বুধবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

পণ্য পরিবহনে রেট কার্ড

নিজস্ব প্রতিবেদক

ট্রাক রাস্তায় নামালেই ‘রেটকার্ড’ ধরে দিতে হয় চাঁদা। বিভিন্ন স্পটে চাঁদাবাজরা নিজেদের মতো করে তৈরি করে নিয়েছে চাঁদার হার। এটিই পরিবহন খাতে রেটকার্ড নামে পরিচিত। একেক স্পটে রেট কার্ডে চাঁদার পরিমাণ একেক রকম। চাঁদার টাকা পকেটে রেখেই রাস্তায় নামতে হয়। চাঁদা না দিলে ট্রাকের চাকা ঘুরে না। ট্রাকের চাঁদাবাজির বিষয়ে জানতে চাইলে আক্ষেপ নিয়ে এ কথাগুলো বলেন রংপুরের একজন ট্রাক মালিক। তিনি জানান, প্রত্যেক মহাসড়কের ২০ থেকে ৩০ স্পটে চাঁদা দিতে হয়। এর মধ্যে রংপুর-ঢাকা মহাসড়কে প্রায় ১৫ থেকে ২০ স্পটে চাঁদা দিতে হয়। এর বাইরেও রয়েছে-ভ্রাম্যমাণ ও মাসিক চাঁদা। এমনকি গভীর রাতেও হঠাৎ ট্রাক থামিয়ে চাঁদা আদায় করে পুলিশ। একটি ট্রাক রংপুর থেকে ঢাকায় যেতে ৩/৪ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। মাসে প্রায় ৫০ থেকে ৭০ হাজার টাকা ব্যয় হয় চাঁদার পিছনেই। ঈদের সময় তা বহুগুণ বেড়ে যায়। এই চাঁদাবাজি নিয়ে পাল্টাপাল্টি অভিযোগও রয়েছে। পুলিশ বলছে, মালিক শ্রমিক সংগঠনগুলো চাঁদাবাজি করছে। আর মালিক-শ্রমিক সংগঠনের নেতারা বলেন, পুলিশ নিরাপত্তা তল্লাশির নামে চাঁদাবাজি করে। এ বিষয়ে হাইওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি তানভীর হায়দার চৌধুরী জানান, চাঁদাবাজির বিষয়ে আমরা জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করছি। পুলিশের কোনো সদস্য যদি চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত থাকে এবং অভিযোগ প্রমাণিত হয় তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জানা গেছে, রাজধানী থেকে ইউনিয়ন পর্যন্ত চাঁদা আদায়কারী চক্রের জাল ছড়িয়ে রয়েছে। জাতীয় মহাসড়ক, আঞ্চলিক মহাসড়ক, পৌর এবং উপজেলা সড়ক, ফেরিঘাট, ট্রাক টার্মিনাল, মালিক সমিতি ও শ্রমিক ইউনিয়ন নিয়ন্ত্রিত এলাকায় প্রতিদিন চাঁদা আদায় হচ্ছে। চাঁদার টাকা মালিক-শ্রমিক সংগঠন, হাইওয়ে পুলিশ এবং থানা পুলিশের কাছে চলে যায়। ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, প্রতিটি ট্রাককে প্রত্যেক মহাসড়কে অন্তত ৩০টি স্থানে চাঁদা দিতে হয়। তাদের তথ্য মতে, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিন ঢাকায় আসা-যাওয়া করে প্রায় ১০ হাজার ট্রাক। কোরবানির ঈদের সময় তা আরও ৫-৭ হাজার বেড়ে যায়। বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির নেতাদের অভিযোগ- ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-রংপুর, খুলনা-যশোর, ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-বরিশালসহ বিভিন্ন রুটে হাইওয়ে পুলিশ নিরাপত্তা তল্লাশির নামে চাঁদাবাজি করে। অনুসন্ধানে রংপুর থেকে চট্টগ্রাম আসা-যাওয়ার পথে ট্রাকের চাঁদাবাজির ভয়াবহ তথ্য পাওয়া গেছে। এ পথে পুলিশকে ২২ স্পটে চাঁদা দিতে হয়। আর শ্রমিক সংগঠনগুলোকে চাঁদা দিতে হয় ২০/২৫ স্পটে। পুলিশের ২২ স্পটের মধ্যে রংপুরের বড় দরগাহ ২০০ টাকা, পলাশবাড়ী, ফাসিতলায় ১০০ টাকা, মোকামতলা ৫০ টাকা, ফুটভিলেজ ১০০ টাকা, সিরাজগঞ্জ মোড় ১০০ টাকা, যমুনা সেতু ২০০ টাকা, চন্দ্রা ১০০ টাকা, গাজীপুর বাইপাস থেকে মদনপুর পর্যন্ত ৪/৫ স্থানে ২০-৩০ টাকা করে দিতে হয়। এ ছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন স্পটের চাঁদা তো রয়েছেই। দাউদকান্দি ব্রিজের পরে ইলিয়টগঞ্জ এলাকায় কাগজপত্র চেক করার নামে ১০০০/১৫০০ টাকা চাঁদা তোলা হয়। এ ছাড়া কুমিল্লায় দিতে হয় ১০০/২০০ টাকা, ফেনী হাইওয়েতে দিতে হয় ২০০/৫০০ টাকা, বড় কুমিড়া ১০০/২০০ টাকা, চট্টগ্রাম সিটি গেটে ১০০/২০০ টাকা, চট্টগ্রাম জিইসি মোড় ২০০/৫০০ টাকা, চট্টগ্রাম অলংকার মোড়, কর্ণফুলীর দুই পাশে ৪০০ টাকা, কর্ণফুলী ব্রিজের পরে ৪০০ টাকা, এ ছাড়াও পটিয়ায় টাকা দিতে হয়। সব মিলে প্রায় এক দিনেই সাড়ে তিন হাজার থেকে চার হাজার টাকা দিতে হয় চাঁদা। মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলোকে চাঁদা দিতে হয় ২০/২৫ স্পটে। এর মধ্যে রংপুর ট্রাক স্ট্যান্ড ২০ টাকা, বড়দরগাহ ৫০ টাকা, পলাশবাড়ী ৫০ টাকা, গোবিন্দগঞ্জ ৭০ টাকা, বগুড়া ১৫০ টাকা, চান্দাইকোনো ৫০ টাকা, গাবতলী ১০০ টাকা, রাজধানীর বিভিন্ন স্পট, পটিয়া ২০০ টাকা। মাসিক চাঁদা দিতে হয় রংপুর, বগুড়া, টাঙ্গাইলসহ আরও কয়েকটি স্থানে। এ ছাড়া সারা দেশে বাস-ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান থেকে মালিক সমিতি ৪০ টাকা, শ্রমিক ইউনিয়ন ২০ টাকা এবং শ্রমিক ফেডারেশন ১০ টাকাসহ ৭০ টাকা চাঁদা আদায় করা হয়। এটি নিয়মিত এবং ঘোষিত চাঁদা। কোথাও কোথাও তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি টাকা জোর করে তোলা হয়। ড্রাইভারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রংপুর থেকে ঢাকা আসা-যাওয়ার পথে পুলিশ ও শ্রমিক সংগঠনগুলোকে প্রায় ১৫/২০ স্পটে চাঁদা দিতে হয়। এর মধ্যে রংপুর, মিঠাপুকুর, শঠিবাড়ী, বড়দরগাহ, পীরগঞ্জ, পলাশবাড়ী, মোকামতলা, গোবিন্দগঞ্জ, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ মোড়, টাঙ্গাইল, মির্জাপুর, চন্দ্রা, সাভার, গাবতলী-আমিনবাজার। এ মহাসড়কের ছোট ছোট কিছু বাজারেও চাঁদা আদায় করা হয়। বিশেষ করে যে বাজার থেকে ট্রাকে মালামাল তোলা হয় সেখানেও চাঁদা দিতে হয়। ড্রাইভাররা জানান, মোকামতলা পার হলে চাঁদার পরিমাণ বেড়ে যায়। মাসিক চাঁদা দিতে হয় রংপুর, বগুড়া, টাঙ্গাইলসহ আরও কয়েকটি স্থানে। এ তো শুধু ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের চিত্র। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার চিত্র আরও ভয়াবহ। বিশেষ করে রাজধানীর তিনটি ট্রাক টার্মিনালে চাঁদার পরিমাণ বাড়ছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর