রবিবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

পশ্চিমবঙ্গ উত্তাল, আসামে কমছে উত্তাপ

নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন

দীপক দেবনাথ, কলকাতা

পশ্চিমবঙ্গ উত্তাল, আসামে কমছে উত্তাপ

পশ্চিমবঙ্গে হাওড়ায় গতকাল ব্যাপক বিক্ষোভ হয় -এএফপি

নাগরিকত্ব আইন ইস্যুতে উত্তর-পূর্ব ভারত, পশ্চিমবঙ্গে বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। গতকাল সকালে পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলার কোনা এক্সপ্রেসওয়ের গড়ফা ব্রিজের কাছে টায়ার জ্বালিয়ে অবরোধ করা হয়। ছয়টি সরকারি বাসে ভাঙচুর, পরে তাতে অগ্নিসংযোগ ঘটানো হয়। পুলিশকে লক্ষ্য করে চলে ইট ও পাথর বৃষ্টি। পাল্টা পুলিশকেও লাঠিপেটা করতে হয়। ডোমজুড়েরর সলপ মোড়ে ৬ নম্বর জাতীয় সড়কেও টায়ার জ্বালিয়ে অবরোধ করা হয়। আধা ঘণ্টা পর অবরোধ তুলে দেয় পুলিশ। সাঁকরাইল রেলস্টেশনের আশপাশ এলাকায় এদিন সকালের দিকে শতাধিক বিক্ষোভকারী জমায়েত হয়ে একাধিক দোকানে অগ্নিসংযোগ ঘটান। দুপুরের দিকে স্টেশন চত্বরে প্রবেশ করে টিকিট কাউন্টারটি পুড়িয়ে দেন। রেলপুলিশ তাদের বাধা দিতে গেলে তাদের ওপরও হামলা চালান বিক্ষোভকারীরা।

মুর্শিদাবাদ জেলার রঘুনাথগঞ্জ থানার তালাই মোড়ে ৩৪ জাতীয় সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে অবরোধ করা হয়। সুতি থানার সাজোর মোড়ে যাত্রীদের নামিয়ে তাতে ভাঙচুর করা হয়। বেলডাঙায় রেলের যন্ত্রাংশে আগুন ধরিয়ে দেয় উত্তেজিত জনতা, ভেঙে দেওয়া হয় প্যানেল রুম। ফলে বিকল হয়ে পড়েছে সিগনালিং ব্যবস্থা। পরে তা নেভাতে এলে ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতেও অগ্নিসংযোগ ঘটানো হয় বলে অভিযোগ।

উত্তরচব্বিশ পরগনা জেলার আমডাঙায় পানির পাইপ ফেলে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক অবরোধ করেন বিক্ষোভকারীরা। শিয়ালদহ-হাসনাবাদ রেল শাখার শ ালিয়া রেলস্টেশনে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ দেখানো হয়। রেললাইনের ওপর বিক্ষোভ দেখানোর ফলে রাজ্যজুড়েই বিভিন্ন জায়গায় রেল চলাচল ব্যহত হয়।

নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন ইস্যু প্রভাব ফেলেছে ঘোজাডাঙা (ভারত)-ভোমরা (বাংলাদেশ) সীমান্তেও। এদিন সকালে পশ্চিমবঙ্গের উত্তরচব্বিশ পরগনা জেলার ঘোজাডাঙা সীমান্তের কাছেই ওল্ড সাতক্ষীরা রোডে টায়ার জ্বালিয়ে রাস্তা আটকে বিক্ষোভ দেখানো হয়। ফল রাস্তার দুই ধারে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে পণ্যবাহী ট্রাক। ব্যবসায়ীদের আশঙ্কা, এতে নষ্ট হতে পারে কয়েক লাখ রুপির কাঁচা সবজি ও ফল। এদিকে এ ইস্যুতে রাজ্যজুড়ে সহিংসতার পরিপ্রেক্ষিতে শান্তি বজায় রাখার আবেদন জানিয়েছেন বিশিষ্টজনেরা। টুইট করে রাজ্যপাল জগদীপ ধনকর লিখেছেন, ‘রাজ্যজুড়ে যে সহিংসতা চলছে তাতে আমি দুঃখিত ও ব্যথিত। শপথ অনুসারে মুখ্যমন্ত্রীকে ভারতের সংবিধানের প্রতি আস্থা, আনুগত্য রাখা উচিত এবং একজন রাজ্যপাল হিসেবে সংবিধান ও আইন রক্ষায় আমি সর্বতোভাবে চেষ্টা করব।’ বিক্ষোভকারীদের সংযত হওয়ার আবেদন জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিও। শুক্রবারই হাওড়া জেলার উলুবেড়িয়া রেলস্টেশনে চলন্ত যাত্রীবাহী ট্রেনে হামলা চালায় বিশেষ এক সম্প্রদায়ের মানুষ। ট্রেনকে লক্ষ্য করে পাথর ছোড়ার ঘটনার ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দৌলতে ভাইরাল হয়ে যায়। এর পরই হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থার ঘোষণা দেওয়ার পাশাপাশি আবেদন জানিয়ে গতকাল রাজ্য সরকারের সচিবালয় থেকে একটি বিবৃতি দিয়ে মমতা জানান, ‘আপনারা নিজের হাতে আইন তুলে নেবেন না। রাস্তায় বা রেল অবরোধ করে সাধারণ মানুষের অসুবিধা সৃষ্টি করবেন না।’ মমতা আরও জানান, ‘সরকারি সম্পত্তি নষ্ট করবেন না। যারা অশান্তি সৃষ্টি করবেন তাদের বিরুদ্ধে সরকার কঠোর পদক্ষেপ নেবে।’ মুখ্যমন্ত্রী এও জানান, ‘এ রাজ্যে এনআরসি বা সিএবি কোনোটাই প্রয়োগ করতে দেওয়া হবে না। আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ- মানুষের মধ্যে কোনো ভুল বোঝাবুঝি তৈরি করবেন না।’

