শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

রেকর্ড ভোটে লন্ডনের ক্ষমতায় জনসন, লেবার পার্টির বিপর্যয়

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

রেকর্ড ভোটে লন্ডনের ক্ষমতায় জনসন, লেবার পার্টির বিপর্যয়

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রথমবারের মতো যুক্তরাজ্যের নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের মুখে পড়ল ব্রিটেনের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল লেবার পার্টি। বিপরীতে সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের পর বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের নেতৃত্বে বিশাল জয় পেল কট্টরপন্থি কনজারভেটিভ পার্টি। সরকার গঠন করতে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য ৩২৬ আসনে জয়ের প্রয়োজন হলেও কনজারভেটিভরা জয় পেয়েছে ৩৬৪ আসনে। গত নির্বাচনের চেয়েও ৪৭টি আসন বেশি পেয়েছে বরিস জনসনের দল। অন্যদিকে টানা চার নির্বাচনে জয়ের মুখ না দেখা লেবার পার্টির জনসমর্থন কমেছে ভয়াবহ হারে। গত নির্বাচনের চেয়ে ৫৯টি আসন হারিয়ে লেবার পার্টি পেয়েছে ২০৩ আসন। অবশ্য নির্বাচনের ফল প্রকাশের আগেই বুথ ফেরত জরিপে লেবার পার্টির ধরাশায়ী হওয়ার এ ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল স্পষ্টভাবেই। তাই ফল প্রকাশের আগেই লেবার পার্টির নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন জেরেমি করবিন। বৃহস্পতিবার দিনভর ইংল্যান্ড, ওয়েলস, স্কটল্যান্ড ও উত্তর আয়ারল্যান্ডের মোট ৬৫০টি সংসদীয় আসনে ভোটগ্রহণ হয়। গতকাল শুক্রবার সকালে ৬৪৯টি আসনের ফলাফল পাওয়া যায়। এর মধ্যে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টি ৩৬৪টি, লেবার পার্টি ২০৩টি আসন পায়। ঘোষিত ফলাফলে দেখা গেছে, সব দলের ভোটের হার বাড়লেও সমর্থন খুইয়েছে কেবল লেবার পার্টি। ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির ভোট এবার গড়ে ১.২ শতাংশ বেড়েছে, অন্যদিকে লেবারের ভোট গড়ে ৭.৮ শতাংশ কমেছে। ব্রিটেনের তৃতীয় বৃহৎ রাজনৈতিক দল লিবারেল ডেমোক্র্যাটসের ভোটের হার সবচেয়ে বেশি ৪.২ শতাংশ বাড়লেও আসন কমে হয়েছে ১১টি। এ দলের নেতা জো সুইনসন নিজেই নির্বাচিত হতে পারেননি। অন্যদিকে স্কটল্যান্ডে এবারের নির্বাচনে বড় জয় পেয়েছে স্থানীয় রাজনৈতিক দল স্কটিশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি (এসএনপি)। ৫৯টি আসনের মধ্যে ৪৮টিই জিতে নিয়েছে এসএনপি। যা গতবারের চেয়ে ১৩টি বেশি। এবার ৪৫.১ শতাংশ ভোট পড়েছে এসএনপির পক্ষে, যা আগেরবারের চেয়ে ০.৮ শতাংশ বেশি। যুক্তরাজ্যে পাঁচ বছর পর পর সাধারণ নির্বাচন হওয়ার কথা। কিন্তু ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার (ব্রেক্সিট) ঘটনা প্রবাহের উত্তাপে গত পাঁচ বছরেরও কম সময়ে এটি দেশটিতে তৃতীয় সাধারণ নির্বাচনের ঘটনা। ব্রেক্সিট বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়ে ক্ষমতায় আসা সংসদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় এবং দলীয় আইনপ্রণেতাদের বিরোধিতার কারণে গত তিন বছরেও তা কার্যকর করতে পারেনি ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভরা। তাই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় ফিরতে প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন এই নির্বাচনের ডাক দিয়েছিলেন। নির্বাচনের আগেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছিলেন ক্ষমতায় ফিরলে ৩১ জানুয়ারি ব্রেক্সিট কার্যকর করবেন তিনি। গতকাল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পর তাই বরিস জনসনের স্পষ্ট ঘোষণা, আগামী মাসে ব্রিটেনকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের করে আনার ম্যান্ডেট দেবে এই জয়। ব্রিটেনকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের করে আনার বিষয়ে আর কোনো ‘যদি, কিন্তু’ নেই। ভোটারদের আস্থার প্রতিদান দিতে রাত-দিন কাজ করবেন বলেও ঘোষণা দিয়ে বরিস জনসন বলেন, মানুষ পরিবর্তন চায়। তাদের হতাশ করা উচিত নয়, হতাশ করব না। অন্যদিকে, নির্বাচনে ভরাডুবির ইঙ্গিত আসার পরই ভবিষ্যতে কোনো নির্বাচনে দলকে নেতৃত্ব দেবেন না বলে ঘোষণা দেন যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন। তিনি বলেন, ফলাফল নিয়ে লেবার দলকে ভাবতে হবে। ভবিষ্যতে দল কীভাবে চলবে তা নিয়ে নতুন করে নীতি গ্রহণ করতে হবে। তিনি বলেন, ফলাফল হতাশাজনক হলেও এবারের নির্বাচনে লেবার যে ইশতেহার দিয়েছে সেটি আশাজাগানিয়া, কল্যাণমূলক এবং বৈষম্য দূরীকরণের জন্য। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বিশ্ব যে হুমকির মুখে পড়েছে তা মোকাবিলার জন্য অর্থনীতি ঢেলে সাজানোর কথা বলেছে লেবার। এসব ইশতেহার মানুষ পছন্দও করেছে। তবে ফলাফলের ইঙ্গিত থেকে এটা স্পষ্ট, সব ছাপিয়ে মানুষের মনে ব্রেক্সিট ইস্যু আধিপত্য বিস্তার করেছে। ইজিলিংটন ইস্ট আসনের এমপি হিসেবে দায়িত্ব অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়ে করবিন বলেন, পার্লামেন্ট ও পার্লামেন্টের বাইরে মানুষের অধিকার আদায় এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সক্রিয় থাকব। ১৯৮৩ সাল থেকে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্ব করা জেরেমি করবিনই ছিলেন লেবার পার্টির প্রধান নেতা। ২০১৫ সালে লেবার দলের নেতা নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে করবিন যুক্তরাজ্যে বামধারার রাজনীতির নায়ক হিসেবে আবির্ভূত হন। ২০১৭ সালের নির্বাচনে পানি, বিদ্যুৎ, রেলওয়েসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রীয় মালিকানায় ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নয়নে অভিনব ইশতেহার ঘোষণা করে তিনি রাজনীতিতে নতুন চমক সৃষ্টি করেন। ৭১ বছর বয়সী করবিন এবারের নির্বাচনেও লন্ডনের ইজলিংটন আসনে বড় ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন। তার প্রাপ্ত ভোট ৩৪ হাজার ৬০৩। আর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী লিবারেল ডেমোক্র্যাট দলের প্রার্থী নিক ওয়েইলিং পেয়েছেন ৮ হাজার ৪১৫ ভোট। এবারের নির্বাচনে করবিন আরও উদার ইশতেহার ঘোষণা করেছিলেন।

নিজ আসনে চ্যালেঞ্জের জয় বরিস জনসনের : আক্সব্রিজ অ্যান্ড রুইসলিপ আসনে কনজারভেটিভ দলের নেতা ও প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের জয় নিয়ে ছিল সংশয়। কারণ ২০১৬ সালের গণভোটে লন্ডনের অদূরে এই আসনের ভোটারদের ব্রেক্সিটের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছিলেন। পরের বছর ২০১৭ সালে কট্টর ব্রেক্সিটপন্থি প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন জিতেছিলেন মাত্র ৫ হাজার ৩৪ ভোটের ব্যবধানে। এসব কারণে জনসনকে নিজ আসনে পরাজিত করতে ব্রেক্সিটবিরোধীরা ওই আসনে তুমুল প্রচারও চালিয়েছিল। কিন্তু সব আশঙ্কা উড়িয়ে নিজ আসনে বিজয় অর্জন করেছেন নির্বাচনের মূল নায়ক বরিস জনসন। তিনি পেয়েছেন ২৫ হাজার ৩৫১ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী লেবার দলের প্রার্থী আলী মিলানি পেয়েছেন ১৮ হাজার ১৪১ ভোট।

সবচেয়ে বেশি নারী প্রার্থীর জয় : ব্রিটেনের পার্লামেন্ট নির্বাচনে এবার সবচেয়ে বেশি নারী প্রার্থী জয়লাভ করেছেন। এর মধ্যে বিরোধী লেবার পার্টি থেকে ১০৪ জন নারী প্রার্থী জয়লাভ করেছেন। এদের মধ্যে চারজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নারী প্রার্থী রয়েছেন। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ থেকে ৮৬ জন নারী প্রার্থী জয়লাভ করেছেন। ৪০ বছর আগে অর্থাৎ ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে ব্রিটেনে একজন নারী প্রার্থীও জয়লাভ করেননি। কিন্তু ২০১৯ সালে এ সংখ্যা ২০০’র বেশি হয়েছে।

ব্রেক্সিটের পর যুক্তরাজ্যের অখ-তা নিয়েও ভাবনা : নির্বাচনের ফল প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে ব্রেক্সিট বাস্তবায়ন করে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়া প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেছে। এখন ভাবনা তৈরি হয়েছে যুক্তরাজ্যের অখ-তা নিয়েও। কারণ, ব্রিটিশ পার্লামেন্টে স্কটল্যান্ডের জন্য নির্ধারিত যে ৫৯টি আসন রয়েছে তার ৮১ শতাংশতেই সেখানকার প্রধান দল এসএনপি জিতেছে। বিপুল এ জয়ের পর এসএনপি নেতা নিকোলা স্টারজিওন বলেছেন, ভোটের এই ফল স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার প্রশ্নে দ্বিতীয় গণভোট আয়োজনের পক্ষে একটি স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে। এরপর আছে উত্তর আয়ারল্যান্ড। সেখানেও জাতীয়তাবাদীদের জয়জয়কার। আর বরিস জনসন যে ব্রেক্সিট চুক্তি করেছেন, তাতে ইইউর সঙ্গে উত্তর আয়ারল্যান্ডের যে সম্পর্কের রূপরেখা দেওয়া হয়েছে তা যুক্তরাজ্যের অন্যান্য অংশের থেকে আলাদা। বিবিসির রাজনৈতিক ভাষ্যকারের মতে, সব মিলিয়ে ব্রিটেনকে একসঙ্গে রাখা অর্থাৎ ইংল্যান্ড, উত্তর আয়ারল্যান্ড এবং স্কটল্যান্ডের অখ-তা টিকিয়ে রাখা এখন হবে বড় চাপ। অবশ্য বরিস জনসন গতবার প্রধানমন্ত্রিত্ব গ্রহণের সময় নিজেকে ‘অখ-তার পক্ষের মন্ত্রী’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। সেটা তিনি ব্রিটেন ভেঙে যেতে পারে এমন আশঙ্কা থেকেই করেছেন বলে মন্তব্য করা হয়েছে বিবিসির প্রতিবেদনে।

সর্বশেষ খবর