সোমবার, ২ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

কানের নকশাতেই শেরেবাংলানগরে সচিবালয়

নিজামুল হক বিপুল

প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র বাংলাদেশ সচিবালয় রাজধানীর শেরেবাংলানগরে স্থানান্তর নিয়ে তোড়জোড় শুরু করেছে সরকার। গত সপ্তাহে মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনার পর তৎপর হয়ে উঠেছে পূর্ত মন্ত্রণালয়। কিন্তু সমস্যা দেখা দিয়েছে ভিন্ন জায়গায়। শেরেবাংলানগরের কোন স্থানটিতে সচিবালয় কমপ্লেক্স নির্মাণ হবে সেটি এখনো চূড়ান্ত নয়। তবে স্থপতি লুই আই কানের নকশা অনুযায়ী বর্তমান বাণিজ্য মেলার স্থানটিই হচ্ছে মূলত সচিবালয়ের নির্ধারিত স্থান। তাই এখন লুই আই কানের নকশার ওপরই সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ নূর-ই আলম চৌধুরী লিটন স্থাপত্য বিভাগের প্রধান প্রকৌশলীসহ সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়েছেন দ্রুততম সময়ের মধ্যে লুই আই কানের নকশার একটি সচিত্র প্রতিবেদন তুলে ধরার। সে লক্ষ্যে কাজও শুরু করেছে স্থাপত্য বিভাগ। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।

গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং স্থাপত্য বিভাগ সূত্রে পাওয়া তথ্য থেকে জানা যায়, ষাটের দশকে আইয়ুব খানের শাসনামলে বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) প্রশাসনিক অঞ্চল তৈরির জন্য রাজধানী ঢাকার শেরেবাংলানগর ও আগারগাঁওয়ের বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ে একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে জাতীয় সংসদের স্থপতি আমেরিকার বিখ্যাত স্থাপত্যবিদ লুই আই কানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এর পর থেকেই শুরু হয় ওই অঞ্চল নিয়ে নকশা তৈরির কাজ। জীবদ্দশায় লুই আই কান এ অঞ্চলে যেসব প্রশাসনিক স্থাপনা নির্মাণ হবে সেগুলোর নকশা সম্পন্ন করতে পেরেছিলেন কি না তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে লুই কানের নকশা অনুযায়ী শেরেবাংলানগরে বাংলাদেশ সচিবালয় কমপ্লেক্স নির্মাণের বিষয়ে স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু গত ৫০ বছরেও সচিবালয় সেখানে স্থানান্তর করা হয়নি। রাজধানীর আবদুল গনি রোড থেকে সচিবালয় স্থানান্তরের বিষয়ে বিভিন্ন সরকারের আমলে উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা বাস্তবে রূপ নেয়নি। সর্বশেষ আওয়ামী লীগ সরকারের গত মেয়াদে সচিবালয়কে শেরেবাংলানগরে স্থানান্তরের বিষয়ে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে একটি প্রকল্প তৈরি করে একনেক বৈঠকে উপস্থাপন করা হয়। প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার ওই প্রকল্পটি একনেক থেকে ফেরত আসে। তখন বলা হয়েছিল, স্থপতি লুই আই কানের পূর্ণাঙ্গ নকশা সংগ্রহ করার পর পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এরই অংশ হিসেবে সরকার লুই আইন কানের নকশা সংগ্রহে তৎপরতা শুরু করে। ২০১৬ সালে নকশাটি বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়।

স্থাপত্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ইতিমধ্যে সরকার লুই আই কানের নকশা দেশে এনেছে। এটি বর্তমানে সরকারের আর্কাইভ, জাতীয় সংসদ সচিবালয় ও স্থাপত্য বিভাগের কাছে রয়েছে। সূত্র জানায়, নকশায় কী কী আছে, কোথায় কোন স্থাপনা নির্মাণের কথা বলা হয়েছে, এর খুঁটিনাটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। প্রধান স্থপতি আ স ম আমিনুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানিয়েছেন, প্রায় তিন সপ্তাহ আগে জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ নূর-ই আলম চৌধুরী লিটন তাকে ডেকে নিয়ে বলেছেন, লুই আই কানের নকশায় কোথায় কী আছে তা বের করতে হবে। নকশা অনুযায়ী কোন কোন স্থানে কী কী স্থাপনা নির্মাণের কথা আছে তা খুঁজে বের করার নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী তারা ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছেন।

তিনি জানান, এই নকশা একটি বিশাল কর্মযজ্ঞ। এটি এত বিশাল একটি কাজ যে, অল্প সময়ে তা বলে দেওয়া সম্ভব নয়। তিনি জানান, স্থাপত্য বিভাগ কানের নকশার প্রতিটি দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলন খুব তীক্ষèভাবে দেখছে। বলা যায়, সবকিছু চিহ্নিত করতে রীতিমতো গবেষণা চলছে নকশা নিয়ে। ওই নকশায় অনেক কিছু স্পষ্ট করে দেওয়া আছে। কোথায় কোন ভবন হবে তাও উল্লেখ করা আছে। পুরো নকশা খতিয়ে দেখার পরই বলা যাবে আসলে কোন কোন ভবন কোথায় কোথায় নির্মাণের কথা বলা আছে। প্রধান স্থপতি বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করব লুই আই কানের নকশাটি অবিকল বাস্তবায়নের। এ জন্য লুই আই কানের সঙ্গে ওই সময় কাজ করেছেন তার একজন সহযোগী রয়েছেন। তিনি বর্তমানে কানের ফার্মেই কাজ করছেন। তাকে নিয়ে আসা হবে পুরো নকশাটি বোঝার জন্য।’

তিনি জানান, নকশার সবকিছু চিহ্নিত করার পরই স্পষ্ট করে বলা যাবে সচিবালয় কমপ্লেক্সটির জন্য শেরেবাংলানগরের কোন স্থানটি চিহ্নিত করে রাখা হয়েছে।

সাবেক প্রধান স্থপতি গাজী নাসির বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘পুরো নকশাটি ভালোভাবে না দেখলে পরিষ্কার করে বলা যাবে না যে শেরেবাংলানগরের কোন স্থানটি সচিবালয়ের জন্য নির্ধারিত। তবে আমি যতটুকু দেখেছি, তাতে বর্তমানে যে স্থানটিতে বাণিজ্য মেলা হয় সেখানটাই সচিবালয়ের জন্য নির্ধারিত। এর সঙ্গে চন্দ্রিমা উদ্যানের কোনো অংশ আছে কি না, বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র যেখানে রয়েছে সেখানকার কোনো অংশ সচিবালয়ের জমির মধ্যে পড়েছে কি না, তা নকশা ভালোভাবে না দেখে বলা যাবে না।’ সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চাইছেন লুই আইন কানের নকশা অনুযায়ী সচিবালয়সহ পুরো প্রশাসনিক ব্যবস্থাটি একটি স্থানে থাকুক। তাতে কাজেরও সুবিধা। এ জন্যই এখন এই বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায়ই জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ লুই আই কানের নকশা নিয়ে কাজ করার জন্য প্রধান স্থপতিকে নির্দেশনা দিয়েছেন।

এদিকে ২৫ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রিসভার বৈঠকে সচিবালয় স্থান্তরের বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমকে নির্দেশ দিয়েছেন। ওই দিনই মন্ত্রিসভা বৈঠক শেষে গণপূর্তমন্ত্রী জানিয়েছেন, তারা দ্রুত কাজ শুরু করবেন। তবে এটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার উল্লেখ করে তিনি জানিয়েছিলেন, একটি পূর্ণাঙ্গ সচিবালয় নির্মাণ করা জরুরি। যেহেতু সচিবালয়ের জন্য নির্ধারিত স্থান রয়েছে তাই কাজ করতে খুব একটা সমস্যা হবে না। তিনি বলেন, লুই আই কানের নকশা অনুযায়ী আগারগাঁওয়ে যেখানে প্রতিবছর আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা হয়ে থাকে, সেই স্থান এবং চন্দ্রিমা উদ্যানের কিছু অংশ নিয়ে সচিবালয় স্থাপনের কাজ শুরু করা হবে। কিন্তু এটা বেশ সময়সাপেক্ষ বিষয়। তিনি জানান, লুই কানের নকশাকে ভিত্তি ধরে সব স্থাপনা নির্মাণ করা হবে, যাতে নকশার কোনো ব্যত্যয় না ঘটে। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী বলেন, ‘পরিকল্পিত ঢাকা গড়ার লক্ষ্যে সরকারি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এবং প্রশাসনের সমন্বিত কার্যক্রম ও সুবিধা নিশ্চিত করার জন্যই একটি স্থানে সরকারের সব মন্ত্রণালয় ও দফতরের কার্যালয় স্থাপন করা হবে। ইতিমধ্যে আমরা মানসিকভাবে এ বিষয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছি।’ তিনি জানান, নতুন সচিবালয়ে গাড়ি পার্কিংয়ের সুব্যবস্থা, ফুডকোর্ট নির্মাণ, সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা, উন্নত ড্রেনেজ ব্যবস্থাসহ যা যা থাকা দরকার তার সবই করা হবে। এক কথায় আধুনিক ও দৃষ্টিনন্দন সচিবালয় কমপ্লেক্স করা হবে। বর্তমান সচিবালয়ে এসব সুযোগ-সুবিধার অনেক ঘাটতি রয়েছে। এখানে পার্কিংয়ের কোনো সুব্যবস্থা নেই। ফলে সচিবালয়ের ভিতরের রাস্তাগুলো এবং বাইরের রাস্তায় গাড়ি পার্ক করা হয়, যা কাজের ব্যাঘাত ঘটায়।

সর্বশেষ খবর