মঙ্গলবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

বিক্ষোভে উত্তাল ভারত, সংঘর্ষ দিল্লি পশ্চিমবঙ্গে

প্রতিদিন ডেস্ক

ভারতের অনেক শহরে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়েছে। সংশোধিত নাগরিক আইনের প্রতিবাদে গতকাল পঞ্চম দিনের মতো বিক্ষোভ চলে। তবে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। রাজধানী নয়াদিল্লি, মুম্বাই, হায়দরাবাদ, কলকাতাসহ বড় শহরগুলোতে ব্যাপক প্রতিবাদের খবর পাওয়া গেছে। বিবিসি নিউজ অনলাইনের খবরে বলা হয়েছে, রাস্তাঘাটে ব্যারিকেড ও বাসে আগুন দেওয়ার জের ধরে পুলিশ টিয়ারশেল ছোড়ে এবং অনেককে আটক করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে। সমালোচকরা বলছেন, আইনটি মুসলিমবিরোধী। আবার সীমান্ত অঞ্চলে অনেকে এ আইনে কারণে বড় ধরনের অভিবাসী ঢলের আশঙ্কা করছেন। প্রতিবাদ বিক্ষোভ শুরু হয়েছে বৃহস্পতিবার। উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে তা ছড়িয়ে পড়ার আগে ছয়জন নিহত হয়েছেন। কর্তৃপক্ষ ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। কিন্তু এরপরও বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষার্থীরা দেশজুড়ে গতকাল বিক্ষোভ করেছেন।

আমাদের কলকাতা প্রতিনিধি জানান, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (ক্যাব) ও জাতীয় নাগরিকপঞ্জির (এনআরসি) প্রতিবাদে কলকাতার রাজপথে গতকাল বিশাল মিছিলে যোগ দেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। গতকাল বেলা ১টায় কলকাতার রেড রোডে অবস্থিত সংবিধানের প্রাণপুরুষ বিআর আম্বেদকরের মূর্তির সামনে থেকে মিছিলটি শুরু হয়। পরে মিছিলটি মেয়ো রোড, জহরলাল নেহেরু রোড, ধর্মতলা, চিত্তরঞ্জন এভিনিউ হয়ে শেষ হয় জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি গিয়ে। মিছিল শুরুর আগে আম্বেদকর মূর্তির পাদদেশে একটি অস্থায়ী মঞ্চ থেকে শপথ নেওয়া হয়। মুখ্যমন্ত্রীর সুরে উপস্থিত সবাই বলেন, ‘আমরা সবাই নাগরিক। সর্বধর্ম সমন্বয়ে আমাদের জীবনাদর্শ। কাউকে বাংলা ছাড়তে দেব না। নিশ্চিন্তে থাকব, শান্তিতে থাকব। বাংলায় এনআরসি, ক্যাব করতে দিচ্ছি না, দেব না। শান্তি রাখতে হবে।’

এই আইনকে অসাংবিধানিক আখ্যা দিয়ে মমতা বলেন, ‘জাপানের প্রধানমন্ত্রী ভারত সফর বাতিল করেছেন। বাংলাদেশ আমাদের সবচেয়ে বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র। একাত্তরের সময় থেকে বাংলাদেশ আমাদের কাছের বন্ধু। আজ বাংলাদেশও এখানকার অনুষ্ঠান বাতিল করেছে। উত্তর-পূর্বের ভাই-বোনেরাও খুব উদ্বিগ্ন।’

মমতা বলেন, ‘আপনারা হিন্দু-মুসলিম-শিখ-খ্রিস্টান আমার ওপর যদি আপনাদের আস্থা থাকে, তবে মনে রাখবেন যে আমরা এখানে বাংলায় আছি। আমার লাশের ওপর দিয়ে ক্যাব ও এনআরসি করতে হবে। তা না হলে করা যাবে না।’ একই ইস্যুতে আজ মঙ্গলবার বেলা ১টায় দক্ষিণ কলকাতার যাদবপুর ৮বি বাসস্ট্যান্ডের সামনে থেকে একটি মিছিল শুরু হয়ে তা শেষ হবে ভবানীপুরের যদুবাবুর বাজারে। আগামীকাল বুধবার একই সময় হাওড়া ময়দান থেকে একটি মিছিল শুরু হয়ে যাবে কলকাতা ডোরিনা ক্রসিং পর্যন্ত। প্রতিটি মিছিলে উপস্থিত থাকবেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি।

এ আইনকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যে আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, মণিপুর, পশ্চিমবঙ্গে একাধিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে সহিংসতার মাত্রা কিছুটা কমলেও পশ্চিমবঙ্গে তা কিছুতেই থামছে না। শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে মুখ্যমন্ত্রীর আবেদন সত্ত্বেও সড়ক অবরোধ থেকে শুরু করে ট্রেনে পাথর ছোড়া,  রেলস্টেশনে অগ্নিসংযোগ, রেলকর্মীদের মারধর, সম্পত্তি ধ্বংস কোনো কিছুই বাদ যাচ্ছে না।