যদিও বিজেপির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সভাপতি দিলীপ ঘোষ স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছেন, এ রাজ্যে নাগরিকত্ব আইন চালু করা হবেই। মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বা তার দল কেউই একে ঠেকাতে পারবে না।

একটি ভিডিও বার্তায় দিলীপ ঘোষ বলেন, ‘আগে মমতা ব্যানার্জি কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা বিলোপের বিরোধিতা করেছিলেন, নোট বাতিলের বিরোধিতা করেছিলেন কিন্তু তা ঠেকাতে পারেননি। এবারেও পারবেন না। পশ্চিমবঙ্গে নতুন নাগরিকত্ব আইন চালু করা হবেই।’

দিলীপের অভিযোগ- ‘রাজ্যে ভোট ব্যাংক হারানোর ভয়েই মমতা ব্যানার্জি এটা চালু করতে দিচ্ছেন না। একটা বিষয় পরিষ্কার করে দিতে চাই, এ রাজ্যে নাগরিকত্ব আইন চালু করা হবে। মমতা ব্যানার্জি বা তার দল তৃণমূল কংগ্রেস কেউই এটাকে আটকাতে পারবে না।’

তবে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলাজুড়ে সহিংসতা অব্যাহত থাকলেও গতকাল আসামের পরিস্থিতি তুলনামূলকভাবে কিছুটা শান্ত ছিল। নাগরিকত্ব আইন ইস্যুতে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে উত্তাল হয়ে উঠেছিল আসাম। সংসদে নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিল পাস হওয়ার পর বৃহস্পতিবার পুলিশের গুলিতে দুজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। সহিংসতা আয়ত্তে আনতে ব্যর্থ হওয়ায় ১০ পুলিশ কর্মকর্তাকে অন্যত্র সরিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু শুক্রবার রাত থেকে গতকাল সকাল পর্যন্ত নতুন করে কোনো সহিংসতার খবর পাওয়া যায়নি। ফলে এদিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল করা হয়। পুলিশের তরফে মাইকিং করে সাধারণ মানুষের মধ্যে কারফিউ শিথিলের বিষয়টি অবগত করা হয়। যদিও স্কুল-কলেজ-অফিস এখন পর্যন্ত বন্ধ রাখা হয়েছে। এ ইস্যুতে সহিংসতার জেরে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের ভারত সফরও স্থগিত রাখা হয়েছে। আগামী সপ্তাহেই গুয়াহাটিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সাক্ষাতের কথা ছিল আবের। আসামের ডিব্রুগড়ে সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল করা হয়। গুয়াহাটিতে কিছু সময়ের জন্য ব্রডব্যান্ড পরিষেবা চালু করা হয়।

এদিকে নাগা স্টুডেন্টস ফেডারেশন (এনএসএফ)-এর ডাকা সকাল ৬টা থেকে ছয় ঘণ্টার হরতালে নাগাল্যান্ডে এখন পর্যন্ত স্কুল-কলেজ-দোকান সবকিছুই বন্ধ রয়েছে। রাস্তা থেকে উধাও যানবাহন। সব মিলিয়ে জনজীবন প্রায় বিপর্যস্ত। যদিও এখন পর্যন্ত বড় কোনো সহিংসতার খবর পাওয়া যায়নি।

সর্বশেষ খবর