপারদের অধিক জমা বেঁধে দেওয়ার ফলে এক বাস স্টপেজ থেকে আরেক বাস স্টপেজে যাওয়ার জন্য তারা অসম ও অবৈধ প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়। যার ফলে প্রতিনিয়ত রাস্তাঘাটে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটছে। এ ক্ষেত্রে বাস মালিকদের অধিক টাকা উপার্জনের মানসিকতা পরিহার করা আবশ্যক।

আদালত রায় ঘোষণার সময় বলে, গণমাধ্যমে যারা কাজ করেন তাদেরও দায়িত্ব রয়েছে সবাইকে সচেতন করার। আমাদের দেশের গণমাধ্যম অনেক শক্তিশালী উল্লেখ করেন বিচারক বলেন, বিভিন্ন দুর্ঘটনার কারণ তারা তুলে ধরেন। দুর্ঘটনায় শত লোকের প্রাণহানি ঘটে। যাদের দায়িত্বে অবহেলায় এসব ঘটে তা জাতির সামনে তুলে ধরলে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হয়। আদালত বলে, ভবিষ্যতেও গণমাধ্যম সঠিক ভূমিকা পালন করবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন।

চালকের ফাঁসি চায় পরিবার : দুই বাসের রেষারেষির মধ্যে চাপা পড়ে রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় যাবজ্জীবনের রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে নিহত ছাত্রী দিয়া আক্তার মিমের পরিবার। আদালতের যাবজ্জীবন দন্ডপ্রাপ্ত জাবালে নূরের চালক মাসুম বিল্লাহর ফাঁসির চেয়ে উচ্চ আদালতে যেতে রাষ্ট্রপক্ষের প্রতি তারা দাবি জানিয়েছে। রায়ের পর দিয়ার মামা সেলিম হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, চালকের ফাঁসি হওয়া উচিত। তিনি লাইসেন্স ছাড়া ড্রাইভার। রেজিস্ট্রেশন নেই গাড়ির, অন্য কাগজপত্রও ঠিক নেই। সে কারণে তার ফাঁসি দেওয়া উচিত। সরকার পক্ষের ফাঁসির আবেদন করা উচিত।

আপিল করবে আসামি পক্ষ : রায় ঘোষণার পর এক প্রতিক্রিয়ায় যাবজ্জীবন দন্ডপ্রাপ্ত বাসচালক মাসুম বিল্লাহর আইনজীবী হাসিম উদ্দিন বলেন, রায়ে আমরা অবশ্যই অসন্তুষ্ট। ছাত্র আন্দোলনের কারণে তাদের সন্তুষ্ট করতে আদালত এ রায় দিয়েছে। যাবজ্জীবন দন্ডপ্রাপ্ত আরেক বাসের চালক জুবায়ের সুমনের আইনজীবী টি এম আসাদুল হক বলেন, আমরা ন্যায়বিচার পাইনি, অবশ্যই আমরা উচ্চ আদালতে যাব।

ফিরে দেখা : গত বছরের ২৯ জুলাই দুপুরে রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে হোটেল র‌্যাডিসনের বিপরীত পাশের জিল্লুর রহমান উড়ালসড়কের ঢালের সামনের রাস্তার ওপর জাবালে নূর পরিবহনের তিনটি বাস রেষারেষি করতে গিয়ে একটি বাস রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা লোকজনের ওপর উঠে পড়ে। এতে দুই শিক্ষার্থী নিহত ও ৯ জন আহত হয়। নিহত দুই শিক্ষার্থী হলো শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র আবদুল করিম রাজীব (১৭) ও একাদশ শ্রেণির ছাত্রী দিয়া খানম মিম (১৬)। এ ঘটনায় নিহত শিক্ষার্থী দিয়া খানমের বাবা জাহাঙ্গীর আলম বাদী হয়ে ক্যান্টনমেন্ট থানায় মামলা করেন। পরে ঘটনার তদন্ত করে গত বছরের ৬ সেপ্টেম্বর জাবালে নূর বাসের মালিক শাহাদাত হোসেনসহ ছয়জনকে আসামি করে আদালতে দ বিধির ৩০৪ ধারায় অভিযোগপত্র দাখিল করেন ডিবির পরিদর্শক কাজী শরিফুল ইসলাম। ছয় আসামির বিরুদ্ধে গত ২৫ অক্টোবর অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করে আদালত। পরে অভিযোগ গঠনের আদেশ চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে যান জাবালে নূরের মালিক শাহাদাত হোসেন। তার পক্ষে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ আসে। বাকি পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলার কার্যক্রম চলে।

সর্বশেষ খবর