গতকাল সকালেও রাজারহাট-চিনার পার্ক এলাকায় সড়ক অবরোধ করা হয়। বাস থেকে জোর করে যাত্রীদের নামিয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে। শিয়ালদহ-বারুইপুর রেল শাখার গোচরণ ও দক্ষিণ বারাসাত রেললাইনের মাঝে ওভারহেড তারে কলাপাতা ফেলে দেওয়ায় ট্রেন চলাচল বিঘিœত হয়। শিয়ালদহ-ডায়মন্ড হারবার সেকশনে ধপধপি স্টেশনেও ট্রেন অবরোধ করা হয়। একই ইস্যুতে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার হলদিয়া ও পর্যটন নগরী দীঘা যাওয়ার পথে ৪১ নম্বর জাতীয় সড়কে নন্দকুমার ও কাপাসবেড়ায় টায়ার জ্বালিয়ে সড়ক অবরোধ করে অল ইন্ডিয়া মাইনরিটি অ্যাসোসিয়েশন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ও রাজ্যপাল জগদীপ ধনকারের কুশপুত্তলিকা পোড়ানো হয় জাতীয় সড়কের ওপর। পাশাপাশি হলদিয়ার বাসুলিয়ায় ট্রেন অবরোধ করেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

বিক্ষোভ চলে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার দাসপুর থানার বকুলতলা রাজ্য সড়কেও। সকাল থেকে রাজ্য সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভে শামিল হন এনআরসিবিরোধীরা। পরিস্থিতি সামলাতে ঘটনাস্থলে বিশাল পুলিশ বাহিনী আসে। এদিকে গতকাল সকালে কেরালার তিরুন্তপুরম শহীদ স্তম্ভের সামনে সত্যাগ্রহে শামিল হন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন। সভা থেকে কেরালার মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘ভারতের সংবিধান ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে কীভাবে রক্ষা করতে হয় তা গোটা দেশকে দেখিয়েছে কেরালা। দেশজুড়ে চলা প্রতিবাদের পাশে থেকে সমর্থনের বার্তা দিয়েছে এ রাজ্যের মানুষ।’ 

অন্যদিকে একই ইস্যুতে উত্তপ্ত রাজধানী দিল্লি ও উত্তরপ্রদেশ। রবিবার দিল্লির জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ সহিংসতার আকার নেয়। পুলিশকে লক্ষ্য করে পাথর ছোড়া, সরকারি সম্পত্তির ক্ষতিসাধন, সরকারি কর্মচারীদের কাজে বাধা দেওয়া হয় বলে অভিযোগ ওঠে। গতকাল শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে একাধিক ধারায় দুটি পৃথক মামলা করে দিল্লি পুলিশ। সহিংসতার জেরে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। দিল্লির পর বিক্ষোভের আঁচ ছড়িয়েছে উত্তরপ্রদেশের লখনৌর নাদওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে এদিন সংঘর্ষ বাধে। পুলিশকে লক্ষ্য করে পাথর ছোড়েন শিক্ষার্থীরা। এতে বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য আহত হন। জানা গেছে, শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আটকে রেখে সেখানকার মূল ফটক বন্ধ করে দেয় পুলিশ। মূল ফটক বন্ধ করার পরই বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই পুলিশকে লক্ষ্য করে পাথর ও জুতা ছোড়া হয়। লখনৌ থেকে আসা লাইভ ফুটেজে দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষার্থীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে পাথর ছুড়ছে। শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসেই অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। টিভি ফুটেজে দেখা গেছে, পুলিশ ছাত্রদের ওপর লাঠিচার্জ করছে। মর্যাদাপূর্ণ ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির শিক্ষার্থীরাও বিক্ষোভের ডাক দিয়েছেন। সংহতি প্রকাশ করে পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যায়ের শিক্ষার্থীরা। আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়েছে। এর জের ধরে ক্যাম্পাস ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বড় বিক্ষোভ হয়েছে হায়দরাবাদেও। আর দিল্লিতে পুলিশি হামলার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছেন মৌলানা আজাদ উর্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে পুলিশের হামলার প্রতিবাদে দিল্লিতে রবিবার সারা রাত ধরে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। দিল্লিতে ছাত্ররা অভিযোগ করেছেন, পুলিশ শিক্ষার্থীদের শারীরিকভাবে হেনস্তা ও যৌন হয়রানি করেছে। মোমবাতি হাতে মিছিল করেছেন মুম্বাইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্সেসের শিক্ষার্থীরা। বারানসি ছাড়াও আরও অনেক শহরে সংহতি প্রকাশ করে মিছিল হয়েছে। বিভিন্ন রাজ্যে বিক্ষোভকারীরা রাস্তা বন্ধ করে এবং বাসে আগুন দেয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ টিয়ার গ্যাস ছোড়ে।

গত দুই দিনে বিক্ষোভকারী এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষে আসামে এ পর্যন্ত ২৭ জন আহত হয়েছেন। এদের মধ্যে ১৩ জন গুয়াহাটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

দেশজুড়ে চলা সহিংসতার পরিপ্রেক্ষিতে টুইট করে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার আহ্বানের পাশাপাশি সহিংসতার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা তাদের নাগরিকদের উত্তর-পূর্ব ভারত ভ্রমণের ক্ষেত্রে সতর্কতা জারি করেছে। এদিকে নাগরিকত্ব আইন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের সাবেক নৌমন্ত্রী শাজাহান খান এমপি। গতকাল কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের মহান বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার আগে তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন আগে যারা ভারতে চলে এসেছেন, এখন বাংলাদেশের নাগরিক নন, তাদের যখন ফেরত পাঠানো হবে, স্বাভাবিকভাবেই আমরা তাদের গ্রহণ করব না।’

সর্বশেষ খবর