মঙ্গলবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা
কপ-২৫ লিডার্স সামিটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

বাসযোগ্য পৃথিবী গড়তে হবে আগামী প্রজন্মের জন্য

দুর্নীতি ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে

নিজামুল হক বিপুল, মাদ্রিদ (স্পেন) থেকে

বাসযোগ্য পৃথিবী গড়তে হবে আগামী প্রজন্মের জন্য

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল স্পেনের মাদ্রিদে ‘অ্যাকশন ফর সারভাইভাল : ভালনাইরেবল নেশন্স কপ-২৫ লিডার্স’ সম্মেলনে বক্তব্য দেন -পিআইডি

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তন গোটা বিশ্বের জন্য একটি কঠিন বাস্তবতা। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় এখনই কাজ শুরু করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তুলতে হবে। আমরা যদি আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হই, তাহলে তারা ক্ষমা করবে না। প্রতি মুহূর্তে আমাদের নিষ্ক্রিয়তা পৃথিবীর প্রতিটি জীবিত মানুষকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। তাই এখনই সময় কাজ করার। শেখ হাসিনা গতকাল স্পেনের মাদ্রিদে ফেরিয়া দা মাদ্রিদ (আইএফইএমএ)-এ ‘অ্যাকশন ফর সারভাইভাল : ভালনারেবল নেশন্স কপ-২৫ লিডার্স সামিট’- এ বক্তৃতা করছিলেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত জাতিসংঘ ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনের ২৫তম বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দিতে গত রবিবার এখানে আসেন। আজই তার ঢাকা রওনা হওয়ার কথা। প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে বলেন, সিভিএফ এবং ভি-২০ দক্ষিণ-দক্ষিণ ও ত্রিমুখী সহযোগিতার অসাধারণ উদাহরণ। আমরা বর্তমান সাফল্যকে আরও এগিয়ে নিতে চাই। শেখ হাসিনা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন মানুষের জীবন ও পরিবেশ, বাস্তুশাস্ত্র ও প্রাকৃতিক সম্পদের অপূরণীয় ক্ষতি করেছে। ১৯৯২ সালে আর্থ সামিটের পর থেকে আমরা গ্রিনহাউস গ্যাস হ্রাসে খুব বেশি অগ্রগতি অর্জন করতে পারিনি, এর নির্গমন এখনো অব্যাহতভাবে বেড়ে চলেছে। এ প্রবণতা পৃথিবীকে অস্থিতিশীল করে তুলছে। ঝুঁকিতে থাকা আমাদের মতো দেশগুলো এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় সীমিত ক্ষমতা এবং নির্দিষ্ট ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হই। জলবায়ুর ক্ষয়ক্ষতির জন্য আমরা তুচ্ছ বা কোনো অবদান না রাখলেও ক্ষতির ধাক্কাটা আমাদেরকেই সামলাতে হচ্ছে। এটি একটি অবিচার। অবশ্যই বিশ্বসম্প্রদায়কে বিষয়টি স্বীকার করতে হবে।

শেখ হাসিনা বলেন, ২০০৯ সালের নভেম্বরে মালেতে ফোরামের প্রথম সভার পর বৈশ্বিক জলবায়ু দৃশ্যপটের যথেষ্ট পরিবর্তন হয়েছে। দুর্ভাগ্যক্রমে এ ক্ষেত্রে ইউএনএফসিসিসির প্রক্রিয়ার অগ্রগতি খুব ধীর এবং অপর্যাপ্ত। বিশেষত আমাদের মতো দুর্বল দেশগুলোয় জাতীয়ভাবে গ্রহণ করা অভিযোজনমূলক উদ্যোগে সহায়তা করার জন্য খুব কমই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন উদ্দেশ্যে গঠন করা তহবিলগুলোয় পর্যাপ্ত মূলধনের অভাব রয়েছে। সরাসরি এবং সহজে তহবিল পাওয়ার জন্য যেসব শর্ত ও মানদ  রয়েছে, বেশির ভাগই সেসব সক্ষম দেশগুলোর পক্ষেই যায়। তিনি বলেন, সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে থাকা আমাদের মতো দেশগুলোর সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা থাকলেও ধারণার চেয়েও কম সহায়তা পাচ্ছি। এ ক্ষেত্রে একটি নতুন সিভিএফ এবং ভি-২০ ট্রাস্ট তহবিল গঠন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক বিশেষ দূত নিয়োগ সম্ভব হলে তা হবে বড় সাফল্য।

শেখ হাসিনা বলেন, নির্যাতনের শিকার হয়ে মিয়ানমার থেকে আসা ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা নানাভাবে পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরই মধ্যে পরিবেশ বিপর্যয়ের সবচেয়ে খারাপ অভিজ্ঞতাও আমাদের হয়েছে। সুতরাং জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি, এর প্রভাব এবং মোকাবিলার সক্ষমতা অভাবের ওপর ভিত্তি করে দুর্বল দেশগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়ার একটি মানদ  নির্ধারণ করতে হবে। আমরা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় নিয়মিত সমর্থন এবং আলাদাভাবে উন্নয়ন তহবিল রাখতে চাই। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বেশি দায়ী দেশগুলোর ঝুঁকি কমানোর ক্ষেত্রে চরম উদাসীনতা দেখি আমরা। এতে বৈশ্বিক জলবায়ু ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং আমাদেরকে বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। সুতরাং এই উদাসীনতার জবাব চাইতে আমাদের দ্বিধা করা উচিত নয়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, সংঘাতের চেয়ে আবহাওয়াজনিত দুর্যোগের কারণে এরই মধ্যে অনেক মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে, স্থানচ্যুত হয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং মরুকরণের মতো ধীরগতির প্রভাবের দিকেও বিশ্বের নজর কম। এই ভারসাম্যহীনতা ঠিক করতে আমাদের কাজ করা উচিত। তিনি বলেন, আমরা একটি কার্যকর অভিযোজন কৌশলের ওপর গুরুত্ব দিই, পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর অভিযোজন সক্ষমতা বাড়ানোর ওপরও গুরুত্ব দিতে চাই। তিনি বলেন, স্থান হারানো মানুষের পুনর্বাসন এবং সুরক্ষার প্রতিও বিশ্বের নজর দেওয়া উচিত। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যেসব মানুষ স্থান হারিয়েছে, বাস্তুচ্যুত হয়েছে তাদেরকে সহায়তা দিতে একটি কার্যকর কর্মকৌশল তৈরিতে আমাদের এখনই আলোচনা শুরু করা দরকার।

গতকাল শুরু হওয়া ২৫তম বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পর শুরু হয়েছে বিভিন্ন অধিবেশন। সম্মেলন চলবে ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এবারের সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়ন, লস অ্যান্ড ড্যামেজ ইস্যু, অভিযোজনসহ অন্যান্য বিষয়ে আলোচনা হবে।

দুর্নীতি ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ, মাদক ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাঁর সরকারের চলমান অভিযান অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে বলেছেন, সমাজের এ ‘অসুস্থতা’ নির্মূল করা হবে। তিনি বলেন, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর ২১ বছর ধরে দেশ শাসনকারীদের অপকর্মের কারণে অনেক ময়লা ও আবর্জনা জমে গেছে এবং মানুষের চরিত্রে ভাঙন ধরেছে। গত রোববার স্থানীয় সময় সন্ধ্যায় মাদ্রিদের হোটেল ভিলা মাগনায় তাঁর সম্মানে স্পেনে বাংলাদেশ দূতাবাস আয়োজিত এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। খবর বাসস। স্পেন ও ইউরোপের অন্যান্য দেশে বসবাসকারী প্রবাসী বাংলাদেশিসহ আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।  শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি বাংলাদেশের জনগণের একজন সার্বক্ষণিক কর্মী। আমি বিরামহীনভাবে কাজ করে যাচ্ছি, যাতে শহর ও গ্রাম উভয় এলাকার মানুষ আমাদের কাজের সুফল পেতে পারে। তিনি বলেন, এক শ্রেণির মানুষ ঘুষ-দুর্নীতিতে লিপ্ত হয়ে, সন্ত্রাস করে, লোকজনের সম্পদ ছিনিয়ে নিয়ে বিলাসী জীবন-যাপন করতে চায় এবং তারা বলতে চায় যে ‘মুই কি হনুরে’। কিন্তু আমরা চাই জনগণের মধ্যে এ ধরনের মানসিকতা থাকবে না এবং সমাজের এ অসুস্থতা নির্মূল করতে হবে।’ শেখ হাসিনা বলেন, অসৎ পথে থেকে ‘বিরিয়ানি’ খাওয়ার চেয়ে সৎ পথে থেকে ‘নুন-ভাত’ খাওয়া অনেক ভালো। আমরা জাতির জনকের কাছ থেকে এ শিক্ষা পেয়েছি। আমাদের নতুন প্রজন্মকে এ শিক্ষা দিতে হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের নাম শুনলে অন্যান্য দেশের মানুষ এখন সম্মান করে। কিন্তু তারা আগে জানত যে বাংলাদেশ হচ্ছে বন্যা, খরা, দুর্ভিক্ষ ও দুর্নীতির দেশ। তিনি আরও বলেন, আমরা সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ, মাদক ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছি। দেশের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে এ অভিযান অব্যাহত থাকবে। শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময় বাংলাদেশ পাঁচবার দুর্র্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। কিন্তু এখন সে দুর্নাম ঘুচে গেছে। প্রধানমন্ত্রী দেশের অদম্য অগ্রগতি অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন যাতে বাংলাদেশকে আর কখনো পেছন ফিরে তাকাতে না হয়। তিনি বলেন, আমরা পরিকল্পনামাফিক কাজ করে যাচ্ছি যাতে আগামী প্রজন্ম একটি সুন্দর জীবন লাভ করে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রবাসীদের অবদানের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাদের কল্যাণে তাঁর সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে।

প্রবাসীদের উৎসাহিত করতে রেমিট্যান্স পাঠালে সরকার দুই শতাংশ প্রণোদনা দিচ্ছে। বিএনপি সরকারের লাগামহীন দুর্নীতি, সন্ত্রাস, লুটপাট ও অর্থ পাচারের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ওই সময় গোটা দেশ এক নৈরাজ্যকর অবস্থা প্রত্যক্ষ করেছে। বিএনপি ওই সময়ে তাদের অপকর্মের মাধ্যমে দেশকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে গেছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, জিয়াউর রহমান, এইচ এম এরশাদ এবং খালেদা জিয়া যুদ্ধাপরাধী ও বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ক্ষমতায় বসিয়ে তাদের পুরস্কৃত করেছে। বিএনপিকে ভোট জালিয়াতির মাস্টার হিসেবে অভিহিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারা ‘হ্যাঁ-না’র রাষ্ট্রপতির নির্বাচন, ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন, ঢাকা-১০, মিরপুর এবং মাগুরা উপনির্বাচনের মতো জালিয়াতির নির্বাচন করেছে। তারাই ভোট জালিয়াতির মাস্টার। আবার এখন তারা নীতিকথা শোনাচ্ছে! বিগত এক দশকে বাংলাদেশের ব্যাপক উন্নয়নের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত এবং বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের জিডিপির হার ৮ দশমিক ১৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছে এবং দারিদ্র্যের হার ৪১ শতাংশ থেকে ২১ শতাংশে নেমে এসেছে। আমরা প্রত্যেক জায়গায় বিদ্যুৎ পৌঁছানোর লক্ষ্যে কাজ করছি এবং আমরা চাই যে, একটি বাড়িও অন্ধকারে থাকবে না। তিনি বলেন, উন্নয়নের এ ধারা অব্যাহত রেখে আমরা ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী এবং ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করব।

স্পেনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হাসান মাহমুদ খন্দকার অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন। এ সময় মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাবউদ্দিন।

প্রধানমন্ত্রী কপ-২৫’র রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দিতে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে রোববার বিকালে এখানে পৌঁছেন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর