বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

নিয়োগ নিয়ে ইসিতে উত্তেজনা, পাল্টাপাল্টি

গোলাম রাব্বানী

আবারও প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও চার নির্বাচন কমিশনারের দ্বন্দ্বের বিষয়টি প্রকাশ্য রূপ পেয়েছে কমিশনের সভায়। ইসি সচিবালয়ের কর্তৃত্ব ও নিয়োগের অনিয়ম নিয়ে নির্বাচন কমিশনের বৈঠকে উত্তেজনা ছড়িয়েছেন নির্বাচন কমিশনাররা। গতকাল নির্বাচন কমিশনের ৫৬তম সভায় ক্ষুব্ধ চার নির্বাচন কমিশনার কড়া ভাষায় বক্তব্য দিয়েছেন। এক পর্যায়ে একজন কমিশনার পদত্যাগেরও হুমকি দেন বলে বৈঠকসূত্র জানিয়েছেন। তবে বৈঠকজুড়ে চুপচাপ ছিলেন সিইসি। বলেছেন, পরে এ নিয়ে নিজেরা বৈঠক করবেন। বিকাল ৩টায় সিইসির সভাপতিত্বে কমিশন সভা শুরু হয়ে চলে সোয়া ৫টা পর্যন্ত। সিইসি ও সচিবের সমালোচনা করে ঘণ্টাব্যাপী বক্তব্য দেন চার কমিশনার। এর আগে চার কমিশনারের দেওয়া ইউও নোটের (আনঅফিশিয়াল নোট) জবাব নিয়েও সমালোচনা করেন তারা। তাদের বক্তব্যে সিইসি ও ইসির সিনিয়র সচিবের কার্যক্রম নিয়েও অভিযোগ তোলেন। কমিশন বৈঠকসূত্রে জানা গেছে, নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার, রফিকুল ইসলাম, কবিতা খানম ও শাহাদাত হোসেন চৌধুরী সবাই কথা বলেছেন একই বিষয়ে। সবার বক্তব্য ছিল লিখিত। বিভিন্ন বিষয়ে চার কমিশনারকে অপমান করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ তোলেন তারা। পদত্যাগের হুমকি দিয়ে সভায় একজন কমিশনার বলেন, ইসি সচিবালয়ের বর্তমান স্বেচ্ছাচারিতা ও মিথ্যাচারের বিহিত না হলে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব পালন করা প্রায় অসম্ভব। অন্য একজন কমিশনার বলেন, চার কমিশনারের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে সিইসি ইসির একজন কর্মকর্তার স্বাক্ষরে চিঠি দিয়ে যে জবাব দিয়েছেন, তার ভাষা আপত্তিকর। একজন কমিশনার বলেন, সিইসি অন্য কমিশনারদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে আইন অনুযায়ী কমিশনকে এগিয়ে নেবেন এটাই তারা প্রত্যাশা করেন। সিইসি বলেছেন, এসব বিষয় নিয়ে আমরা (কমিশনাররা) নিজেরা আলাপ করব। এখন এজেন্ডাভিত্তিক আলোচনা করুন। পরে কমিশন সভার পাঁচ এজেন্ডা নিয়ে আলোচনা হয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের কিছু বক্তব্য কমিশন সভায় তুলে ধরেছি। আমরা কমিশনাররা পরে আবার বসব।’ তবে বৈঠকের বিষয়ে মন্তব্য করতে চাননি ইসির সিনিয়র সচিব মো. আলমগীর। তিনি বলেন, ‘বৈঠকের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে কথা বলার কোনো সুযোগ নেই। এটা একেবারেই গোপনীয় বিষয়, ইন্টারনাল বিষয়।’ কমিশনে বিভেদ আছে কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কাজ করতে গেলে অনেক বিষয়ে দ্বিমত থাকতে পারে। তবে আপনারা যদি এটাকে ইসির মধ্যে বিভক্তি বলতে চান তাহলে বলব, এ ধরনের কিছু হয়নি। কমিশনের সব কাজ সুষ্ঠুভাবে চলছে। বলতে পারেন মতপার্থক্য আছে কিন্তু বিভক্তি নেই।’ সিইসি ও কমিশনারদের মধ্যকার দূরত্বে সচিব হিসেবে বিব্রত কিনা? প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সচিব হিসেবে বিব্রত হওয়ার সুযোগ নেই। আইন-কানুন, রুলস রেগুলেশন অনুযায়ী আমি ও আমার কর্মকর্তারা কাজ করি। এখানে বিব্রত বা দ্বন্দে¦র সুযোগ নেই।’ সভায় কমিশনারদের কেউ কেউ দায়িত্ব ছাড়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন কিনা? এমন প্রশ্নে সচিব বলেন, ‘এটা কমিশন সভার ইন্টারনাল ও গোপনীয় বিষয়। এ নিয়ে কিছু বলা যাবে না।’ ইসি সচিব জানান, সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ আইন, ২০১৯-এর খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। এটা এখন ভেটিংয়ের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। ক্ষুব্ধ চার কমিশনার : সভায় একজন কমিশনার তার বক্তব্যে বলেন, ‘নিয়োগ নিয়ে আমার এক ইউও নোটের (আনঅফিশিয়াল নোট) বিষয়ে কমিশন সচিবালয় থেকে যে উত্তর দেওয়া হয়েছে তা নির্বাচন কমিশনারদের চরিত্রহননের অপচেষ্টা মাত্র। চিঠির এ উত্তর নির্বাচন কমিশনারদের প্রতি অপমানজনক।’ ওই কমিশনার বলেন, ‘চিঠিতে নির্বাচন কমিশনারদের সুপারিশকৃত প্রার্থীরা নির্বাচিত না হওয়ায় তাদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন প্রকার প্রশ্ন উত্থাপিত হয়- সচিবালয়ের এ বক্তব্য নির্বাচন কমিশনারদের অপমান করা এবং নির্বাচন কমিশনের কর্তৃত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ ও চ্যালেঞ্জ করার শামিল।’ তিনি বলেন, ‘এক বছরের বেশি সময় আগের এক নির্দেশ যথাযথভাবে পরিপালিত না হওয়ায় যৌক্তিকভাবেই আমি কমিশন সচিবালয়ে স্বেচ্ছাচারিতা চলে আসছে বলে উল্লেখ করেছি। কিন্তু গত ২৫ নভেম্বর সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব কমিশনের অনুমোদন ছাড়া কোন কর্তৃত্ববলে প্রেস কনফারেন্স করে নির্বাচন কমিশনারদের প্রতিপক্ষ হিসেবে নিজেকে জাহির করলেন তা বোধগম্য নয়।’ এমন অবস্থা চলতে থাকলে দায়িত্ব পালন সম্ভব নয় জানিয়ে এই নির্বাচন কমিশনার বৈঠকে বলেন, নির্বাচন কমিশন ও কমিশন সচিবালয়ের মধ্যে সমন্বয় না থাকলে কোনো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তবে সচিবালয়ের বর্তমান স্বেচ্ছাচারিতা ও মিথ্যাচারের বিহিত না হলে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করা প্রায় অসম্ভব।

চার নির্বাচন কমিশনারের ইউও নোটের বিষয়ে ইসি সচিবালয়ের জবাবের সমালোচনা করে আরেক নির্বাচন কমিশনার বলেন, উত্তরপত্রটিতে সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের সরাসরি কমিশনারদের মুখোমুখি করার একটা প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। তিনি বলেন, কমিশন সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের অনুস্বাক্ষরসহ অত্যন্ত আপত্তিকর ভাষায় যে উত্তর দেওয়া হয়েছে তা সব কমিশনারকে হতবাক করেছে। কেননা উল্লিখিত পত্রে কমিশনারদের প্রদত্ত ইউও নোটকে সম্পূর্ণরূপে পাশ কেটে অপ্রাসঙ্গিক কিছু বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে। নিয়োগ প্রসঙ্গে এই কমিশনার বলেন, নিয়োগসংক্রান্ত বিষয় যথাযথ নিয়ম অনুসরণ না করার বিষয়টি আড়াল করে নির্বাচন কমিশনারদের হেয় করার প্রয়াস মাত্র; যা মোটেই কাক্সিক্ষত নয়। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনের ভাবমূর্তি নষ্ট হলে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক সব কর্মকা- প্রশ্নবিদ্ধ হবে। এই কমিশনার বলেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার কমিশনের সভাপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেছেন। নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। সাংবিধানিক এ প্রতিষ্ঠানটি সব সময় সংবিধানসহ বিদ্যমান সব আইন ও বিধি অনুযায়ী পরিচালিত হবে এটাই কাম্য। সিইসি সব নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে বিদ্যমান সব আইন অনুসরণ করে কমিশনকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন- এমন প্রত্যাশা করেন এই কমিশনার। একইভাবে আরও দুই কমিশনার সচিবালয়ের কাজ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন।

সর্বশেষ খবর