শিরোনাম
বুধবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

চাকা ঘোরার আগেই চাঁদা

জুলকার নাইন, গোলাম রাব্বানী ও শফিকুল ইসলাম সোহাগ

চাকা ঘোরার আগেই চাঁদা

সড়কে গাড়ির চাকা ঘুরলেই গুনতে হয় চাঁদা। মহাখালী, ফুলবাড়িয়া, গাবতলী, সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালসহ রাজধানীর পরিবহনব্যবস্থায় একচ্ছত্র আধিপত্য চাঁদাবাজদেরই। তাদের ইচ্ছাতেই ঘুরছে লোকাল ও আন্তজেলা পরিবহনের চাকা। পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের নামে কয়েকজন চালাচ্ছেন এই চাঁদাবাজি। অবশ্য সাম্প্রতিক শুদ্ধি অভিযানের পর চাঁদাবাজির ভাগাভাগি নিয়ে চলছে অস্থিরতা। শুদ্ধি অভিযানে নেতা গ্রেফতার হওয়ার পর কে নেবেন চাঁদার টাকা, তা নিয়ে ভিতরে ভিতরে তীব্র প্রতিযোগিতা চলছে। দ্বিতীয় সারির নেতারা চলে এসেছেন সামনে। চাঁদাবাজের চেহারা ও হাতের পরিবর্তন হলেও টাকা আদায় চলছে আগের মতোই। পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠন ও ট্রাফিক পুলিশ-সংশ্লিষ্টদের তথ্যানুসারে, ঢাকার সায়েদাবাদ, মহাখালী, গুলিস্তান, ফুলবাড়িয়া, মিরপুর, আজিমপুর, মতিঝিল-কমলাপুর ও গাবতলী বাস টার্মিনাল ও ভাসমান মিলে ১৫ হাজারের বেশি বাস চলছে। এর মধ্যে সায়েদাবাদ টার্মিনাল থেকে চলে ৩ হাজার ৫০০, মহাখালী থেকে ২ হাজার ৫০০, গুলিস্তান থেকে ১ হাজার ২০০, মিরপুর থেকে ৭০০, আজিমপুর থেকে ৫০০, মতিঝিল-কমলাপুর থেকে ৪০০, গাবতলী থেকে ৩ হাজার ২০০, ভাসমান আরও ১ হাজার ৩০০ গাড়ি চলে। এ ছাড়া গুলিস্তান-ফুলবাড়িয়া বাস টার্মিনাল থেকে ৩৪টি কোম্পানির ১ হাজার ৬৮৮টি বাস বিভিন্ন রুটে চলে। প্রতিটি গাড়ি থেকে জিপি (গেট পাস) নামে নেওয়া হয় চাঁদা। এ চাঁদা আদায় হচ্ছে মালিক সমিতি, ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতি, হরতাল ভাঙচুর ভর্তুকি, ইফতার, অফিস ক্রয়, কমিউনিটি পুলিশ, বোবা ফান্ড (কমন ফান্ড) সুপারভাইজার, কাঙালি, লাঠিবাহিনীর নামে। গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যানুসারে, গুলিস্তান-ফুলবাড়িয়া স্টপওভার বাস টার্মিনালে রুটগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাস ডি-লিংক পরিবহনের। তাদের গাড়ি ১৪০টি। প্রতি গাড়িতে চাঁদা দিতে হয় ১ হাজার ১০০ টাকা। সব কটি গাড়ির মোট চাঁদার পরিমাণ ১ লাখ ৫৪ হাজার টাকা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আজমেরী পরিবহনের গাড়ি। তাদের ১৩০টি গাড়ির প্রতিটির ১ হাজার ২০০ হিসাবে দিনে চাঁদার পরিমাণ ১ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। প্রভাতী বনশ্রী কোম্পানির বাস রয়েছে ১২০টি। তাদের বাসপ্রতি চাঁদার পরিমাণ ১ হাজার ৪০০ হিসাবে দিনে চাঁদা দিতে হয় ১ লাখ ৬৮ হাজার টাকা। সুপ্রভাত পরিবহনের ১৪০টি বাস থেকে ওঠে ১ লাখ ৯৬ হাজার টাকা। গুলিস্তান-ফুলবাড়িয়া বাস টার্মিনালের অন্তর্ভুক্ত আরও ৩১টি পরিবহনকে এভাবে চাঁদা দিতে হয়। তালিকা থেকে দেখা যায়, প্রতিদিন গ্রামীণ সেবা পরিবহনের ৪৫টি বাসের চাঁদা ৪৯ হাজার ৫০০, শুভযাত্রার (মানিকগঞ্জ) ৫০টি বাস থেকে ৬০ হাজার, গাজীপুর পরিবহনের ৫০টি বাস থেকে ৫০ হাজার, ঢাকা পরিবহনের ৪০টি বাস থেকে ৪৪ হাজার, স্কাইলাইনের ৩৫টি বাস থেকে ৪৫ হাজার ৫০০, এয়ারপোর্ট-বঙ্গবন্ধু এভিনিউ পরিবহনের ১১০টি বাস থেকে ১ লাখ ৪৩ হাজার, দিশারী ও তানজিল পরিবহনের ৭০টি বাস থেকে মোট ৫৬ হাজার টাকা চাঁদা তোলা হয় প্রতিদিন। ইটিসি ও ইউনাইটেড পরিবহনের ৬০টি বাস থেকে ৬০ হাজার, সময় নিয়ন্ত্রণের ১৫টি বাস থেকে ১৫ হাজার, বিহঙ্গ পরিবহনের ৮০টি বাস থেকে ৪৮ হাজার, ভিক্টর পরিবহনের ২০টি বাস থেকে ২৪ হাজার, সাভার পরিবহনের ৩৫টি বাস থেকে ৪৫ হাজার ৫০০, স্বাধীন পরিবহনের ৬৫টি বাস থেকে ৯২ হাজার, প্রচেষ্টা পরিবহনের ৪৫টি বাস থেকে ৯২ হাজার টাকা তোলা হয়। এ ছাড়া আরাম পরিবহনের ৪৬টি বাস থেকে ৪৬ হাজার, যুব দোহার পরিবহনের ১৭টি বাস থেকে ১৮ হাজার ৭০০, ডিএনকে পরিবহনের ২০টি বাস থেকে ২২ হাজার, এম মল্লিক পরিবহনের ৩০টি বাস থেকে ২৪ হাজার, যমুনা ও দ্রুত পরিবহনের ৫৫টি বাস থেকে ৭৭ হাজার, নগর পরিবহনের ৪০টি বাস থেকে ৫২ হাজার, ডিএম ও এসএস পরিবহনের ৮০টি বাস থেকে ৮০ হাজার, বৈশাখী পরিবহনের ২০টি বাস থেকে ২০ হাজার, দীঘিরপাড় ট্রান্স ও টুঙ্গিপাড়া ট্রান্সের ৫০টি বাস থেকে ৩২ হাজার, ইমাদ ও দোলা পরিবহনের ২০টি বাস থেকে ১০ হাজার এবং বিআরটিসির ৬০টি বাস থেকে ১৮ হাজার টাকা নেওয়া হয়। প্রতিদিন এই একটি টার্মিনালের ১ হাজার ৬৮৮টি বাস থেকে চাঁদার পরিমাণ দাঁড়ায় ১৮ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। এর মধ্যে প্রতি মাসে ৩ কোটি ৩০ লাখ ৯৪ হাজার টাকা মালিক সমিতির ফান্ডে জমা পড়ে। ঢাকা সড়ক নামে প্রতি মাসে ৪০ লাখ ৫১ হাজার ও ইফতারের নামে প্রতি মাসে ১০ লাখ টাকা ও কমন ফান্ড নামে ১ কোটি ২ লাখ টাকা জমা পড়ছে। কিন্তু এসব টাকার কোনো হদিস মালিক সমিতির গুটিকয় ছাড়া কেউ জানেন না। গুলিস্তানের পর প্রেস ক্লাবের সামনে ১০ টাকা, শাহবাগে ১০ টাকা, ফার্মগেটে ৪০ টাকা, মহাখালীতে ১০ টাকা, বনানীতে ১০ টাকা, শ্যাওড়ায় ১০ টাকা, খিলক্ষেতে ১০ টাকা, আবদুল্লাহপুরে ৪০ টাকা চাঁদা দিতে দেখা যায়। একইভাবে টাকা আদায় হয় গাবতলী, মহাখালী ও সায়েদাবাদ টার্মিনালে। অভিযোগ পাওয়া যায়, সায়েদাবাদ টার্মিনাল হয়ে যাওয়া সায়েদাবাদ, খিলগাঁও, পোস্তগোলা ও সাইনবোর্ড এলাকা থেকে উত্তরা, সাভার, গাবতলী ও মোহাম্মদপুরে চলা অনাবিল, রাইদা, ছালছাবিল, তরঙ্গ, মিডলাইন, বাহন ও লাব্বাইক পরিবহনকে প্রতিদিন বাসপ্রতি মালিক সমিতির জন্য গুনতে হয় ১২০ থেকে ২০০ টাকা করে। যেসব কোম্পানির বাসের সংখ্যা ৫০-এর নিচে, সেসব কোম্পানিকে বাসপ্রতি ১২০ টাকা হারে প্রতিদিন শাহবাগে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির অফিসে গিয়ে চাঁদা দিয়ে আসতে হয়। এ ছাড়া সায়েদাবাদ টার্মিনালের মালিক-শ্রমিকদের নেতাদের জন্য আরও ৫০ টাকা হারে চাঁদা দিতে হয়। টার্মিনালের পার্কিং বাবদ সিটি করপোরেশনের নামে আরও ৪০ টাকা হারে চাঁদা আদায় করা হয় গোলাপবাগ সিগন্যালে। যেসব কোম্পানির গাড়ির সংখ্যা ৫০-এর বেশি, সেসব কোম্পানিকে বাসপ্রতি ২০০ টাকা করে চাঁদা দিতে হয় মালিক সমিতিকে। রুট পারমিট এবং কোম্পানি বাতিল হওয়ার ভয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনাবিল, রাইদা, ছালছাবিল, তরঙ্গ, মিডলাইন, বাহন ও লাব্বাইক পরিবহনের কয়েকজন মালিক জানান, এই চাঁদা না দিলে ওইসব পরিবহন কোম্পানিকে সিজ (দখল) করে নেন মালিক সমিতির নেতারা। চাঁদা আদায় হয় কোনো খাত উল্লেখ না করেই। পরিবহন কোম্পানিগুলোও তাদের নিজস্ব বিল-ভাউচারে খাতের স্থান ফাঁকা রেখেই শুধু ব্যয়ের টাকা তুলে ধরে। মালিক সমিতির হুঁশিয়ারি রয়েছে, কোথাও কোনোভাবে উল্লেখ করা যাবে না।

অবশ্য গত ২৬ নভেম্বর পরিবহন মালিক ও কোম্পানিগুলোকে ‘অতীব জরুরি’ নামে একটি চিঠি দেন ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ। সেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘মালিক সমিতি ও শ্রমিক ইউনিয়ন পরিচালনার জন্য খুবই সীমিত আকারে অর্থ নির্ধারণ করা হয়। এর বাইরে কোনো অর্থ গাড়ি থেকে আদায় করা যাবে না।’

জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি সংসদ সদস্য মসিউর রহমান রাঙ্গা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সড়কে চাঁদাবাজি নতুন কিছু নয়। সড়ক নির্মাণের পর থেকে চাঁদাবাজি চলে এসেছে। যতই দিন যাচ্ছে এর মাত্রা বেড়ে চলেছে। এর একটা সুরাহা হওয়া উচিত।’ তিনি বলেন, ‘রাজধানী থেকে যখন একটি গাড়ি স্টার্ট করে সেখানে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ চাঁদা দেবে। এটা ঠিক আছে। এই বাস বা ট্রাকটিকে শেষ গন্তব্যে পৌঁছা পর্যন্ত যেন আর কোনো চাঁদা দিতে না হয়। এমনিভাবে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ঢাকা বা যে জেলাতেই যাক না কেন যেখান থেকে ছাড়বে সেখানেই শুধু নির্ধারিত পরিমাণ চাঁদা দেবে। কিন্তু বর্তমানে অবস্থা এমন হয়েছে যে, প্রতিটি জেলায় পরিবহনটি ঢুকলেই চাঁদা দিতে হয়। এ অবস্থার পরিবর্তন হওয়া দরকার। চাঁদাবাজি বন্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে উদ্যোগ নিয়েছেন সেজন্য তাঁকে ধন্যবাদ।’ জেলায় জেলায় চাঁদাবাজি বন্ধ করার জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানান মসিউর রহমান রাঙ্গা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর