সোমবার, ২ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

আমাদের সংবাদদাতা পাকিস্তান আর্মিকেও জানিয়ে দেয়

ক্যাপ্টেন (অব.) এ বি তাজুল ইসলাম

আমাদের সংবাদদাতা পাকিস্তান আর্মিকেও জানিয়ে দেয়

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ। আমি সূত্রাপুরে এক আত্মীয়ের বাসায়। রাতের অন্ধকারে পাকিস্তানিরা নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। প্রথম আক্রমণস্থল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পিলখানা, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, চট্টগ্রামের ইবিআরসি বেঙ্গল রেজিমেন্ট ট্রেনিং সেন্টার- এসব এলাকায়। পুরান ঢাকায় হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় অনেক মানুষকে হত্যা করল। চারদিকে শুধু গুলির শব্দ। এমন সময় এলো বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা। ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে বঙ্গবন্ধু শেষ বার্তা দিলেন- ‘এখন থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ। শত্রুর শেষ সৈন্যটা বিতাড়িত না হওয়া পর্যন্ত তোমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাও।’ সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীনতার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকা সমগ্র বাঙালি ঝাঁপিয়ে পড়ল। পরদিন সকালে সূত্রাপুর থানার পুলিশ তাদের মালখানার অস্ত্রশস্ত্র আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের দিয়ে দিল।

আমরা চলে গেলাম ভারতে। সেখানে সেকেন্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের নেতৃত্বে সেক্টর থ্রি গঠিত হয়। সেখানে জেনারেল শফিউল্লাহ, ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামান, জেনারেল আজিজ, জেনারেল এজাজ, ইব্রাহিম, মতিন, মতিউর রহমান, হেলাল মোর্শেদ সবাই ছিলেন। সেখানে নতুন করে প্রশিক্ষণ নিলাম। আমি তখন সেক্টর থ্রিতে এক্সপ্লোসিভ টিমের নেতৃত্বে। নরসিংদী, বেলাবো, জিনারদি, কটিয়াদী, গফরগাঁও- এসব এলাকার যেসব স্থাপনা ধ্বংস করলে যুদ্ধের পক্ষে আমাদের অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি হবে, সেগুলো ধ্বংসের দায়িত্ব পালন করছি। সিলেটের জকিগঞ্জের দিকে আমাকে একটা ব্রিজ উড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তখন কিছু স্মাগলারও আমাদের তথ্য দিত। তাদের থেকে তথ্য নিয়ে আমরা রওনা হলাম। কিন্তু, যারা আমাদের তথ্য দিয়েছে, তারা পাকিস্তান আর্মিকেও জানিয়ে দেয়। রাতে গিয়ে প্রথমে ব্রিজটা রেকি করি। পুরো ব্রিজটা পরিদর্শন করে এসে এক্সপ্লোসিভগুলো প্রস্তুত করতে শুরু করি। ব্রিজের অপর পাশে একটা টিম পাঠালাম প্রটেকশনের জন্য। তারা যখন ব্রিজের মাঝামাঝি যায়, তখনই গুলির শব্দ। তাকিয়ে দেখি দুই পাশ থেকে দুটা জিপ লাইট জ্বালিয়ে ব্রাশফায়ার করছে। আমার টিম নদীতে লাফিয়ে পড়ে। তখন প্রচন্ড বৃষ্টি। বুঝলাম আমরা ফাঁদে পড়েছি। সৌভাগ্যক্রমে আমাদের একটি লোকও সেদিন নিহত হয়নি। তারা সাঁতরে ভারতে চলে যায়। আমিও সঙ্গীদের নিয়ে সাঁতরে রওনা হলাম। একসময় পায়ের তলায় বালু অনুভব করলাম। ভাবলাম লোকালয় আছে। পাড়ে গিয়ে কারও পায়ের শব্দ কানে এলো। ধারণা করলাম আমার টিমেরই কেউ যাচ্ছে। কে?- প্রশ্ন করতেই উত্তর আসল ‘আমি মওদুদ’। সে আমার টিমেরই লোক। বলল, আমরা নদী সাঁতরে গিয়ে ব্রিজের গোড়ায় নদীর পাড়ে ওদের ক্যাম্পে গ্রেনেড চার্জ করব। আমিও সায় দিলাম। কিন্তু গিয়ে দেখি ক্যাম্পটা বেশ উপরের দিকে। এ ছাড়া পাকিস্তানিরা প্রহরা বাড়িয়েছে। সিদ্ধান্ত বদলে ভারতে ফিরে যাই। বিএসএফ ক্যাম্পে গেলে ভারতীয় আর্মি আমাদের সহযোগিতা করে কিন্তু অফিশিয়ালি না। আমরা আমাদের ক্যাম্পে ফিরে যাই। বৃষ্টিতে ভিজে টিমের কারও কারও জ্বর এসে গেছে। পরদিন সন্ধ্যায় আমাকে বলা হলো, ব্রিজ ভাঙতে আজকে রাতে যেতে হবে। আমার টিমের লোকগুলোকে মেজর কুমার সিলেক্ট করেছিল। এবার আমি বললাম, লোকগুলোকে আমি সিলেক্ট করব। আমি একটা টিম সিলেক্ট করে রওনা হলাম। করিমগঞ্জ থেকে যে রাস্তা দিয়ে ব্রিজ ভাঙার জন্য আগের দিন গিয়েছিলাম, এবার দেখি অন্য রাস্তা। মেজর কুমারকে জিজ্ঞাসা করলাম, আমরা কি কোনো ভুল করছি? কুমার বলল, পাকিস্তানিরা সতর্ক থাকায় আমরা ওই ব্রিজ ভাঙতে যাচ্ছি না। আমরা অন্য একটা স্থানে গিয়ে ব্রিজ ভেঙে ফিরে আসলাম। ওই সময় আমার মাথায় একটা ভাবনা কাজ করত। তা হলো- সিলেট ও জকিগঞ্জের মধ্যে সব ব্রিজ ভাঙার তো দরকার নেই। এগুলো তো পরে আমাদেরই তৈরি করতে হবে। জকিগঞ্জের দিকে প্রথম ব্রিজ আর সিলেটের দিকে প্রথম ব্রিজ ভেঙে দিলেই তো হয়। আবার ভাবলাম, তারা সিনিয়র ও অভিজ্ঞ। তারাই ভালো বোঝেন। এরপর সেক্টর থ্রিতে ফিরে আসলাম। আমাকে পাঠানো হলো নরসিংদী এলাকায়। আমি কাপাসিয়ায় রাজেন্দ্রপুর ক্যান্টনমেন্টের ব্রিজটা উড়িয়ে দেই। নরসিংদীতে একটা আক্রমণে সেকেন্ড বেঙ্গল সুবেদার বাশারকে হারাই। আমরা মনে করেছিলাম পাকিস্তান আর্মি নৌপথে আসছে। কিন্তু তারা স্থলপথেও একটা দল পাঠায়। দুই দলের মাঝখানে পড়ে আমাদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়। তবে আমরা তাদের লঞ্চটি ডুবিয়ে দেই। লঞ্চে যত লোক ছিল তার অর্ধেকের বেশি হতাহত হয়। কেমন একটা অসম যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে আমরা বিজয় ছিনিয়ে আনি তা এখনো ভাবতে পারি না। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ছিল প্রশিক্ষিত, পশ্চিমা অস্ত্রে সজ্জিত। আমাদের তো কিছুই ছিল না। কিন্তু, আমাদের জিততে হবে, অন্যথায় ধ্বংস হয়ে যাব- এই অদম্য শক্তিই ছিল যুদ্ধে জয়লাভের প্রেরণা শক্তি। আমাদের মধ্যে প্রবল আত্মবিশ্বাস ও দেশপ্রেম জন্ম দিতে পেরেছিলেন বঙ্গবন্ধু। যে কারণে গুটিকয় আলবদর, আলশামস ছাড়া সব শ্রেণি-পেশার মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে অত্যাধুনিক অস্ত্রের মুখে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করেছে। ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে থাকা বাঙালি সৈন্য, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, ছাত্র, শ্রমিক সবাইকে একটিমাত্র স্বপ্ন ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা’ দেখাতে পেরেছিলেন। অনুলিখন : শামীম আহমেদ

সর্বশেষ খবর